আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবিশ্বাসী অনুভুতি !

স্বার্থপরতাকে ঘৃণা করি তীব্রভাবে খা খা রোদের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে শান্তনু । সময় এখন দুপুর ২ টা কিন্তু এই পর্যন্ত সে কিছু খায় নি । প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে ওর । দেখতে ছিমছিমে আর নাক খাড়া করা চেহারা তার । কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল বের করে ঘড়ি দেখছে সে ।

দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগ গ্রন্থাগারের সামনে । এখানেই তার খুব খুব কাছের একটা বন্ধুর আসার কথা কিন্তু সে এখনো আসছে না । অগত্যা কিছু করতে না পেরে চারুকলার পাশে থাকা বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরতে লাগলো সে । আরো আধা ঘণ্টা পরে হঠাত কে যেনো পেছন থেকে ডাক দিলো , “ এই শান্তনু , বেয়াদব , এদিকে তুই আর আমি তোকে খুজছি সেই ১০ মিনিট ধরে । “ শান্তনু কিছু বলে না না সে অনেক আগেই এসেছে ।

বললো , “ না , বই দেখছিলাম । দেখ , হিমুসমগ্র কিনতে ইচ্ছে করছে কিন্তু টাকা নেই । “ -“ আরে বাদ দে তোর হিমু সমগ্র । আরে শোন একটা মজার ঘটনা । আজকে মার্কেটে গিয়েছিলাম দিনার সাথে ।

যা মজা হলো না । “ শান্তনু জানে এখন তার এসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলেই ভালো হয় ! কারণ মেয়ে মানুষের এই একটা সমস্যা । একটা কিছু পেলে আর ছাড়ে না । শান্তনু চুপ করে তার বন্ধুর কথা শোনে । কারণ ও জানে , ওর নিজের কত্ত কাছের , কত্ত বিশ্বাসের এই বন্ধুটি ।

কয়েকবার খাওয়ার কথা বলতে গিয়ে বাধা পেয়ে শেষ পর্যন্ত বললো , “ এই আমি কিছু খাই নি । তুই কি খেয়েছিস ? “ -“ আবার জিগায় । দিনা যা একটা খাওয়া দিলো না । আরে জানিস , আজকে ভাইয়া মানে দিনার বয়ফ্রেন্ড এসেছিলো । উনি আমাদের খাওয়ালেন KFC তে ।

শান্তনু বুঝতে পারলো এখন এই ভাইয়ার কথা চলবে আরো কিছুক্ষণ । সে চুপ করে হাঁটতে লাগলো । ও , শান্তনুর এই বন্ধুটির নাম বলা হয় নি এখনো । ওর নাম প্রমা । বয়সে শান্তনুর কয়েক মাসের ছোট হবে ।

শান্তনু যেদিন প্রমার সাথে প্রথম কথা বলে সে ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি তার সাথে যে প্রমার এত্তো ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে যাবে । শান্তনুর একটা বড় আফসোস ছিলো তার কোন বোন নেই । কিন্তু ওর কাছে প্রমাকে তার আপন বোনের মতোই মনে হয় । প্রতিদিন ক্লাস , আড্ডা , মজা করতে করতে কিভাবে যে শান্তনুর একটা সুন্দর বন্ধুসংঘ জুটিয়ে গেলো সে টেরও পেলো না । ছোটবেলায় শান্তনু অনেকবার শুনেছে মায়ের কাছে , “ তোর একটা বোন থাকলে যে কত্তো ভালো হতো !! “ কেনো ভালো হতো সেই কথা আগে শান্তনু বুঝে নি ।

