আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ কোন না কোনভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তা করেছেন অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তবে ওই ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ বায়ান্ন সালে হলেও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে অনেক আগে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে মূলত পাকিস্তানি রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিমাতাসুলভ ঘোষণার ফলে। আর এ ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে।

ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ছাত্র-জনতা ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ জিন্নাহ সাহেবের এ ঘোষণার প্রতিবাদে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কিছুটা রূপ আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি রাজশাহীতে গিয়ে। সেটা ছিল নভেম্বর মাস। হঠাৎ খবর পেলাম আমার জ্যেষ্ঠপুত্র এসএম নুরুল আলম (তখন রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে মারাÍকভাবে আহত হয়েছে। ১৯ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহী সফরে এলে ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেয় এবং বিরাট শোভাযাত্রা বের ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

নুরুল আলম তাতে অংশ নেয় এবং সরকারি গুণ্ডাবাহিনীর হাতে আরও অনেকের সাথে মারাÍকভাবে জখম হয়। আহত পুত্রকে দেখার জন্য আমি রাজশাহী পৌঁছার পর রাজশাহীর আন্দোলনরত ছাত্ররা এক বিশাল সমাবেশে জমায়েত হয়। পাকিস্তানি শাসকচক্র যে এক মারাÍক দুরভিসন্ধি নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ন্যায্য অধিকার পদদলিত করার তৎপরতায় লিপ্ত হতে যাচ্ছে তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এবং তারই প্রথম আঘাত বাংলা ভাষার ওপর। সেদিন সেই সমাবেশে আমি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সারবত্ত্বা তুলে ধরে বক্তৃতা করেছিলাম, ছাত্ররা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের যে আন্তরিকতা ও আবেগময়তার পরিচয় দিয়েছিল তা আমাকে তখন রীতিমতো আশান্বিত করে তোলে। আমার ধারণা জšে§ এই পৃথিবীর কোন শক্তিই বাংলা ভাষার কাংক্ষিত মর্যাদা ক্ষুণœ করতে পারবে না।

বাংলা ভাষার এ আন্দোলনে ছাত্র যুবসমাজ পালন করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সরাসরি ছাত্র যুবসমাজের সাথে না থাকলেও যাদের নাম জেনেছি তাদের মধ্যে খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, এসএম নুরুল আলম, আজিজ আহম্মদ, আবদুল আউয়াল প্রমুখের নাম এ মুহূর্তে স্মরণ করছি। আমি তখন পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের সদস্য। কিন্তু ২০ ফেব্র“য়ারিতেই সরকার ঢাকায় জারি করে ১৪৪ ধারা। জনসভা মিছিল, মিটিং ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন করা হয় পুলিশ ও মিলিটারি। এরই মধ্যে বেলা ২টার দিকে এসেম্বলি হাউসে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টরি পার্টির সভা বসে। আমার মনে পড়ে একুশে ফেব্র“য়ারি পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়। তখন বাইরে অবিরাম রাইফেলের গর্জন, কিন্তু কোন মন্ত্রী কিংবা পরিষদ সদস্যের ভেতরেই দেখলাম যেন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারও কোন উদ্বেগ নেই।

মাঝে মাঝে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস, শেলবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দে আমি শিউরে উঠেছিলাম। এক সময়ে হাউস থেকে বেরিয়ে আসি, দেখি রাজপথ জনশূন্য। রাইফেল ও লাঠি হাতে স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ। আমি মেডিকেল কলেজের দিকে অগ্রসর হলাম। কলেজের কাছাকাছি এসে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে অশ্র“ সম্বরণ করতে পারিনি।

ছাত্ররা চিৎকার করছে দূর থেকে তারা গলা ফাটিয়ে আইন সভার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, বেরিয়ে এসে অবস্থা দেখার জন্য, আহত ছাত্ররা আর্তনাদ করছে। কারও কারও কাপড়ে ফেনাযুক্ত তাজা রক্ত, দেখতে পেলাম, বহু ছাত্র হতাহত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে আমার সক্রিয় রাজনীতির চল্লিশ বছরের জীবনে হাসপাতালের অভ্যন্তরে পুলিশের গুলিবর্ষণের এমন ঘটনা আর দ্বিতীয়টি দেখিনি, মর্মান্তিক এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলাম না। হাউসের কাছে প্রতিবাদ জানানোর জন্য অবস্থা বিবৃত করার জন্য ছুটে এলাম এসেম্বলি হাউসে। বিকাল তখন ৩টা ৩০ মিনিট, স্পিকার আবদুল করিম আসন গ্রহণ করলেন।

