কৃতিমানের কৃতি কখনও মরে না। আমাদের আবুল হোসেন তেমনি একজন কৃতিমান। আজও তার কৃতি প্রকাশ হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোর পাতায়। ব্লগের পাঠকদের জন্য তাই রিপোর্টটি হু বহু তুলে ধরা হলো। আপনারাই বিবেচনা করে বলুন এ ব্যর্থতা কার? আবুলের? আওয়ামীলীগের? সরকারের? শেখ হাসিনার? নাকি দেশের জনগণের।
শুধু শেষেরটা বাদে আর একজনের লজ্জা নাই। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ-প্রাণ খুলে মন্তব্য প্রদান করুন।
শহরতলি থেকে দ্রুত বেশি মানুষ আনা-নেওয়া করে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর দৈনন্দিন যাত্রীর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আধুনিক কমিউটার ট্রেন ডেমু আমদানি করেছিল রেলওয়ে। সেই ডেমুতে এখন কীভাবে কম যাত্রী বহন করা যায়, সে চিন্তায় ঘুম হারাম রেল কর্তৃপক্ষের।
বেশি যাত্রীর চাপে অকেজো হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু চালানো হচ্ছে যখন সবচেয়ে কম যাত্রী চলাচল করে (সুপার অফ পিক আওয়ার)।
গত ২৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম-লাকসাম পথে এবং চট্টগ্রাম শহরে ডেমু চালু হয়েছে গত ২৫ মে। কিন্তু সেখানেও যাত্রী তোলা হচ্ছে গুনে গুনে। এখন রেল দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডেমু নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছে, যাত্রী ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় ডেমুতে আগ্রহী নয় তারা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ডেমুতে শুধু যাত্রী ধারণক্ষমতা কম—এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। এর নকশাও বাংলাদেশ রেলের অবকাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ডেমু ট্রেনের প্রকল্পটি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সময়ে নেওয়া। এই ট্রেন কেনার সময় সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় ৬৫৪ কোটি টাকার ২০ সেট ডেমু এখন রেলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, রেলের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের অবকাঠামোর কথা বিবেচনায় নিয়ে ডেমুর নকশা না করে চীনের তাংশান কোম্পানি যে ধরনের ডেমু তৈরি করে, সেই অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করেন। অথচ ডেমু প্রকল্পের অধীনে ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা চীন সফর করেছেন। তাঁরা সেখানে কী পরিদর্শন করেছেন, এখন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে একদল কর্মকর্তা চার মাস চীনে অবস্থান করেন বলে রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ডেমুসহ সব ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় ও পরিচালনা করে রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ।
আর যাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব পরিবহন বিভাগের। চালুর পর রেলের পরিবহন বিভাগ ডেমুতে যেসব সমস্যা পেয়েছে, সেগুলো হচ্ছে—ডেমুতে চাহিদার তুলনায় যাত্রী ধারণক্ষমতা কম। পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। যাত্রীদের বসার আসনের নিচে ইঞ্জিন থাকায় মেঝে গরম হয়ে যায়। ফলে যাত্রীরা গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে দরজার উচ্চতা আড়াই ফুট উঁচু এবং দরজার হাতলও যাত্রীবান্ধব নয়। সাধারণ ট্রেন কমলাপুর প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই ফুট উঁচু। সাধারণ ট্রেনের চেয়ে দরজার উচ্চতা আধা ফুট বেশি বলে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ডেমুতে উঠতে সমস্যা হয়। টয়লেট না থাকায় দূরের পথে (চট্টগ্রাম-লাকসাম, দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার) যাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে।
চালুর পরদিন ২৫ এপ্রিল রেলের পরিবহন বিভাগ মেকানিক্যাল বিভাগকে তিনটি চিঠি দেয়।
