আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের অজ্ঞতা ও একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু!

আপনি আমাকে পছন্দ করেন কি করেন না তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আপনাকে খুশি করার জন্য আমি এ পৃথিবীতে আসিনি। মনে করেন আপনাকে রাস্তায় একজন লোক থাপ্পড় দিল, আপনি কি করবেন? ধরুন আপনিও তাকে ঘুরিয়ে থাপ্পড় দিলেন। কিন্তু আপনি যদি ডাক্তার হন তাহলে সবাই বলবে, ডাক্তার থাপ্পড় দিছে! শালা একটা কসাই! হ্যাঁ, অনেক ডাক্তার আছেন যারা অনেক বেশি নাম করে ফেলেছেন, তখন তারা খারাপ হয়ে যান। কিন্তু এইসব ইন্টারনিরা মাত্র পাশ করেছে, এদের টাকার মায়া নেই, এটলিস্ট এদের বুকে সাহস আছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। ঢাকা মেডিকেলে তৃতীয় আর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা যেখানে দিনের পর দিন ওষুধ চুরি করছে, বিভিন্ন কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে রোগীদের থেকে টাকা নিচ্ছে, সেখানে অনেক ইন্টারনি নিজের পকেটের টাকা দিয়ে রোগীকে ওষুধ কিনে দেয়, ব্লাড লাগলে নিজে ফোন করে সন্ধানী থেকে যোগাড় করার ব্যাবস্থা করে দেয়, অথবা নিজেই ব্লাড দেয়, চাঁদা তুলে রোগীর ডায়াগনোসিসের ব্যাবস্থা করে দেয়।

বাইরে থেকে যে যাই বলুক, ঢাকা মেডিকেলে কোন গরীব রুগী আসলে তারা ইন্টারনিদের উপর অনেক ডিপেন্ড করে। এইসব রক্তগরম ইন্টারনিরাই তখন তাদের সাহায্য করে। ২৪-২৫ বছর বয়সী এসব তরুণ ইন্টারনিরা হয়ত আপনার আমার ভাই/বোন। ঢাকা ভার্সিটি, বুয়েট, জাহাঙ্গির নগরে কি মারামারি হয় না? এদের আপনি একটা কিছু করে পার পাবেন? ঢাকা মেডিকেলের ইন্টারনিরা তো তাদেরই বয়সী, তাই না? ২৪-২৫ বছর বয়সী এইসব নিঃস্বার্থ তরুণদের কসাই বলে গালি যে দিচ্ছেন একবারো ভাবে দেখেছেন তাদের কেমন লাগে বিনা দোষে এসব শুনতে? বুয়েট, ঢাকা ভার্সিটি থেকে শুরু করে দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানেই তো জনগণের টাকা দিয়ে পড়ানো হয়, তবুও শুধু মেডিকেলের এই ছেলে মেয়েগুলোকেই কেন টাকার কথা বলে বলে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়? কেউ তো তাদের দয়া করে পড়াচ্ছে না, এই দেশের সরকার বেছে বেছে তার সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলোকে পাব্লিক প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছে। ইন্টারনিরা তো এখনও টাকা ইনকাম শুরুই করল না, আর এদের কসাই ডেকে ডেকে নিজের অজান্তে আমরা এদের মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি বিষ।

এদের কি মন খারাপ হয় না? কেন তাদের স্বাভাবিক মানুষের মতো মনে করা হচ্ছে না সমাজে? একই বয়সী বুয়েট অথবা প্রাইভেট ভার্সিটির একটা ছেলে/ মেয়ে যখন রাতের বেলায় ফোনে প্রেমালাপে মত্ত থাকে, ঠিক ওই সময় এই ইন্টারনিগুলো ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নির্ঘুম রাত পার করে। যাইহোক, এদের মনে বিষ ঢুকাতে থাকেন। যে দেশে মেধাবীদের কদর করা হয় না, সেই দেশে নাকি মেধাবী জন্মায় না। এখন এই ইন্টারনিরাই যদি রাগ করে পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যায় বা টাকা ছাড়া আর কিছু না বুঝে- আমি অন্তত তাদের আর দোষ দিতে পারব না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, যে রোগীকে নিয়ে এত কাহিনী তাকে কিন্তু কিছুই করা হয় নি।

সে ১৫-২০ দিন চিকিৎসা নিয়ে নিরাপদে তার বাসায় ফেরত গিয়েছে। আমি অবাক হই ভেবে যে এতকিছু পরও তার গায়ে কেউ হাত দেয়নি! আজ যদি ঢাকা ভার্সিটি বা অন্য কোন পাব্লিক ভার্সিটি হত তাহলে মেরে হাড় গুড়ো করে দিত ওইখানকার ছেলেরা। এখানেই মনে হয় ঢাকা মেডিকেলের ইন্টারনিদের সাথে অন্যদের তফাত। লেখাটা শেষ করি গল্পের মাধ্যমে একটি সত্য ঘটনা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে, সংগত কারণেই গল্পের চরিত্রগুলার নাম পরিবর্তিত। ঘটনাটা আজ থেকে ৩-৪ বছর আগের।