আমি তখন উঠে দাঁড়ালাম স্পিকার, প্রশ্ন উত্তরের আগে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। ভবিষ্যতের আশা ভরসা দেশের ছাত্ররা যখন পুলিশের গুলিতে জীবন দিচ্ছে, তখন আমরা এখানে বসে সভা করতে পারি না। আমার বক্তব্য সম্পর্কে প্রথমেই ইনকোয়ারি হোক, তারপর হাউস বসবে। এ নিয়ে স্পিকারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ বাকবিতণ্ডা হয়। তিনি বারবার আমাকে এসেম্বলির আইন মোতাবেক আচরণ করতে বলছিলেন।

আমারও এক কথা, যে সরকার আমাদের সন্তানদের গুলি করে হত্যা করেছে সেই সরকারের আইন মানা যায় না, আমি মানব না। আগে প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হাউসে বিবৃতি দিতে হবে, তারপর অধিবেশন মূলতবি ঘোষণা করেন। মূলতবির পর অধিবেশন আবার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিবৃতির মাধ্যমে এহেন জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে আমি পরিষদ ভবন ত্যাগ করি এবং চিরতরে মুসলিম লীগ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত এই বিবৃতিটি প্রদান করিÑ ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই সর্বাÍক দাবির আওয়াজ তোলার অপরাধে নূরুল আমিন সরকার বিগত ২১ ফেব্র“য়ারি থেকে রাজধানী ঢাকার বুকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে শিশু, কিশোর, যুবক প্রৌঢ় নির্বিশেষে যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন, সভ্য জগতের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। আমার বিবেচনায় জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এই সরকার গদিতে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না, সেই অধিকার আর তাদের নেই। এই সম্পর্কে পরিষদ ভবনে আমি যে প্রতিকার দাবি করেছিলাম সরকার পক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।

কাজেই এ সরকারের সমর্থক সদস্য হিসেবে নিজেকে যুক্ত রাখতে আমি আর ইচ্ছুক নই। আমি ঢাকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পরিষদীয় দল হতে অদ্য পদত্যাগ করলাম। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল যে, দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে আজ আমাদের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে চলেছে, নূরুল আমিন সরকার গতকল্য পরিষদে সেই দাবি যে কোন কারণেই হোক ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিয়েছেন। তবে কি আমাদের তাই মনে করতে হবে যে, একই কথা মন্ত্রী সাহেবরা বললে হবে পবিত্র আর দেশের লোক বললে হবে অপবিত্র ও অপরাধ, আর তার বদলা দিতে হবে অসংখ্য তরুণের তাজা প্রাণ দিয়ে? এই পরিস্থিতিতে একটা কথাই পরিষ্কার হল যে, ন্যায্য অধিকার বা মানব অধিকার বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব এই সরকারের দেশে রাখতে চায় না। আমি শহীদানের উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং জনগণের।

এসব দাবির যৌক্তিকতা ঘোষণা করে মুসলিম লীগ থেকে বিদায় গ্রহণ করেছি। ’ মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগের অব্যবহিত পরই জনাব খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, আনোয়ারা বেগম প্রমুখকে নিয়ে গঠন করি পার্লামেন্টের বিরোধী প্র“প। যদিও তখন এর কোন নামকরণ করা হয়নি। পরিষদ ভবন ত্যাগের পূর্বে মানবতার দোহাই দিয়ে অন্যান্য সদস্যদের প্রতিও পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই। হাউস থেকে সোজা চলে আসি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, এখানে এসে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেই।

মিছিল সহযোগে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে যেখানে বর্তমান শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানে যে টিনের হোস্টেল ছিল তার বারান্দায় একজন শহীদ ছাত্রের মাথার খুলি বুলেটের আঘাতে উড়ে গেছে। মগজ পড়ে আছে অন্যত্র। ছেলেটির মুখ পোড়া বেগুনের মতো হয়ে গেছে। ছাত্রদের মধ্যে চরম উত্তেজনা, হোস্টেলে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আমাকে বক্তৃতা করতে হল। বক্তৃতায় আমি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানালাম।