ওই চিঠিগুলোতেই এই সমস্যাগুলো উঠে আসে। সরেজমিন এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও একই সমস্যা দেখা গেছে। পরিবহন বিভাগের চিঠিতে ডেমুর সমস্যার কারণে ইতিমধ্যে যাত্রীরা মারমুখী হয়ে রেলের কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হয়েছে, ক্ষুব্ধ যাত্রীরা যেকোনো সময় ক্ষতি সাধন করতে পারে।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রেনটিতে ধারণক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
চাহিদার তুলনায় জোগান দিতে পারছি না। এখনো চেষ্টা চলছে সমস্যা সমাধানের। ’ ভেতরের গরম, দরজার উচ্চতা ও সিঁড়ির সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন সমস্যা কমে এসেছে।
ডেমু প্রকল্পটি চাপিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে বেমানান—এমন অভিযোগ সম্পর্কে রেলমন্ত্রী বলেন, প্রকল্প ঠিকই আছে।
এর পরও কোনো সমস্যা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুনীল চন্দ্র পালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু অপাঙেক্তয়: চালুর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে দৈনিক ১৬ জোড়া ডেমু চলাচল করবে। অর্থাৎ ডেমু ১৬ বার আসবে ও যাবে। এই পথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সাধারণ কমিউটার ট্রেন তুলে দেওয়া হবে।
কিন্তু উদ্বোধনের দেড় মাস পরও এই পথে মাত্র ছয়বার আসা-যাওয়া করছে ডেমু। কারণ, ট্রেনটির যাত্রী ধারণক্ষমতা কম। আবার বেশি যাত্রী যেন বহন না করা হয়, সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা রয়েছে রেলের।
রেলের মেকানিক্যাল বিভাগের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে বেশি যাত্রী বহন করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, ডেমু অন্য ট্রেনের তুলনায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে বেশি যাত্রী উঠলে তা অকেজো হয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বেশি যাত্রী উঠলে গরমে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয় বলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এক সেট ডেমুতে একটি বগি এবং দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। ইঞ্জিনেও যাত্রী বহন করা যায়। সব মিলিয়ে এক সেট ডেমুতে বসে ১৪৯ জন এবং দাঁড়িয়ে ১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম-লাকসাম পথে দুই সেট ডেমু এখন জোড়া দিয়ে চালানো হচ্ছে।
আর চট্টগ্রামে চলছে এক সেট।
বর্তমানে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে ডেমু ট্রেন চলে ভোর পাঁচটা ৪০, দুপুর একটা ৪০ ও রাত ১০টা ৫ মিনিটে। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে ভোর ছয়টা ৩৫, বেলা দুইটা ৩৫ এবং রাত ১১টা ৫ মিনিটে। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সময়গুলোতে যাত্রী সবচেয়ে কম হয়।
পুরোদমে ডেমু চালু না করার কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ১৩ জোড়া পুরোনো কমিউটার ট্রেনও চালানো হচ্ছে।
ডেমু চালানোর আগে রেলের কর্মকর্তারা পুরোনো কমিউটার ট্রেনের ওপর সমীক্ষা চালান। এতে দেখা গেছে, স্বাভাবিক দিনে প্রতিটি ট্রেনে গড়ে দেড় হাজার যাত্রী চলাচল করে। শুক্র ও শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিন চলাচল করে এক হাজার যাত্রী। অন্যদিকে দুই সেট জোড়া দেওয়ার পরও ডেমুর ধারণক্ষমতা ৬০০ যাত্রী।
ডেমু কেনায় অনিয়ম: রেলের নথি থেকে জানা যায়, ৬৫৪ কোটি টাকার ডেমু কেনার প্রকল্পটি নেওয়া হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই।
প্রথমে চীন থেকে সরবরাহ ঋণে (যে দেশ টাকা দেবে সে দেশ থেকে কেনা) প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে রাজস্ব খাত থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়ে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজস্বের টাকায় এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা দেখায় পরিকল্পনা কমিশন। এরপর প্রকল্পটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকার যানজট নিরসনে সহায়ক হবে উল্লেখ করে তা রাজস্ব খাত থেকে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে ২০১০ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারকে চিঠি লেখেন। এরপর প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।
