আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মারিও বার্গাস ইয়োসার লেখক হওয়ার গল্প ***

মারিও বার্গাস ইয়োসা পেরুর মহান কথাশিল্পী। তার রাজনীতিস্নাত রচনাবলিতে ল্যাটিন আমেরিকায় ক্ষমতা ও দুর্নীতির অমানিশা তীব্র ও নিবিড়ভাবে চিত্রিত। বিংশ শতকের স্পেনিশ লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম প্রধান। মারিও বার্গাসের উপন্যাস, নাটক এবং গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা ৩০-এর অধিক। আন্তর্জাতিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে তার গভীর প্রভাব রয়েছে।

১৯৬০-এর দশকে 'নায়কের কাল', 'দ্য গ্রিন হাউস' এবং 'গীর্জ্জায় কথোপকথন' উপন্যাসত্রয় কেন্দ্র করে মারিও বার্গাসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং সংবাদপত্রে লেখা বিভিন্ন কলামে তার অকপট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি শাসকমহলে বিশেষ তোলপাড় সৃষ্টি করে। তার কলামগুলোর অধিকাংশ বিষয় ছিল তৎকালীন পেরুর জাতীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপট। তার লেখা কেবল পেরু নয়, বরং বিংশ শতকের বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মনে প্রতিফলিত হয়েছে। তার রচনায় দ্রোহের গভীর অনুপ্রেরণার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে ব্যাপ্ত কৌতুকাবহ, কখনো যৌনতা।

যেখানেই মানুষের স্বাধীনতা বিপন্ন কিংবা মানবাধিকার লাঞ্ছিত সেখানেই বার্গাস ইয়োসার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেছে। আর এ জন্য বিশ শতকে মারিও বার্গাসকে ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক বিবেক বিবেচনা ধরা হয়।

মারিও বার্গাসের জন্ম দক্ষিণ পেরুর আরেকি্বপা শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৯৩৬-এর ২৮ মার্চ। তার পূর্ণ নাম হোর্হে মারিও পেদ্রো বার্গাস ইয়োসা। তাকে সচরাচর তার পারিবারিক নাম বার্গাস ইয়োসা বলে সম্বোধন করা হতো।

জন্মের ঠিক আগে তার পিতা-মাতার সেপারেশন হয়। তারপর তার শৈশব কাটে মা আর নানা-নানীর সঙ্গে বলিভিয়ায়। ১০ বছর বয়সে তিনি প্রথম পিতার দেখা পান। কিন্তু তার বাবা মারিও বার্গাসের শৈশবে পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচাদির ভার নেননি আর এ কারণে নিদারুণ দারিদ্র্যের কশাঘাতে তার দিন কাটে। জীবিকার তাগিদে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বিভিন্ন অপরাধ সাময়িকীতে সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন।

মাধ্যমিক পাস করে তিনি 'কলেজিও ন্যাশনাল সান মিগেল দ্য পিওরা'-তে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। পরে তিনি 'ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সান মার্কস'-এ আইন ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। তার একাডেমিক পড়াশোনায় বেশ কৃতিত্ব ছিল, সে জন্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর বৃত্তি পেয়ে মাদ্রিদের ইনিভার্সিটি অব কমপ্লুতেন্সে থেকে তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় মারিও বার্গাস নিয়মিত লিখেছেন।

মারিও বার্গাস মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার ১০ বছরে বড় সম্পর্কিত খালা হুলিয়া ঊরকি্বদিকে বিয়ে করে তিনি নিজের অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।

তবে তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এই বিয়ে ভেঙে যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্যাত্রিসিয়া ইয়োসাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের তিনটি সন্তান।

মারিও বার্গাস ইয়োসা ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে ছাত্রাবস্থায় তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। তবে তার মূল জীবিকা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা।