পরে পুলিশের বুলেটে আহত ও নিহত অন্যদের দেখার জন্য বের হলাম। পরদিন ২২ ফেব্র“য়ারি যথারীতি অধিবেশন বসেছে পরিষদের। আমি প্রস্তাব উত্থাপন করলাম, অধিবেশন মুলতবির, এই প্রস্তাবের প্রতি ৩৫ জন সদস্যের সমর্থন আছে কি না তা সদস্যদের কাছে স্পিকার জানতে চাইলেন, কিন্তু খয়রাত হোসেন, খান সাবে ওসমান আলী, আলি আহাম্মদ খান, আনোয়ারা খাতুন, মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন দত্ত, গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জি, বসন্ত কুমার দাস, আকবর আলী আকন্দ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, ডা. ভোলানাথ বিশ্বাস ও শ্রীহারানা চন্দ্র বর্মণ ছাড়া আর কেউ এ প্রস্তাব সমর্থন করলেন না। ফলে মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার নাকচ করে দিলেন। অতঃপর আমি নূরুল আমিন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলাম।

২৩ ও ২৪ ফেব্র“য়ারি অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। ঘোষণা দেয়া হল ২৫ তারিখে মুলতবি অধিবেশনে নূরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আলোচিত হবে। এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আন্দোলন গতি লাভ করতে থাকে তীব্র থেকে তীব্রতর বেগে। এদিকে ছাত্ররা পরিষদের সদস্যদের প্রতি আমাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রভাবিত করার জোর চেষ্টা চালাতে থাকে।

এতে সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ২৪ ফেব্র“য়ারি রাত ৩টার দিকে আমার দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। জিজ্ঞেস করলাম কে? দারোয়ান বলল, আপনার কাছে লোক এসেছে, আমি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একজন জবরদস্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর আমাকে জাপটে ধলো। আমি বেতমিজ বেয়াদব বলে ধমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে এসপি এবং ডিএসপি এগিয়ে এলেন।

বললেন আমরা দুঃখিত আমরা আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যই এসেছি। আমার পাশের কামরায় তখন খয়রাত হোসেন থাকতেন। তিনি পুলিশের আওয়াজ পেয়ে আমার কক্ষে এলেন, জানতে চাইলেন কেবল মাওলানা সাহেবের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা, না আর কারও বিরুদ্ধেও আছে। তৎক্ষণাৎ অফিসারটি জানালেন, আপনাকেও গ্রেফতার করা হল। প্রথমে আমাদের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হল।

সেখানে দেখলাম শ্রী মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জিকে আগেই আনা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম একজনের কাঁধে হাত রেখে আবুল হাসিম এসে হাজির, তিনিও এসেছেন গ্রেফতার হয়ে। অতঃপর আমরা পরস্পরের কুশল বিনিময় করলাম। ওই রাতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, জেল গেটে রাতের আঁধার কেটে গেছে। সেখানেই আমি ফজরের নামাজ আদায় করলাম, যতদূর মনে পড়ে আমাদের ৫ নং খাঁচায় রাখা হয়।

দেখলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে কারাগারের চার দেয়াল। এমনই সময় একদিন দেখলাম আমার বিশিষ্ট বন্ধু নরায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য খান সাহেব ওসমান আলী ও তার পুত্রকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। শুনলাম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য ১৪ ঘণ্টা অবরোধ করে রেখে তার বাসভবন তছনছ করেছে। এমনকি পুলিশ লাঠিচার্জ করে তার বৃদ্ধা মায়ের একটি হাত ভেঙে ফেলেছে। বন্ধুর এহেন দুঃসংবাদ শুনে কোন সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার ছিল না।

মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের যে সূর্য সন্তানেরা জীবন দিয়েছে, তাদের ত্যাগের তুলনায় বন্ধু ওসমান আলীর ক্ষতি তেমন কিছু নয়। তবুও মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ কোন স্বৈরাচারের দুঃশাসনের কবলে নিপতিত হল এই জাতি। ১৯০৫ সালে ভাগকর, শাসনকর নীতি ও ভিত্তিতে ব্রিটিশ বঙ্গ বিভাগ করে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষ ভঙ্গভাগকে স্বাগত জানায়। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, শিক্ষা দীক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই তারা নিষ্পেষিত বঞ্চিত।

প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাঙালি মুসলমানদের কোন অনীহা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্নতর। ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিবেশী সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমানদের প্রতি যে মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটান, তা ছিল সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট। ফলে অত্র এলাকার মানুষকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এ কারণেই এ এলাকার মানুষ বঙ্গভাগকে স্বাগত জানান।

