খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো... সমুদ্রসীমা : বিরোধ নিষ্পত্তিতে মেরিটাইম ল‘
হাসান কামরুল
আন্তর্জাতিকভা্বেই মুদ্রসীমা বিরোধ দিনদিন প্রকট হচ্ছে । ৫০টিরও বেশি দেশে সমুদ্রসীমা বিরোধ চলমান। এবং চলমান বিরোধ মীমাংসার্থে শতাধিক মামলা হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতে। সম্প্রতি জাপান ও চীনের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশ দুটি মতানৈক্যে পৌছাতে ব্যর্থ হয়েই শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্হ।
এর পিছনের কারণটা অবশ্য দুদেশের মধ্যস্হ সমুদ্র অঞ্চলের বিরোধপূর্ণ দ্বীপসমুহ। এখন দু‘দেশই আন্তর্জাতিক আদালতের দিকে তাকিয়ে আছে। আদালত থেকে রায় যার পক্ষেই যাবে তাদেরকেই নতুন করে সমুদ্রসীমা নির্ণয় করে নতুন করে মানচিত্র প্রস্তুত করতে হবে।
সম্প্রতি এক গবেষনায় দেখা যায় পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত ঝামেলা রয়ে গেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বিবাদমান সমুদ্রসীমা কখনোই জাতিয়তার কারণ হয়ে দাড়ায়নি।
অর্থাৎ জাতিয়তার দোয়াই দিয়ে দখল পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটেনি। যা ইতিবাচক এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করছে বলেও বিশ্লেষকদের আশাবাদ। বিরোধপূর্ণ দেশেসমুহ সমুদ্রসীমা নির্ধারণে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণও চলছে সমানতালে । বিবাদমান দেশসমুহ আইনি লড়াইয়ে জিতে আসার লক্ষে মাল্টি মিলিয়ন ডলার খরচা করে আইনঙ্ঘদের নিয়োগেও পিছিয়ে । পুরোণো ম্যাপ ঘষেমজে বা সমুদ্রাঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উপর যুক্তিপুর্ণ দাবি উপস্হাপনের মধ্য দিয়ে নিজেদের দাবিকে জোরালো করার টেকসই লড়াইয়ে টিকে থাকার যুক্তি দাড় করিয়ে বৈতরনি পারি দিতে হবে।
১৯৮২ সালে টঘঈখঙঝ এ স্বাক্ষর করা রাষ্ট্রসমুহ সমুদ্রতীর বা শোর লাইন থেকে কোস্টাল এরিয়া বা সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের ১২ নটিকেল মাইল বা ২২ মাইল পর্যন্ত নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে। এবং এ দাবি অনুযায়ী তারা নিজেদের ম্যাপ প্রস্তুত করতে পারবে কিন্তু কোনক্রমেই সমুদ্রাঞ্চলের সুগভীর এলাকা বা আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের এলাকে নিজেদের বলে দাবি তুলতে পারবেনা। কারণ জাহাজ চলাচলের রুটকে আন্তর্জাতিক বা ইন্টারন্যাশনাল রুট হিসেবে গন্য করা হয়। কোন দেশই ইন্টারন্যাশন্যাল রুটে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কোনরুপ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবেনা।
শোর লাইন অর্থাৎ ১২ নটিকেল মাইল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বা ঊঊত হিসেবে গন্য করা হয়।
এবং যেকোন দেশ তাদের দাবিকৃত সমুদ্রসীমা অঞ্চলের অধিকতর অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত সমুদ্র সম্পদের উপর তাদের মালিকানার দাবি ন্যায়সঙ্গত বলে পরিগণিত। যখন দুইটি অধিকতর অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমানা নিয়ে দুইটি দেশের একই দাবি থাকে তখন টঘঈখঙঝ এ মীমাংসার্থে ইক্যুয়িটি ডিসটেন্স (বয়ঁরঃু ফরংঃধহপব) লাইন টেনে সমস্যা সমাধানের কথা বলা আছে । ইক্যুয়িটি ডিসটেন্সে সমুদ্রসীমা অঞ্চলের ভাগাভাগিতে বা উপসাগরের যৌথ মালিকানা বা প্রণালীকে মাঝ বরাবর ধরে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দ্বিখন্ডিত করে । কিন্তু এ নিয়েও রয়েছে মতপ্রার্থক্য কেননা ইক্যুয়িটি ডিসটেন্সের লাইন বরাবর যেসমস্ত দ্বীপ, শীলা এলাকা, প্রবাল অঞ্চল, ঐতিহাসিক স্হানসমুহ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ স্হান সমুহ পড়ে তা পৃথকীকরণে কোন না কোন পক্ষ আপত্তি উঠছে। ফলশ্রুতিতে ইক্যুয়টি ডিসটেন্স‘র লাইনকে ঘুরিয়ে দিতে হয়, যা পরবর্তীতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে ।
কারণ এ ধরনের কৌশলগত সমাধান নিয়ে কোন না কোন পক্ষের মতবিরোধ স্পষ্ট হতেই পারে।