সফিক, রাজু আর শম্পা একসাথে মেডিকেলে পড়ে। সবে মাত্র তারা থার্ড ইয়ারে উঠেছে, আর থার্ড ইয়ারে উঠলেই ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট থাকে। খুশিতে সবাই মিলে স্টেথ আর বিপি মেশিন কিনল। ওয়ার্ডে যাবে তারা, একটা ডাক্তার ডাক্তার ভাব সবার মধ্যে! ওয়ার্ডে প্রথম দিন স্যার তাদের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিল, সবাই খুব মনযোগ দিয়ে শুনল। তবে ছেলেরা খুব বিরক্ত হল যে, তাদের নাকি স্যান্ডেল আর জিন্স-টি শার্ট পরা চলবে না।

এসব নাকি ডাক্তারদের পোশাক না! ডাক্তারি করতে হবে মেধা দিয়ে, এর সাথে পোশাকের কি সম্পর্ক অনেকে ভেবেও তারা বের করতে পারল না। যাইহোক কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা বুঝতে পারল পড়ালেখার চাপ কাকে বলে। একদিকে একাডেমিক পড়ালেখার চাপ, অন্যদিকে ওয়ার্ডে স্যারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে রোগীদের সামনে বিব্রত হওয়া! তবুও তারা মনে মনে এইভেবে মজা পেত যে অন্য ওয়ার্ডের স্যাররা নাকি আরো কড়া। সফিক, রাজু আর শম্পা মোটামুটি পড়ালেখার সব কিছুই একসাথে করে। একদিন একটা পেসেন্টের একজামিনেশন করে সফিক আর রাজু শম্পাকে বলছে যে, "তুই দেখ এবার।

" শম্পা বলছে, "না, আমার আর দেখা লাগবে না। চল যাইগা। " রাজু আর সফিক অনেক অবাক হল। শম্পা অনেক মনোযোগী, একেবারে আঁতেল বললেও কম বলা হয়, সে এমন করছে কেন? ওরা আরেকবার বলল, "আরে এটা ওয়ার্ড ফাইনালে আসবে তো, দেখবি না কেন?" শম্পা ঝাড়ি মেরে বসল, "বললাম তো দেখব না, এত কথার কি আছে? তোরা আসবি? নাকি আমি একাই যাব? আমি সকালে নাস্তা করতে পারিনি। " ওইদিন আর তেমন কিছু হল না।

সবাই ক্লাস শেষে যার যার হলে চলে গেল। সফিক বরাবরই একটু ফুর্তিবাজ টাইপের, সব কিছুতেই ফাজলামী করে। সে রাতে শম্পাকে ফোন করে বলল, "কিরে হেব্বি পার্ট নিলি আজকে। সব পড়া শেষ নাকি? একেবারে পেসেন্ট টাচ করা লাগে না তোর!" জবাব না দিয়ে শম্পা কেঁদে ফেলল। সফিক হতভম্ব, এই মেয়েটার থেকে আজীবন গালি আর ধমক শুনে অভ্যস্ত সে।

শম্পা সফিককে ওয়াদা করাল, "তুই প্রমিস কর যে তুই রাগ দেখাবি না বা আর কাউকে এই কথা কোনদিন বলবি না। " এরপরে শম্পা সফিককে যা বলল তা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। শম্পা বারবার বলছিল, "দোস্ত একজন মানুষ কিভাবে এত খারাপ কথা বলতে পারে একটা মেয়েকে? ওই পেসেন্ট কিভাবে আমাকে এটা বলল?" সফিক এমনিতে হাসিখুশি হলেও রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে যায়, ক্লাস এইটে থাকার সময় এক ক্লাসমেটকে খালি হাতে পিটিয়ে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল মা তুলে গালি দেয়ায়। আর সেই সফিক আজ ফোন হাতে নিয়ে রাগে কাঁপছে। তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই।

আজ যদি মেডিকেলে না পড়ে অন্য কোথাও পড়ত তাহলে ওই শালার হাত পা ভেঙ্গে দিত সে। হঠাত করে নিজের এত কষ্ট করে চান্স পাওয়া এই মেডিকেলকে ফালতু মনে হতে শুরু করল। তীব্র আক্রোশে চিৎকার করতে ইচ্ছে করল তার। সফিক তার কথা রেখেছে এতদিন। শম্পার ওই কথা তখন সে কাউকে বলেনি, এমনকি রাজুকেও না।

রাজু গোবেচারা ধরনের অত্যন্ত ভাল মানুষ টাইপ ছেলে। সে এসবের কিছুই বুঝল না, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল তার অতি পরিচিত বন্ধুটি আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। অনেকদিন পর পর লিখি তো তাই লেখা অনেক বড় হয়ে যায়। তারপরও যারা কষ্ট করে পড়লেন তাদের ধন্যবাদ। আমার খুবই প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ আজ আর নেই, তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রইল।

আর দেশের সবার জন্য রইল শুভ কামনা। এই দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। আশা করি একদিন আমরা পৃথিবীর বুকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাড়াব। এই জন্য সবাইকে সব বিভেদ ভুলে দেশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। সবাইকে শুভেচ্ছা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.