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও অনুরূপ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরই এ দেশের মানুষ উপলব্ধি করল যে, মানচিত্র ও পতাকা বদল হলেও বঞ্চনার অবসান হয়নি। তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। ভাষা সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমতাবস্থায় ১৯০৫ ও ১৯৪৬ সালের চেতনায় আবারও তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং বিস্ফোরণ ঘটে ৮ ফাল্গ–ন ২১ ফেব্র“য়ারি।

’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাপক, তাই আংশিক হলেও লক্ষ্য যে, অর্জিত হয়েছে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে, যদিও জীবনের সর্বস্তরে এখনও চালু হয়নি। না হওয়ার কারণ স্বদেশী চেতনার পরিপন্থী মানসিকতা ঔপনিবেশিক আমলের ঘুণে ধরা আমলাতন্ত্র। ’৫২-এর একুশে ফেব্র“য়ারি আমাদের ঐতিহাসিক ধারানুক্রমে একটি মাইলস্টোন। এখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে উত্তরণের পথ আবিষ্কৃত হয়েছে।

সেই পথ ধরেই আমরা ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করেছি স্বাধীনতা। অবশ্য চূড়ান্ত গন্তব্যে এখনও পর্যন্ত আমরা উপনীত হতে পেরেছি কি না ভেবে দেখার বিষয়। আমার মনে হয়, ’৫২-এর পথ ধরে আমাদের আরও হাঁটতে হবে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য। অসংখ্য নেতাকর্মী ছাত্র এবং যুবসমাজ যার যার অবস্থান থেকে ভাষা সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে। আমিও রাখতে চেষ্টা করেছি।

আমার সেদিনের বন্ধুদের আজ অনেকেই বেঁচে নেই। জানি না আগামীদিনের মানুষ আমাদের ভূমিকাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে। তবে একটুকু বলে যেতে চাই যে, আমরা সেদিন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতবাদে প্রভাবিত ছিলাম না। যা কিছু করেছি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেছি। অন্তরের তাগিদে করেছি।

সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সেদিন যে চেতনা কাজ করেছে আমার মধ্যেও সেই একই চেতনা কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। আবুল হাসিম, খয়রাত হোসেন, গোবিন্দ ব্যানার্জি, ধীরেন দত্ত, খান সাহেব ওসমান আলী, অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী এদের যে কেউ বেঁচে থাকলে অনুরূপ কথাই বোধ করি বলতেন। ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ কোন না কোনভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তা করেছেন অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তবে ওই ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ বায়ান্ন সালে হলেও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে অনেক আগে। পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল।

১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে মূলত পাকিস্তানি রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিমাতাসুলভ ঘোষণার ফলে। আর এ ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ছাত্র-জনতা ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ জিন্নাহ সাহেবের এ ঘোষণার প্রতিবাদে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের কিছুটা রূপ আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি রাজশাহীতে গিয়ে। সেটা ছিল নভেম্বর মাস।

হঠাৎ খবর পেলাম আমার জ্যেষ্ঠপুত্র এসএম নুরুল আলম (তখন রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে মারাÍকভাবে আহত হয়েছে। ১৯ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজশাহী সফরে এলে ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেয় এবং বিরাট শোভাযাত্রা বের ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। নুরুল আলম তাতে অংশ নেয় এবং সরকারি গুণ্ডাবাহিনীর হাতে আরও অনেকের সাথে মারাÍকভাবে জখম হয়। আহত পুত্রকে দেখার জন্য আমি রাজশাহী পৌঁছার পর রাজশাহীর আন্দোলনরত ছাত্ররা এক বিশাল সমাবেশে জমায়েত হয়। পাকিস্তানি শাসকচক্র যে এক মারাÍক দুরভিসন্ধি নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ন্যায্য অধিকার পদদলিত করার তৎপরতায় লিপ্ত হতে যাচ্ছে তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এবং তারই প্রথম আঘাত বাংলা ভাষার ওপর।

