দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আরেক দফা কমে গেছে। গত সাত বছরের মধ্যে দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এখন সর্বনিম্ন।
২০১২-১৩ অর্থবছরের হিসাবে বাংলাদেশে এখন বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর আগে এর চেয়ে কম বিনিয়োগ ছিল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে, ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
দেশের বিনিয়োগ পরিসংখ্যানকে কোনো রকম ঠেকা দিয়ে রেখেছে সরকারি বিনিয়োগ।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন বাড়িয়ে জাতীয় বিনিয়োগের পরিসংখ্যানকে ঠিক রাখা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের জাতীয় বিনিয়োগ এখন ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগের হার ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বেসরকারি খাতনির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন হচ্ছে সরকারের ঘোষিত নীতি। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এই লক্ষ্যের কথা বলা আছে।
বর্তমান শিল্পনীতিতেও বেসরকারি খাতনির্ভর শিল্পায়নের কথা বলা আছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ সরকারের সময়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে।
বাজেট উপস্থাপনার দিন গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩’ প্রকাশ করেছে। সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে সামগ্রিক বিনিয়োগ বেড়েছে সামান্য।
ছিল ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ, হয়েছে ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সামান্য এই বিনিয়োগ বেড়েছে মূলত সরকারি বিনিয়োগের কারণে। যেমন সরকারি বিনিয়োগের হার জিডিপির সাড়ে ৬ শতাংশ বেড়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়েছে। মূলত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ও বাস্তবায়ন বাড়িয়ে সরকারি বিনিয়োগের অংশ বাড়াতে পেরেছে সরকার।
তবে সরকার ব্যয় বাড়ালেও বেসরকারি উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না।
এতে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। পাঁচ অর্থবছর ধরেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার ১৯ শতাংশের মধ্যেই ছিল। কেবল গত অর্থবছরে বেড়ে তা ২০ শতাংশ হয়। কিন্তু চলতি অর্থবছরে তা দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে, অর্থাৎ সেই সাত বছর আগের মতো ১৮ শতাংশের ঘরে চলে এসেছে।
২০০৯ সালে প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
সেই প্রতিশ্রুতির কথা তিনি নতুন বাজেট বক্তৃতায়ও উল্লেখ করেছেন। বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই তিনি ২০০৯ সালের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অংশে বলেছেন, ‘বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি, তখনকার স্থবির ২৪ শতাংশ থেকে অন্তত ৩০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। ’ কিন্তু কেন বিনিয়োগ এই পর্যায়ে বাড়ল না, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রী বাজেটে দেননি। তবে বর্তমানে বিনিয়োগ কেন কমছে, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান বছরে নির্বাচনী হাওয়ার কারণে বেসকারি বিনিয়োগকারীরা কিছুটা ইতস্তত করছে।
ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়তো কিছুটা হ্রাস পাবে। ’
বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতের জন্য এবার ঋণ সরবরাহে সাড়ে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঠিক করেছিল। কিন্তু গত এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি খাত ঋণ নিয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিনিয়োগ না বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে, দেশে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোর সমস্যা রয়েছে।
গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট আছে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
বিশিষ্ট উদ্যোক্তা, দেশের বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশন, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ এ বিষয়ে বলেন, ‘দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে আমরা, বেসরকারি খাত ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে নতুন করে ঋণ নিয়ে কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চাচ্ছি না। কারণ আমাদের বর্তমান বিনিয়োগই যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ জন্য নতুন বিনিয়োগের জন্য আমরা উৎসাহিত হচ্ছি না।
এতে ব্যাংকের তারল্য বাড়ছে। ব্যাংকগুলো এখন প্রচুর অলস অর্থ নিয়ে বসে আছে। ’
বিনিয়োগের পরিসংখ্যান: সাবেক বিএনপি সরকারের শেষ সময় ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৬ শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পরের দুই অর্থবছর, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মোট বিনিয়োগ কমে যায়।
যেমন, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হয়। আর বেসরকারি বিনিয়োগ ১৯ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে হয়েছিল ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০০৮-০৯ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের দায়িত্বে ছিল বর্তমান সরকার। এই অর্থবছরে বিনিয়োগ বেড়ে হয় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এ পরের অর্থবছরেও (২০০৯-১০) বিনিয়োগের হার ছিল একই রকম, ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এই অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ কিছু বেড়ে ৫ শতাংশ হলেও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ হয়।
দেশে বিনিয়োগের হার ৭টি অর্থবছর ধরে ২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে ছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ শতাংশ ২ শতাংশ হয়।
এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় বেশি, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে সামান্য, মাত্র দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পরের (২০১১-১২) অর্থবছরের বিনিয়োগের হার ছিল সাড়ে ২৬ শতাংশ। তবে এ সময়ে সরকারি বিনিয়োগ এক ধাপে এক শতাংশ বেড়ে হয় সাড়ে শতাংশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য: বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার সমর্থন পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যেও।
গত ৫ জুন পর্যন্ত সময়ে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানিতে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় তা কমেছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশে আমদানি ব্যয়ে সর্বশেষ ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০১-০২ অর্থবছরে, সাড়ে ৮ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে।
এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ২৭ শতাংশ বাড়লেও নিষ্পত্তি কমেছে ১৮ শতাংশ। তবে একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়েই কমে গেছে।
কর্মসংস্থানের কী হলো: প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকার ২০১৪ সাল নাগাদ প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন সদস্যের কর্মসংস্থান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ’ তবে শেষ বাজেটে এসে অর্থমন্ত্রী আর বলেননি, এই প্রতিশ্রুতি পূরণের কী হলো।
এ বিষয়ে এফবিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না।
প্রতিবছর ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি শ্রম বাজারে ঢুকছে। এদের মধ্যে ১০ লাখ বেসরকারি খাতে যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বিনিয়োগ না বাড়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। ’
একটা ইতিবাচক সূচক: গত ৪ জুন দেশে-বিদেশি মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ ছিল এক হাজার ৪৭৩ কোটি ২৯ ডলার। বিনিয়োগ মন্দায় দেশে আমদানি কমে গেছে, ফলে বাণিজ্য-ঘাটতি অনেক হ্রাস পেয়েছে।
কেননা, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে। এর পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার কারণেও রিজার্ভ বেড়েছে বলে অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।