আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবাল দ্বীপ (কোরাল আইল্যান্ড) থেকে হোটেল দ্বীপ (হোটেল আইল্যান্ড)

সেন্ট মার্টিন্স আইল্যান্ড এখন আর সেই আইল্যান্ড নেই। মুখরোচক জীববৈচিত্র্য শব্দকে পুঁজি করে পরিবেশ ও বন বিভাগ যদি কথিত পরিবেশ ও প্রাণিবিজ্ঞানিদের নিয়ে দ্বীপের ধ্বংস সাধনে মত্ত হয়ে থাকেন তাহলে বলা যেতে পারে তাঁরা সার্থক হয়েছেন শতগুণ বেশি। বালু, প্রবাল আর পাথরসমৃদ্ধ দ্বীপটিকে পুঁজি করে ভিক্ষুকের মতো গ্লোবাল এসভায়রনমেন্ট ফান্ড (জি.ই.এফ.) থেকে যা পাওয়া যায় তাই সাহায্য নিয়ে এসেছিলেন। তবে জি.ই.এফ.-এর সাহায্য সাধারণত কোটি ডলারের নিচে হয় বলে আমি শুনিনি। গত ১ সেপ্টেম্বর-এর প্রথম আলোর শক্তিমান রিপোর্টার ইফতেখার মাহমুদের রিপোর্টে জানা গেল, দ্বীপটি নাকি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিকালি ক্রিটিকাল এরিয়া, ইসিএ) এবং সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্র হওয়ায় দালান-কোঠা নির্মাণ নিষিদ্ধ, অথচ পাঁচ কিলোমিটারের এ ছোট দ্বীপে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে ৩৫টি হোটেল।

দ্বীপটি এখন হোটেল দ্বীপ। এসব স্থাপনার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন বা পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থ হয়েছে বললেও ভুল বলা হবে, বরং নিজেদের জন্যে তৈরি বিলাসী বাংলোটি পর্যন্ত ব্যবহারে ব্যর্থ হয়েছে, পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিয়ে চালানোর জন্যে ক্ষমতাশালী কারো কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হয়েছে। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে কাছিম ডিম পাড়ে তার সচিত্র নিবন্ধ সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকেই আমিসহ আরও দুজন শিক্ষক প্রাণিবিজ্ঞান জার্ণালে প্রকাশ করেছিলাম। এরপর থেকে কাছিমদরদীর অভাব হয়নি, ভূয়া-অভূয়া সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কাছিম গবেষণায়।

গার্মেন্টস শিল্পের সেলাই কারখানা যেভাবে প্রথম দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছি্ল পাড়া-মহল্লায়, ঠিক তেমনি কাছিম গবেষকদেরও ঘাটতি পড়েনি। আমরা ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মাছের ট্রলারে করে দ্বীপে পৌঁছে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের বালুমাখা মেঝেয় দিনে ঘুমিয়ে সারারাত দ্বীপের বেলাভূমিতে যেভাবে এবং যে সব জায়গা ঘুরে কাছিমের ডিম পাড়া রেকর্ড করেছি তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আছে, লেখার ক্ষমতা নেই। একদিকে প্রচন্ড ঠান্ডা, অন্যদিকে খাদ্যাভাব, চারদিকে হাহাকার, সান্তনা ছিল শুধু কম দামে বিরাট বিরাট ডাব খাওয়া, প্রতিরাতে দু’একটি কাছিমের ডিম পাড়া দেখা, ডিমচোর সোনাইয়ার কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করা, আর দুদমিয়ার দোকানে খাবারের অর্ডার দিয়ে রাখা। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে আমরা ওই দ্বীপে ৩-৪দিন করে নির্ঘুম কাটালেও প্রতি রাতে গড়ে ৪টির বেশি কাছিম ডিম পাড়তে দেখিনি। সর্বোচ্চ দেখেছি একরাতে ৯টি কাছিম।

তখনই এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, কাছিমের সংখ্যা দিন দিন কমে এসেছে। সে সময়কার ডিম পাড়ার উঁচু জায়গাগুলো, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, দুদমিয়ার দোকান ইতোমধ্যে সাগরে বিলীন হয়েছে। অথচ এর পরেও সরকার কাদের পরামর্শে এ দ্বীপে কাছিমের গবেষণার কথা বলে গবেষণা দান সংগ্রহ করেছে জানি না। এসব পরামর্শদাতা কি বিজ্ঞানী না ভিক্ষুক? বন সংরক্ষণের নামে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প করেছিল, পরে সেটি আইপ্যাক নাম ধারণ করেছে। ফল কী হয়েছে, বন আরও ধ্বংস হয়েছে।

সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপকে কাছিম গবেষণা কেন্দ্র করতে চেয়েছে, সেটি হয়েছে অবকাশ কেন্দ্র। প্রথম আলোর রিপোর্টে সামুদ্রিক গবেষণা ইন্সটিটিউটের উল্লেখ আছে, অথচ এ প্রতিষ্ঠান কখনও দ্বীপ এলাকার গবেষণাধর্মী কাজ করেনি। অন্যদিকে, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা শুধু লোকমুখে শুনে বন ও বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। বেলা এবং ডব্লিউটিবি দুজনে মিলে বন্যপ্রাণী আইন করেছে, সংসদে পাশ হওয়ার পড় বেলা আবার ওই আইনের প্রতিবাদ করছে। বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে বেলা-র অনেক জানার ঘাটতি আছে।

জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প ও অবৈধ জমি ভরাটের বিরোধিতা ছাড়া পরিবেশ সংক্রান্ত আর কোনো কাজে বেলা সফল হবে বলে মনে হয় না। আমি বরং পরিবেশ অধিকপ্তরের মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানাবো তাঁর সঠিক মন্তব্যের জন্য। যেহেতু সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না, তাই দ্রুত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রবাল দ্বীপের বদলে এটিকে পর্যটন দ্বীপ ঘোষণা দিয়ে দ্বীপের দখল বাংলাদেশের হাতে রাখার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপকে স্থায়ী ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন দ্বীপ হিসেবে গড়ে তুলতে এখন যা প্রয়োজন তা হচ্ছেঃ ১. দ্বীপের চারপাশে অগভীর-গভীর পানির প্রবাল রক্ষায় যথেষ্ট সংখ্যক চৌকষ কোস্টগার্ড নিয়োগ দেওয়া। দ্বীপের বিজিবি কাম্পকে আরও শক্তিশালী করা।

২. স্থলভাগেই কোথাও একটি সুরক্ষিত ও সুরম্য স্থাপনায় (এটি পরিবেশ অধিদপ্তরের কথিত পরিত্যক্ত গবেষণা কেন্দ্রটি হতে পারে) শিক্ষামূলক প্রবাল জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা। ৩. মেরিন পার্ক ও ডাইভের ব্যবস্থা করা। কোনা প্রাইভেট কোম্পানীকে ইজারা হিসাবে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। ৪. বাংলাদেশের সামুদ্রিক কাছিমের প্রজাতি ও ডিম পাড়ার দৃশ্যাবলী বর্ণনাসহ ভিডিও প্রদর্শনী ও বিক্রি। ৫. দ্বীপের উদ্ভিদ ও মাছসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের (সামুদ্রিক মাছ ও স্তন্যপায়ী) সচিত্র বর্ণনাসহ ভিডিও বই-পুস্তকের প্রদর্শনী ও বিক্রি।

৬. বিদেশি পাখি দেখার জন্যে বিশেষ সপ্তাহের আয়োজন করা (ডিভিডি ও বই-পুস্তাক বিক্রিসহ)। ৭. প্রকৃতি ও জীবন রক্ষার উদ্দেশে নিবেদিত প্রাণ কিছু কর্পোরেট সংস্থার কার্যক্রম ও পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা। ৮. ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎসাহিত করার উদ্দেশে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কার প্রাপ্তদের জীবনী চলচচিত্রাকারে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। ৯. নৌ-রেস্তোরায় ভ্রমণ এবং উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত টাটকা মাছের নতুন নতুন রেসিপি পরিবেশন করা। ১০. শিক্ষার্থিদের বিশেষ প্যাকেজ চালু করা।

পর্যটন দ্বীপে সাতদিন কাটিয়ে গেলে বছরের বাকি সময়টা যেন রোমন্থনে করতে করতে চলে যায় এমন ব্যবস্থা (নিরাপত্তা+আহার+চিকিৎসা) নিশ্চিত করতে পারলে এ পর্যটন দ্বীপ বিশখ্যাত হয়ে উঠতে সময় লাগবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.