ডেমু আমদানির লক্ষ্যে ২০১১ সালে চীনের তাংশান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। ২০ সেট ডেমুর মূল্য ৪২৬ কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে শুল্ক ও কর যুক্ত হয়। আরও যুক্ত হয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে বিদেশভ্রমণ ও ভাতা। সব মিলিয়ে প্রকল্প দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকার।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, রেলের ইঞ্জিন-কোচসহ যেকোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রে পরিবহন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। ডেমুর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
খরচ উঠবে কীভাবে: কর-শুল্ক বাদ দিয়ে প্রতিটি ডেমুর দাম পড়েছে ২৩ কোটি টাকা। প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, প্রতি সেট ডেমু থেকে প্রতি যাত্রায় নয় হাজার টাকা পাওয়া যাবে। দৈনিক ১৪ বার চলবে।
বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু পরিচালনা করছে এস আর ট্রেডিং নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি সেট ডেমুর প্রতি যাত্রায় রেল পাচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকা। সারা দিনে চলছে মাত্র ছয়বার।
প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ডেমুতে যাত্রীপ্রতি ৭৫ টাকা ভাড়া পাওয়া যাবে—এই হিসাব ধরে প্রকল্পটি যৌক্তিক প্রমাণ করা হয় এবং প্রকল্প অনুমোদন নেওয়া হয়। কিন্তু এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা করে।
চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে যে ডেমু ট্রেনটি চলছে সেটির ভাড়া ১৫ টাকা। প্রথম দিন ৩০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। আর চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা (৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত)। চট্টগ্রাম লাকসাম পথে দুই সেটের একটি ডেমুতে প্রথম দিন ১০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়।
রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে পাঁচ কোটি টাকারও কম দামে কেনা একটি এসি চেয়ার কোচ থেকে দৈনিক ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। যে টাকায় ডেমু কেনা হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে নতুন চার-পাঁচটি ট্রেন চালু করা যেত। শহরতলি থেকে দ্রুত বেশি মানুষ আনা-নেওয়া করে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর দৈনন্দিন যাত্রীর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আধুনিক কমিউটার ট্রেন ডেমু আমদানি করেছিল রেলওয়ে। সেই ডেমুতে এখন কীভাবে কম যাত্রী বহন করা যায়, সে চিন্তায় ঘুম হারাম রেল কর্তৃপক্ষের।
বেশি যাত্রীর চাপে অকেজো হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু চালানো হচ্ছে যখন সবচেয়ে কম যাত্রী চলাচল করে (সুপার অফ পিক আওয়ার)।
গত ২৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম-লাকসাম পথে এবং চট্টগ্রাম শহরে ডেমু চালু হয়েছে গত ২৫ মে। কিন্তু সেখানেও যাত্রী তোলা হচ্ছে গুনে গুনে। এখন রেল দপ্তর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডেমু নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছে, যাত্রী ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় ডেমুতে আগ্রহী নয় তারা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ডেমুতে শুধু যাত্রী ধারণক্ষমতা কম—এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। এর নকশাও বাংলাদেশ রেলের অবকাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ডেমু ট্রেনের প্রকল্পটি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সময়ে নেওয়া। এই ট্রেন কেনার সময় সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় ৬৫৪ কোটি টাকার ২০ সেট ডেমু এখন রেলের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, রেলের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের অবকাঠামোর কথা বিবেচনায় নিয়ে ডেমুর নকশা না করে চীনের তাংশান কোম্পানি যে ধরনের ডেমু তৈরি করে, সেই অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করেন। অথচ ডেমু প্রকল্পের অধীনে ৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা চীন সফর করেছেন। তাঁরা সেখানে কী পরিদর্শন করেছেন, এখন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে একদল কর্মকর্তা চার মাস চীনে অবস্থান করেন বলে রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ডেমুসহ সব ইঞ্জিন-কোচ ক্রয় ও পরিচালনা করে রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ।