তার কাছে মনে হতো ভালো হতো কারণ ছেলে হিসেবে সে মাকে যতটুকু সাহায্য করতে পারে , মেয়ে নিশ্চয়ই মাকে আরো বেশি সাহায্য করতে পারবে ! কিন্তু আস্তে আস্তে সময়ের পথচলায় শান্তনু বুঝতে পারে আসলে বোনের স্নেহ , বোনের ভালোবাসারও আলাদা একটা ব্যাপার থাকে । বোন ভাইকে যেভাবে আগলে রাখে , তার শত অন্যায়গুলোকে মার কাছ থেকে যেভাবে দূরে সরিয়ে দেয় একটা ভাই বা অন্য কেউ তা পারে না ! তার সেই বোনখরা মোচন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে । খুব আদরের ভাই হিসেবে শান্তনুর পথচলা শুরু হয়ে গেলো নতুন জায়গায় , নতুনভাবে । এখানে কেউ নেই তার পরিবারের , এমনকি দূর সম্পর্কেরও । কিন্তু এত্তো সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশ অনেকে তো নিজের বাড়িতেও পায় না ।

প্রমা হঠাত করেই শান্তনুকে বললো , “ এই শোন , চল সবাই মিলে একদিন শিশু পার্কে যাই ! “ এই বয়সে শিশুপার্ক যাওয়া উচিত হবে কিনা তা চিন্তা না করেই শান্তনু সায় দিলো । প্রমার গাড়ি আসবে ৪ টার দিকে । সে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তনু তার সাথেই থাকবে । ওর কাছে মনে হয় নিজের আপন বোনকে সে জীবনে যেহেতু পায় নি , তাই এই পর্যন্ত জমে থাকা সবটুকু স্নেহ সে প্রমাকেই দিবে ! প্রায় ৪ টার দিকে গাড়ি আসলে প্রমা চলে যায় । এটা রুটিনমাফিক হয়ে গেছে ।

প্রতিদিন শান্তনুর বন্ধুরা একসাথে যতক্ষন পারে চুটিয়ে আড্ডা দেয় , তারপর যে যার মত মায়ের ছেলে-মেয়ে হয়ে যায় ! মানে সবাই যার যার ঘরে ফিরে যায় । শুধু শান্তনু যায় না । তার পরিবার এই শহরে থাকে না । সবাই চলে যাওয়ার পরে তার মায়ের বলা কথাগুলো ওর কানে বাজে , “ শোন , বেশি বন্ধু জোগাড় করবা না । কারো সাথে ঝগড়া করবে না ।

রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে তর্ক করবে না । মানুষের অভিশাপ নেয়ার কোন দরকার নেই ! “ মা টা যে কি !! কিচ্ছু বুঝে না , বুঝে না , তার ছেলে এখানে একটা পরিবার গড়ে তুলেছে । সেখানে রোজ আড্ডা হয় , হাসি হয় , মারামারি হয় , দুঃখ পায় , আবার সেই হাসি সবার মাঝে বিলিয়ে আনন্দ পায় বা দুঃখ ভাগ করে সবাই মিলে মন খারাপের গান গায় ! আর শান্তনু কত্ত ভাগ্যবান । এখানে না আসলে কি সভব হতো এত্তো সুন্দর একটা পরিবেশ পাওয়ার । ঢাকার মানুষরা নাকি চার দেয়ালে বন্দি হয়ে আছে ।

তারা যান্ত্রিক হয়ে গেছে , যেখানে তাদের স্পর্শ করে না কোন আবেগ , হাসায় না কোনা আনন্দ , কাদায় না কোন দুঃখ ! কত্তো বড় মিথ্যে কথা ! মা’কে আসলে দেখানো দরকার ,” দেখো না , ঢাকার মানুষ যান্ত্রিক না । তারাও আবেগ ছোঁয় , তারা স্বার্থপর না , যখন ইচ্ছে তারাও ঝাপিয়ে পরে বন্ধুর জন্য , ভাইয়ের জন্য । কয়েকদিন পর পর শান্তনুর মাথায় নানা ভুতুরে চিন্তা আসে , যেমন ক্লাস আগে শেষ হয়ে গেছে । তো কি করা যায় ? কুবুদ্ধি বা আজাইরা চিন্তা ওর মাথায় ভালো খেলা করে । দেখা গেলো কারো জন্মদিন , জোড় করে খাবার আদায় করতে হবে ।