গেল মে মাসে হেগে অবস্হিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে নিকোরোগুয়া ও কলম্বিয়ার মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তিতে আদালত কার্যক্রম শুরু করে । কলম্বিয়া ১৯২৮ সালের ট্রিটি বা চুক্তির ধোয়া তুলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে নিজেদের দখলের যুক্তি পুণরুদ্ধারের চেষ্টা করছে অন্যদিকে নিকারোগুয়া কলম্বিয়ার যুক্তিকে াড়রফ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ নিকারোগুয়ার যুক্তি হচ্ছে ১৯২৮ সালে করা ট্রিটি বা চুক্তি ছিল আমেরিকার পক্ষে। তাই কোন ক্রমেই কলম্বিয়া এ দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের দখলে নিতে পারেনা।
এ মামলার শেষাংশে ছোট্র স্যান্ডব্যাংক ছঁরঃধংবঁহড় কে কোর্ট থেকে দ্বীপের মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং এও বলা হয়েছে ছঁরঃধংবঁহড় কলম্বিয়ার অংশ । পরবর্তীতে কোর্ট যখন বসবে তখন ঈধৎরননবধহ ওংষধহফং নিয়ে মামলার রায় হতে পারে। সেপর্যন্ত বিবাদমান দুটি দেশকেই শান্তিপূর্ণ অবস্হান গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও সমুদ্রসীমা বিরোধ রয়েছে। এবং দুটি দেশই আন্তর্জাতিক আদালতে মীমাংসার জন্য শেষ ভরসা রাখতে চাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে তেলসমৃদ্ধ ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ এলাকে নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মতদ্বৈরতা। ইক্যুয়িটি ডিসটেন্স বা সমদূরত্ব লাইন টেনে সমস্যা সমাধানে টঘঈখঙঝ এ যা বলা হয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশের মতবিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশ চাচ্ছে হঁধহপবফ বাউন্ডারি, যা হবে সমুদ্রগভীরের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ংধহফনধহশ দ্বারা কিন্তু ভারত তা মানতে নারাজ। কারণ ভারত মনে করছে এতে করে বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ এলাকা তাদের হাত ছাড়া হবে। ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা দাবির মীমাংসার জন্য ২০১৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইনি মোকাবেলায় দীর্ঘসূত্রিতা মেরিটাইম ল‘র প্রতি আস্হা কমিয়ে দিচ্ছে বলে আওয়াজ উঠছে। উদাহরণস্বরুপ বাহরাইন ও কাতারের মধ্যে বিবদমান সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসায় ওঈঔ তে ১২ বছর কেটে গেছে। এখন পর্যন্ত মামলার রায় হয়নি। কাতার এ ১২ বছরে ৮১টি ম্যাপ প্রস্তুত করে ওঈঔ তে দাখিল করেছে। যার প্রায় সবক‘টি ম্যাপই ভুয়া বলে সন্দেহ করা হচ্ছে ।
কিন্তু মামলার রায় না হওয়াতেই দুদেশের মধ্যেই হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিতে ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁঃরপব আর্বিট্রেশনের স্হায়ী আদালত বলে বিবেচিত । ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞৎরনঁহধষ ভড়ৎ ঃযব ষধি ড়ভ ঃযব ংবধ আদালতটি কেবল আইসিজে‘র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। যদিও জাপান ও চীনের মধ্যে চলমান বিরোধে জাপান আন্তর্জাতিক আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এবং আদালতের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আদালতের উপর জাপানের ভরসা কমছে বলে জাপান হুশিয়ার করে দিয়েছে।
কিন্তু তারপরও সমুদ্র গবেষকদের মতে আদালতই হচ্ছে সর্বোচ্চ জায়গা, যেখান থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলাফল আশা করা যায়। যদিও কোন কোন মামলার ফলাফল পেতে একযুগের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে তবু অপেক্ষা যুদ্ধ থেকে শ্রেয় বলে বিবাদমান দেশসমুহ পক্ষান্তরে মেনে নিচ্ছে। এবং আদালত সবসময়ই যুদ্ধ থেকে সাশ্রয়ী এ ব্যাপারেও কারো কোন দ্বিমত নেই।
পৃথিবীজুড়েই সমুদ্রসীমা বিরোধ শুরু হয়েছে। আর এ জন্যই এ সংক্রান্ত আন্তার্জাতিক আদালতের পরিধিও দেশে দেশে বিস্তৃত লাভ করবে বলে বিশেষঙ্ঘদের ধারনা।
তাই সমস্ত পৃথিবীই এখন আদালতের দিকে মুখিয়ে আছে। পৃথিবী যুদ্ধ চায়না, চায় শান্তি। তাই আদালত থেকেই শান্তিময় সমাধান বের করা সম্ভব । আর সেই সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দুনিয়ার মানুষ।
হাসান কামরুল: ভূতত্ত্ববিদ ও কলামলেখক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।