আর যাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব পরিবহন বিভাগের। চালুর পর রেলের পরিবহন বিভাগ ডেমুতে যেসব সমস্যা পেয়েছে, সেগুলো হচ্ছে—ডেমুতে চাহিদার তুলনায় যাত্রী ধারণক্ষমতা কম। পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। যাত্রীদের বসার আসনের নিচে ইঞ্জিন থাকায় মেঝে গরম হয়ে যায়। ফলে যাত্রীরা গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে দরজার উচ্চতা আড়াই ফুট উঁচু এবং দরজার হাতলও যাত্রীবান্ধব নয়। সাধারণ ট্রেন কমলাপুর প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই ফুট উঁচু। সাধারণ ট্রেনের চেয়ে দরজার উচ্চতা আধা ফুট বেশি বলে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ডেমুতে উঠতে সমস্যা হয়। টয়লেট না থাকায় দূরের পথে (চট্টগ্রাম-লাকসাম, দূরত্ব ১২৮ কিলোমিটার) যাত্রীদের অসুবিধা হচ্ছে।
চালুর পরদিন ২৫ এপ্রিল রেলের পরিবহন বিভাগ মেকানিক্যাল বিভাগকে তিনটি চিঠি দেয়।
ওই চিঠিগুলোতেই এই সমস্যাগুলো উঠে আসে। সরেজমিন এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও একই সমস্যা দেখা গেছে। পরিবহন বিভাগের চিঠিতে ডেমুর সমস্যার কারণে ইতিমধ্যে যাত্রীরা মারমুখী হয়ে রেলের কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হয়েছে, ক্ষুব্ধ যাত্রীরা যেকোনো সময় ক্ষতি সাধন করতে পারে।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রেনটিতে ধারণক্ষমতা সীমাবদ্ধ।
চাহিদার তুলনায় জোগান দিতে পারছি না। এখনো চেষ্টা চলছে সমস্যা সমাধানের। ’ ভেতরের গরম, দরজার উচ্চতা ও সিঁড়ির সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন সমস্যা কমে এসেছে।
ডেমু প্রকল্পটি চাপিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে বেমানান—এমন অভিযোগ সম্পর্কে রেলমন্ত্রী বলেন, প্রকল্প ঠিকই আছে।
এর পরও কোনো সমস্যা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সুনীল চন্দ্র পালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু অপাঙেক্তয়: চালুর আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে দৈনিক ১৬ জোড়া ডেমু চলাচল করবে। অর্থাৎ ডেমু ১৬ বার আসবে ও যাবে। এই পথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সাধারণ কমিউটার ট্রেন তুলে দেওয়া হবে।
কিন্তু উদ্বোধনের দেড় মাস পরও এই পথে মাত্র ছয়বার আসা-যাওয়া করছে ডেমু। কারণ, ট্রেনটির যাত্রী ধারণক্ষমতা কম। আবার বেশি যাত্রী যেন বহন না করা হয়, সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা রয়েছে রেলের।
রেলের মেকানিক্যাল বিভাগের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে বেশি যাত্রী বহন করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, ডেমু অন্য ট্রেনের তুলনায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে বেশি যাত্রী উঠলে তা অকেজো হয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বেশি যাত্রী উঠলে গরমে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে এবং বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই নয় বলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এক সেট ডেমুতে একটি বগি এবং দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন রয়েছে। ইঞ্জিনেও যাত্রী বহন করা যায়। সব মিলিয়ে এক সেট ডেমুতে বসে ১৪৯ জন এবং দাঁড়িয়ে ১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম-লাকসাম পথে দুই সেট ডেমু এখন জোড়া দিয়ে চালানো হচ্ছে।
আর চট্টগ্রামে চলছে এক সেট।
