মত প্রকাশের মুক্ত মাধ্যম তৈরী হোক
ভাল লাগল একটি লেখা......প্রথম অালোতে ছাপছে.........একরকম হঠাৎ করেই সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি ফ্যাক্সবার্তা ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। বার্তাটি এখনো বিস্মৃত না হওয়া সেনা নিয়ন্ত্রণাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কিছু আদেশ-নির্দেশকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সরকারের নির্দেশটি হুবহু এ রকম: ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক প্রচারিত দুটি জাতীয় সংবাদ বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলে বিনা মূল্যে প্রচারের শর্ত থাকলেও ইদানীং শর্ত লক্ষ করা যাচ্ছে যে, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসমূহ উক্ত শর্ত যথাযথভাবে পালন করছে না। এমতাবস্থায়, তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত অনাপত্তি পত্রের শর্তমোতাবেক বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালনানীতি ১৯৯৮-এর ৪(৪) ধারা অনুসরণপূর্বক বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রচারিত দুপুর ২.০০ ঘটিকার ও রাত ৮.০০ ঘটিকার বাংলা সংবাদ প্রাপ্তির পর হতে বিনা মূল্যে প্রচারের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। ’
বার্তাটি আতঙ্ক বয়ে আনারই কথা।
প্রথমত, একটি গণতান্ত্রিক সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। কেনই বা বেসরকারি চ্যানেলে সরকারি টিভির বুলেটিন প্রচার করা হবে? যেখানে সরকারি টিভির স্বায়ত্তশাসনের দাবি ঝুলছে, সেখানে সরকার কেন ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের ওপর আরও চেপে বসতে চাইছে? এমনকি অনির্বাচিত ও জরুরি অবস্থা জারি করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করেছিল, সে সরকারও ’৯৮ সালের নীতিমালা শিথিল করে বিটিভির সংবাদ প্রচারের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিয়েছিল। ২০০৭ সালের ৭ মে এই তথ্য মন্ত্রণালয়ই নোটিশ দিয়ে বলেছিল, ‘উক্ত বাধ্যবাধকতা পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত নির্দেশক্রমে শিথিল করা হলো। ’ সেই নোটিশই এখন অনুসরণ করছে টিভিগুলো। এ ক্ষেত্রে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পেরেছিল, গণতান্ত্রিক সরকার তাও বহাল রাখার মতো সাহস পাচ্ছে না! নীতিমালার দোহাই দিয়ে আবার নিয়ন্ত্রণের চোরাগলিতে ঢোকাতে চাইছে গণমাধ্যমকে!
আর নির্বাচিত সরকার যে নীতিমালার কথা বলে সরকারি সংবাদ প্রচারের নির্দেশ দিচ্ছে, সেই নীতিমালা কি সরকার নিজেই মানছে? ওই নীতিমালা না মানার উদাহরণের আগে দেখা যাক সেখানে কী বলা আছে: ‘সংবাদ প্রচারের জন্য বেসরকারি মালিকানাধীন চ্যানেল নিজস্ব প্রক্রিয়ায় মূল স্ক্রিপ্ট প্রণয়ন করতে পারবে।
তবে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালার প্রতিফলনসহ বিনা মূল্যে সরকারি প্রেসনোট, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। চ্যানেলকে বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক প্রতিদিন প্রচারিত ২ (দুই)টি জাতীয় সংবাদের যেকোনো একটি বিনা মূল্যে প্রচার করতে হবে। ’
দেখা যাচ্ছে, সরকার ১৬ সেপ্টেম্বর যে চিঠি দিয়েছে, তাতে দুটি সংবাদ প্রচার করতে বলছে আর নীতিমালায় বলা আছে, যেকোনো একটি সংবাদ প্রচার করতে হবে। এর পরের বিষয়টি হলো, ওই নীতিমালা মানতে হবে কেন? ১২ বছর আগে যে প্রেক্ষাপটে ওই নীতিমালা করা হয়েছিল, সেই বাস্তবতা এখন বিদ্যমান নয়। এ ছাড়া সরকার নিজেই বারবার নীতিমালা ভেঙেছে।
সর্বশেষ উদাহরণ হলো, ক্ষমতায় এসেই এই সরকার যে ১২টি চ্যানেলের অনুমতি দিয়েছে, তার কোনোটার ক্ষেত্রেই নীতিমালা মানা হয়নি। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। একই কাজ করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
সরকার যে নীতির দোহাই দিয়ে বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে বিটিভির সংবাদ প্রচার করতে বাধ্য করতে চাইছে, সেখানে স্পষ্টভাবে ‘বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আবেদন চাওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু ১২টি চ্যানেল অনুমোদন দেওয়ার আগে কোথাও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি।