হঠাত করে শহরের এই মাথা থেকে সেই মাথায় চলে যেতে হবে । কেক কেটে বন্ধু দিবস উদযাপন করতে হবে , পরিক্ষায় কম মার্কস পেলে চাঙ্খারপুলে বিরিয়ানি খেয়ে সেই দুঃখ ভুলতে হবে ! শান্তনু কখনোই যায় না তার কোন বন্ধুরা কষ্ট পায় । সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে সবসময় তাদের পাশে থাকার , তাদের ভালোবাসার । এভাবে দিন চলে যায় , মাস চলে যায় , একসময় নতুন বছর শুরু হয়ে যায় । ঢাকায় আসায় স্থায়িত্বটা আস্তে আস্তে বড় হয় ।

শান্তনুর কাছে মনে হয় আস্তে আস্তে সব পালটে যাচ্ছে , পালটে যাচ্ছে তার চারপাশ , পালটে যাচ্ছে কাছের মানুষগুলো , শুধু মা বাদে । মা সেই আগের মতোই আগের কথাগুলোই বলে যান । শান্তনু চুপ করে শোনে আর মায়ের কথায় সাড়া দেয় । শান্তনু সবসময় চেষ্টা করেছে তার যেই বন্ধুদের পাশে থাকার , তার কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্টত হয় আসলে তারা তার কাছাকাছি নেই । শান্তনুর আবেগময় দিনগুলোতে তার পাশে কেউ থাকে না ।

সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে । প্রমার সাথে কথা প্রায় হয় না । যে যার নিজের কারণে ব্যস্ত , নিজের মতোন করে আনন্দ ফেরি করে বেড়ায় । কেউ তার খোঁজ নেয় না । শান্তনু আস্তে আস্তে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সবার সাথে ।

নিজেকে তার আজ বড় একাকী লাগে , অসহায় লাগে নিজের আগের ভাবনাগুলোকে । বোনের স্নেহ , ভাইয়ের ভালোবাসা যা ছিলো সব তার কাছে মেকি লাগে ! তার কাছে মনে হয় , যা ছিলো সব আলেয়া , যা ছিলো সব অধরা , যা ছিলো সব মিছে , যা ছিলো সব কল্পনা ! “ একদিন তার কাছে দিনা ফোন দেয় , বেশ অবাক হলো সে । অনেকদিন পরে দিনা তাকে ফোন করেছে । দিনা বললো , “ দোস্ত , জানিস নাকি প্রমার তো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । আগামী পরশু গায়ে হলুদ ।

চলে আসিস । আমরা তো ধুমাইয়া মজা করছি ! “ শান্তনু মনে মনে হাসে , যেই মানুষগুলোকে সে অতি বিশ্বাসে অনেক আপন করে নিয়েছে তারা তাকে একবার এটা জানালো না যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ওর বোনের । হতবাক হয়ে যায় শান্তনু । নিজের উপর কেমন জানি একটা রাগ জমে যায় এবার , ঘৃণা জমে যায় আবাগের উপর , পাথর হয়ে যায় চোখ দুটো । আস্তে আস্তে সে মাঠের দিকে যায় ।

ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় সে । এক ফালি চাঁদ হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে , চোখ টিপে দিলো কেমন যেনো । তারাগুলো যেনো তাকে আপন করে নিয়েছে , তাকে তাদের সঙ্গে নিতে চায় ! চাঁদের আলো গায়ে মাখছে শান্তনু আর খিলখিল করে হাসছে । তার অনেক আনন্দ লাগছে । এই কারণে যে সে সত্যিকারের বন্ধুর দেখা পেয়েছে , যে তার গায়ের জড়িয়ে দেয় স্নেহের পরশ , তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় হাজারো নাম না জানা তারা , তার সাথে পথ চলে এক ফালি চাঁদ ।

শান্তনু চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে , “ এই চাঁদ , এই তারা , তোরা কি আমার বোন হবি ?? তোরা কি আমার ভাই হবি ? তোরা কি আমার বন্ধু হবি ?? “ পাজি চাঁদটা মেঘের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তার কথায় যেনো সায় দিয়ে যায় ! শান্তনু সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়ে পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে মাঠের মাঝে !! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.