১৯৬৭-তে তিনি গ্রিসে হুলিয়ো কোর্তজারের সঙ্গে যৌথভাবে ইউনেস্কোর হয়ে অনুবাদের কাজ করছিলেন। পরবর্তী সময়ে নিয়মিত অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন ইউনিভার্সিটি আব লন্ডনের কুইন মেরি কলেজ ও কিংস কলেজে, ওয়াশিংটন স্টেট (পুলম্যান), ইউনিভার্সিটি অব পুয়ের্টো রিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে। এ ছাড়া তিনি ওয়াশিটনের উড্রো উইলসন সেন্টারে ফেলো হিসেবে উচ্চতর গবেষণা কাজ করেন।

সমাজ বদল ও সামষ্টিক মুক্তির তাড়না মারিও বার্গাসকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করেছিল। তিনি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে পেরুর রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

যদিও তিনি জয়লাভ করেননি, তবু চেকোস্লোভাকিয়ার ভাস্লাভ হাভেলের পর পৃথিবীতে তিনিই দ্বিতীয় সাহিত্যিক যিনি ভোটাভুটির প্রথম পর্বে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ পদ গ্রহণের কাছাকাছি পেঁৗছে গিয়েছিলেন। তার এই অনন্য সাধারণ পদক্ষেপ ওই সময় বিশ্ব সাহিত্য মহলে ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি করেছিল।

মারিও বার্গাস ইয়োসা ছিলেন গভীরভাবে সমাজ সচেতন ও মানবতাবাদী মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মুক্তির প্রধান উপায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তিনি মনে করতেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের একচেটিয়া অধিকার নয়।

লেখক এবং সংস্কৃতি কর্মীরাও রাজনীতিতে গভীর ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিকে এড়িয়ে থাকার অবকাশ নেই। বর্তমান সমাজের প্রধান সমস্যা সহনশীলতার প্রকট অভাব। সহনশীলতার অভাবে গণতন্ত্রের রূপ দ্রুত বদলে যায়। একবিংশ শতাব্দীর মূল আন্তর্জাতিক সমস্যা হলো সন্ত্রাসবাদ।

সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি ফ্যানাটিজম থেকে, ফ্যানাটিকরা নিজের বিশ্বাসকে অবিমিশ্র সত্য মনে করে এবং প্রতিপক্ষ অসত্য বিধায় তাকে ধ্বংস করে দেওয়ার নীতিতে কাজ করে। ল্যাটিন আমেরিকার সব সমস্যার মূলে রয়েছে ভ্রষ্ট্র রাজনীতি। বার্গাস ইয়োসা লেখকের রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। নোবেলজয়ী গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল এ রকম- 'তার (মারিও বার্গাস) লেখা ও রাজনীতির মান এক নয়। আমি লেখক হিসেবে তার কাজের বড় ভক্ত।

আমি তার কাজ নিয়ে ৬০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে ততটা শ্রদ্ধা করতে পারি না, তার রাজনৈতিক বিশ্বাসকেও না। তার বিশ্বাসকে সিরিয়াস মনে হয় না। জীবনের শুরুতে তিনি রাজনীতিমনস্ক ছিলেন এবং তার কথাসাহিত্য শুরু থেকেই গভীরভাবে রাজনীতিগ্রস্ত। ' মারিও বার্গাসের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা তার লেখকজীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃৃক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, সামরিক বাহিনীর দাপট, মুনাফালোভী বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শোষণ ইত্যাদি তার চেতনায় যে দ্রোহ সৃষ্টি করেছিল সে থেকেই তার রাজনীতির সূত্রপাত। তবে তার রাজনৈতিক দর্শন ক্রমশ বাম থেকে ডানে হেলে পড়েছে। একসময় কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো তাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করলেও পরবর্তীতে তিনি কিউবার বিপ্লবী শাসন এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বাক-স্বাধীনতাবিরোধী শাসনের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৮০'র শেষপাদে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পরে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন।

পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়ে স্পেনে অভিবাসন গ্রহণ করেন। সাত বছর তিনি পেরু যাননি। তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন। বার্গাস ইয়োসা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সমর্থক ছিলেন। অন্যদিকে তিনি বলতেন লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার থ্যাচারের উপযুক্ত শিষ্য।

বার্গাস ইয়োসা মনে করেন পৃথিবীতে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুল পথে চলেছে।