দেখা যাচ্ছে, নিয়মনীতির যেসব অংশ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, সেগুলো বাস্তবায়নে সরকার এগিয়ে আসে আর যে অংশ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে ও গণতান্ত্রিক বিধি বিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সেগুলো উপেক্ষা করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১৯ ধারায় বলা আছে, ‘সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে। ’ ক্ষমতায় এসেই প্রধানমন্ত্রী তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, আমলারা তাঁকে বলেছিলেন, জোট আমলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুমোদনে অনেক অনিয়ম হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তাঁর সরকার কখনোই এ ধরনের অনিয়ম করবে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেই সম্প্রচারের অনুমোদন দেওয়া হবে।
কিন্তু ক্ষমতায় আসার দুই বছর যেতে না-যেতেই ভিন্নচিত্র দেখতে পাচ্ছি।
নির্বাচনী ইশতেহারের কথা ভুলে গিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এখন আবার সরকারের খবর প্রচার করার জন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে চাপ দিচ্ছে। সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, তিন বছর ধরে বিটিভির কোনো খবর বেসরকারি চ্যানেলে প্রচারিত হয়নি। এতে সরকারের কি ক্ষতি হয়েছে? বা এখন প্রচার করলে কী এমন লাভ হবে? বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
আর আগে বেসরকারি চ্যানেলে প্রচারিত হতো রাত সাড়ে ১১টার পাঁচ মিনিটের বুলেটিন। এখন সরকার চাইছে, রাত আটটার ৩০ মিনিটের বুলেটিন এবং বেলা দুইটার ১০ মিনিটের বুলেটিন। বেসরকারি টিভিগুলোর প্রাইম টাইমে সরকারি সংবাদ প্রচারের এ ধরনের নির্দেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সংবাদও একেবারে সরকারের কর্মকাণ্ডমুক্ত নয়। সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর নানা কর্মকাণ্ডের খবর প্রায় প্রতিদিনই ভালো একটি অংশ দখল করে আছে এসব বুলেটিনে।
এসবের পর দর্শক আবার বিটিভির সংবাদ যে দেখতে চাইবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নীতিমালা অনুসারে বেসরকারি চ্যানেলগুলো আয়কর পরিশোধ করে আসছে। তার ওপর প্রাইম টাইমে দুটি বুলেটিন মিলিয়ে ৪০ মিনিট সময় যদি সরকারকে বিনা মূল্যে দিতে হয়, তার আর্থিক ক্ষতি কত, তা কি বিবেচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা? কেন অতিরিক্ত এই ক্ষতির বোঝা বইতে হবে বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে?
সরকারের এমন আচরণ আবারও বেসরকারি চ্যানেলের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের দাবিটি প্রবল করে তুলছে। ’৯৮ সালের যে নীতিমালা আছে তা চূড়ান্ত নয়। সরকারের এখনই উচিত সেটি চূড়ান্ত করা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ’৯৮ সালের নীতিমালাটি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তথ্য মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন নীতিমালা’ নামের একটি খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বেঠকে উত্থাপন করে। উপদেষ্টা পরিষদ খসড়াটি আরও সংযোজন করে পুনরায় উত্থাপন করার কথা বলে। পরে আর বিষয়টি এগোয়নি। বর্তমান সরকার নীতিমালা তৈরির কাজে হাত দিয়ে আবার পিছিয়ে গেছে।
গত মে মাসে তথ্যমন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের জন্য দুটি খসড়া নীতিমালা রয়েছে। সাংবাদিক-নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। তথ্যমন্ত্রী এরপর তা না করে ফ্যাক্সযোগে বিটিভির সংবাদ প্রচারের নির্দেশ পাঠালেন। সরকারপ্রধানের কাছে আবারও অনুরোধ, ভালো-মন্দের সব দায়দেনা যেহেতু আপনার, তাই সরকারের ভাবমূর্তি উন্নত হবে ও সরকারকে শক্তিশালী করবে—এমন পরামর্শ গ্রহণ করে দ্রুত ‘বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন নীতিমালা’ চূড়ান্ত করুন।
জায়েদুল আহসান: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।