বর্তমানে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে ডেমু ট্রেন চলে ভোর পাঁচটা ৪০, দুপুর একটা ৪০ ও রাত ১০টা ৫ মিনিটে। আর নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসে ভোর ছয়টা ৩৫, বেলা দুইটা ৩৫ এবং রাত ১১টা ৫ মিনিটে। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সময়গুলোতে যাত্রী সবচেয়ে কম হয়।
পুরোদমে ডেমু চালু না করার কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ১৩ জোড়া পুরোনো কমিউটার ট্রেনও চালানো হচ্ছে।
ডেমু চালানোর আগে রেলের কর্মকর্তারা পুরোনো কমিউটার ট্রেনের ওপর সমীক্ষা চালান। এতে দেখা গেছে, স্বাভাবিক দিনে প্রতিটি ট্রেনে গড়ে দেড় হাজার যাত্রী চলাচল করে। শুক্র ও শনিবারসহ সরকারি ছুটির দিন চলাচল করে এক হাজার যাত্রী। অন্যদিকে দুই সেট জোড়া দেওয়ার পরও ডেমুর ধারণক্ষমতা ৬০০ যাত্রী।
ডেমু কেনায় অনিয়ম: রেলের নথি থেকে জানা যায়, ৬৫৪ কোটি টাকার ডেমু কেনার প্রকল্পটি নেওয়া হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই।
প্রথমে চীন থেকে সরবরাহ ঋণে (যে দেশ টাকা দেবে সে দেশ থেকে কেনা) প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে রাজস্ব খাত থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়ে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজস্বের টাকায় এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অনীহা দেখায় পরিকল্পনা কমিশন। এরপর প্রকল্পটি অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকার যানজট নিরসনে সহায়ক হবে উল্লেখ করে তা রাজস্ব খাত থেকে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়ে ২০১০ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারকে চিঠি লেখেন। এরপর প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়।
ডেমু আমদানির লক্ষ্যে ২০১১ সালে চীনের তাংশান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। ২০ সেট ডেমুর মূল্য ৪২৬ কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে শুল্ক ও কর যুক্ত হয়। আরও যুক্ত হয় কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের নামে বিদেশভ্রমণ ও ভাতা। সব মিলিয়ে প্রকল্প দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকার।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, রেলের ইঞ্জিন-কোচসহ যেকোনো কেনাকাটার ক্ষেত্রে পরিবহন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়। ডেমুর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
খরচ উঠবে কীভাবে: কর-শুল্ক বাদ দিয়ে প্রতিটি ডেমুর দাম পড়েছে ২৩ কোটি টাকা। প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, প্রতি সেট ডেমু থেকে প্রতি যাত্রায় নয় হাজার টাকা পাওয়া যাবে। দৈনিক ১৪ বার চলবে।
বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ডেমু পরিচালনা করছে এস আর ট্রেডিং নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি সেট ডেমুর প্রতি যাত্রায় রেল পাচ্ছে দুই হাজার ৮০০ টাকা। সারা দিনে চলছে মাত্র ছয়বার।
প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ডেমুতে যাত্রীপ্রতি ৭৫ টাকা ভাড়া পাওয়া যাবে—এই হিসাব ধরে প্রকল্পটি যৌক্তিক প্রমাণ করা হয় এবং প্রকল্প অনুমোদন নেওয়া হয়। কিন্তু এখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পথে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা করে।
চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে যে ডেমু ট্রেনটি চলছে সেটির ভাড়া ১৫ টাকা। প্রথম দিন ৩০০ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। আর চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা (৩৩ কিলোমিটার পর্যন্ত)। চট্টগ্রাম লাকসাম পথে দুই সেটের একটি ডেমুতে প্রথম দিন ১০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়।
রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে পাঁচ কোটি টাকারও কম দামে কেনা একটি এসি চেয়ার কোচ থেকে দৈনিক ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। যে টাকায় ডেমু কেনা হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে নতুন চার-পাঁচটি ট্রেন চালু করা যেত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।