সেদিন সেই সমাবেশে আমি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির সারবত্ত্বা তুলে ধরে বক্তৃতা করেছিলাম, ছাত্ররা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের যে আন্তরিকতা ও আবেগময়তার পরিচয় দিয়েছিল তা আমাকে তখন রীতিমতো আশান্বিত করে তোলে। আমার ধারণা জšে§ এই পৃথিবীর কোন শক্তিই বাংলা ভাষার কাংক্ষিত মর্যাদা ক্ষুণœ করতে পারবে না। বাংলা ভাষার এ আন্দোলনে ছাত্র যুবসমাজ পালন করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সরাসরি ছাত্র যুবসমাজের সাথে না থাকলেও যাদের নাম জেনেছি তাদের মধ্যে খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, এসএম নুরুল আলম, আজিজ আহম্মদ, আবদুল আউয়াল প্রমুখের নাম এ মুহূর্তে স্মরণ করছি। আমি তখন পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের সদস্য।

কিন্তু ২০ ফেব্র“য়ারিতেই সরকার ঢাকায় জারি করে ১৪৪ ধারা। জনসভা মিছিল, মিটিং ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন করা হয় পুলিশ ও মিলিটারি। এরই মধ্যে বেলা ২টার দিকে এসেম্বলি হাউসে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টরি পার্টির সভা বসে। আমার মনে পড়ে একুশে ফেব্র“য়ারি পরিষদের সভা আহ্বান করা হয়।

তখন বাইরে অবিরাম রাইফেলের গর্জন, কিন্তু কোন মন্ত্রী কিংবা পরিষদ সদস্যের ভেতরেই দেখলাম যেন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারও কোন উদ্বেগ নেই। মাঝে মাঝে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস, শেলবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দে আমি শিউরে উঠেছিলাম। এক সময়ে হাউস থেকে বেরিয়ে আসি, দেখি রাজপথ জনশূন্য। রাইফেল ও লাঠি হাতে স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে পুলিশ।

আমি মেডিকেল কলেজের দিকে অগ্রসর হলাম। কলেজের কাছাকাছি এসে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে অশ্র“ সম্বরণ করতে পারিনি। ছাত্ররা চিৎকার করছে দূর থেকে তারা গলা ফাটিয়ে আইন সভার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, বেরিয়ে এসে অবস্থা দেখার জন্য, আহত ছাত্ররা আর্তনাদ করছে। কারও কারও কাপড়ে ফেনাযুক্ত তাজা রক্ত, দেখতে পেলাম, বহু ছাত্র হতাহত হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে আমার সক্রিয় রাজনীতির চল্লিশ বছরের জীবনে হাসপাতালের অভ্যন্তরে পুলিশের গুলিবর্ষণের এমন ঘটনা আর দ্বিতীয়টি দেখিনি, মর্মান্তিক এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলাম না।

হাউসের কাছে প্রতিবাদ জানানোর জন্য অবস্থা বিবৃত করার জন্য ছুটে এলাম এসেম্বলি হাউসে। বিকাল তখন ৩টা ৩০ মিনিট, স্পিকার আবদুল করিম আসন গ্রহণ করলেন। আমি তখন উঠে দাঁড়ালাম স্পিকার, প্রশ্ন উত্তরের আগে আমি আপনার কাছে একটি নিবেদন করতে চাই। ভবিষ্যতের আশা ভরসা দেশের ছাত্ররা যখন পুলিশের গুলিতে জীবন দিচ্ছে, তখন আমরা এখানে বসে সভা করতে পারি না। আমার বক্তব্য সম্পর্কে প্রথমেই ইনকোয়ারি হোক, তারপর হাউস বসবে।

এ নিয়ে স্পিকারের সঙ্গে আমার দীর্ঘ বাকবিতণ্ডা হয়। তিনি বারবার আমাকে এসেম্বলির আইন মোতাবেক আচরণ করতে বলছিলেন। আমারও এক কথা, যে সরকার আমাদের সন্তানদের গুলি করে হত্যা করেছে সেই সরকারের আইন মানা যায় না, আমি মানব না। আগে প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হাউসে বিবৃতি দিতে হবে, তারপর অধিবেশন মূলতবি ঘোষণা করেন। মূলতবির পর অধিবেশন আবার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক বিবৃতির মাধ্যমে এহেন জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে আমি পরিষদ ভবন ত্যাগ করি এবং চিরতরে মুসলিম লীগ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত এই বিবৃতিটি প্রদান করিÑ ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান করতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এই সর্বাÍক দাবির আওয়াজ তোলার অপরাধে নূরুল আমিন সরকার বিগত ২১ ফেব্র“য়ারি থেকে রাজধানী ঢাকার বুকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণের মাধ্যমে শিশু, কিশোর, যুবক প্রৌঢ় নির্বিশেষে যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন, সভ্য জগতের ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল।