মারিও বার্গাস ছেলেবেলায়ই সাহিত্য রচনায় প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যৌবনে প্যারিস, মাদ্রিদ ও লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি লেখক হিসেবে আত্দপ্রকাশ করেন। সাহিত্য রচনায় তিনি শুরু থেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী উপজীব্য করেছেন।

সমাজের ক্ষয়িষ্ণু রূপ, বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়াবলী পৌনঃপুনিকভাবে তার আনুকূল্য লাভ করেছে বিভিন্ন উপন্যাসে। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'লস জেফিস'। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর ২০১০ পর্যন্ত তিনি আর ছোটগল্পের কোনো সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেননি। জীবনের প্রথম গ্রন্থটি সম্পর্কে বার্গাস ইয়োসা বলেন- আমি ফকনারের অনুরক্ত ছিলাম, কিন্তু এই গল্পগুলোতে আমি হেমিংওয়েকে অনুকরণ করেছি।

১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'নায়কের কাল নামীয়' প্রথম উপন্যাসটিই বিতর্কের জন্ম দেয়। এটি পেরুর মিলিটারি একাডেমির প্রেক্ষাপটে রচিত। এই একাডেমিতে তিনি দুই বছর অধ্যয়ন করেছিলেন। বিক্ষুব্ধ সামরিক বাহিনী এ বইটির এক হাজার কপি পুড়িয়ে দেয়।

প্রথম উপন্যাসের মধ্য দিয়েই তিনি বিশ্বব্যাপী হিস্পানি পাঠকগোষ্ঠীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক উপন্যাস রচনায় তিনি বিশেষভাবে সিদ্ধহস্ত। ছাগলের মহাভোজ উপন্যাসের কাহিনীতে তিনি স্বৈরাচারী একনায়কের উত্থান এবং অদ্ভুত সমাজ-সম্পৃক্ততার বিশ্লেষণ করেছেন। তার রচনা রাজনীতিস্নাত হলেও তিনি কখনো সাহিত্যগুণ ও শিল্পমানের ব্যাপারে আপস করেননি। নোবেল পুরস্কার ঘোষণা শেষে সুইডিশ একাডেমির সচিব সাংবাদিকদের কাছে বার্গাস ইয়োসাকে একজন অনন্যসাধারণ কাহিনীকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যার রচনাশৈলী ঋজু এবং সংলাপ অসরল।

তার রচনারীতিতে কাহিনী-বয়নের একটি প্রাগ্রসর কৌশল হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

তার অন্য রচনার মধ্যে উপন্যাস লা সিউদাদি লস পেরস (১৯৬৩), লা কাসা ভারদি (১৯৬৬), কনভার্সেসিও এনলা ক্যাতেদ্রাল (১৯৬৯), পান্তালিয়ঁন ইলাস ভিসিদাদোরাস (১৯৭৩), লা তিয়া হুলিয়া ইযেলেসক্রিবিদর (১৯৭৭), লা গেরা দেল ফিন দেল মুঁন (১৯৮১), ইসতোরিয়া দে মাইতা (১৯৮৪), কি্বন মাতো আ পালমিনা মলেরো (১৯৮৬), ইল য়াবলাদোর (১৯৮৭), এলোগিও দে লা মাদরাস্ত্রা (১৯৮৮), লিতোমা এন লস আন্দেস (১৯৯৩), লস কোয়াদেরনস দি দন রিগাবরতো (১৯৯৭), লা ফিয়েস্তা দেল চিবো (২০০০), এল প্যারাইসো এন লা এসকি্বনা (২০০৩), ত্রাবেসুরাস দে লা নিনয়া মালা (২০০৬), এল সুয়নিও দেল সেলতা (২০১০); নাটক La huida del inca (১৯৫২), La seùorita de Tacna (১৯৮১), Kathie y el hipop’¡tamo (১৯৮৩) এবং আত্দজীবনী গ্রন্থ জলবাসী মৎস্য (১৯৯৩) অন্যতম।

সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি দেশে-বিদেশের বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এই মহান কথাশিল্পী ২০১০ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.