আমার বিবেচনায় জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এই সরকার গদিতে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না, সেই অধিকার আর তাদের নেই। এই সম্পর্কে পরিষদ ভবনে আমি যে প্রতিকার দাবি করেছিলাম সরকার পক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। কাজেই এ সরকারের সমর্থক সদস্য হিসেবে নিজেকে যুক্ত রাখতে আমি আর ইচ্ছুক নই। আমি ঢাকার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুসলিম লীগ পরিষদীয় দল হতে অদ্য পদত্যাগ করলাম। সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল যে, দাবি উত্থাপন করতে গিয়ে আজ আমাদের ছেলেরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে চলেছে, নূরুল আমিন সরকার গতকল্য পরিষদে সেই দাবি যে কোন কারণেই হোক ন্যায়সঙ্গত বলে মেনে নিয়েছেন।

তবে কি আমাদের তাই মনে করতে হবে যে, একই কথা মন্ত্রী সাহেবরা বললে হবে পবিত্র আর দেশের লোক বললে হবে অপবিত্র ও অপরাধ, আর তার বদলা দিতে হবে অসংখ্য তরুণের তাজা প্রাণ দিয়ে? এই পরিস্থিতিতে একটা কথাই পরিষ্কার হল যে, ন্যায্য অধিকার বা মানব অধিকার বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব এই সরকারের দেশে রাখতে চায় না। আমি শহীদানের উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং জনগণের। এসব দাবির যৌক্তিকতা ঘোষণা করে মুসলিম লীগ থেকে বিদায় গ্রহণ করেছি। ’ মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগের অব্যবহিত পরই জনাব খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, আনোয়ারা বেগম প্রমুখকে নিয়ে গঠন করি পার্লামেন্টের বিরোধী প্র“প। যদিও তখন এর কোন নামকরণ করা হয়নি।

পরিষদ ভবন ত্যাগের পূর্বে মানবতার দোহাই দিয়ে অন্যান্য সদস্যদের প্রতিও পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাই। হাউস থেকে সোজা চলে আসি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, এখানে এসে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেই। মিছিল সহযোগে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে যেখানে বর্তমান শহীদ মিনার অবস্থিত, সেখানে যে টিনের হোস্টেল ছিল তার বারান্দায় একজন শহীদ ছাত্রের মাথার খুলি বুলেটের আঘাতে উড়ে গেছে। মগজ পড়ে আছে অন্যত্র। ছেলেটির মুখ পোড়া বেগুনের মতো হয়ে গেছে।

ছাত্রদের মধ্যে চরম উত্তেজনা, হোস্টেলে ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আমাকে বক্তৃতা করতে হল। বক্তৃতায় আমি শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানালাম। পরে পুলিশের বুলেটে আহত ও নিহত অন্যদের দেখার জন্য বের হলাম। পরদিন ২২ ফেব্র“য়ারি যথারীতি অধিবেশন বসেছে পরিষদের। আমি প্রস্তাব উত্থাপন করলাম, অধিবেশন মুলতবির, এই প্রস্তাবের প্রতি ৩৫ জন সদস্যের সমর্থন আছে কি না তা সদস্যদের কাছে স্পিকার জানতে চাইলেন, কিন্তু খয়রাত হোসেন, খান সাবে ওসমান আলী, আলি আহাম্মদ খান, আনোয়ারা খাতুন, মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন দত্ত, গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জি, বসন্ত কুমার দাস, আকবর আলী আকন্দ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, ডা. ভোলানাথ বিশ্বাস ও শ্রীহারানা চন্দ্র বর্মণ ছাড়া আর কেউ এ প্রস্তাব সমর্থন করলেন না।

ফলে মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার নাকচ করে দিলেন। অতঃপর আমি নূরুল আমিন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলাম। ২৩ ও ২৪ ফেব্র“য়ারি অধিবেশন মুলতবি রাখা হয়। ঘোষণা দেয়া হল ২৫ তারিখে মুলতবি অধিবেশনে নূরুল আমিনের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আলোচিত হবে। এদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে নূরুল আমিন সরকারের বিরুদ্ধে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।

আন্দোলন গতি লাভ করতে থাকে তীব্র থেকে তীব্রতর বেগে। এদিকে ছাত্ররা পরিষদের সদস্যদের প্রতি আমাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রভাবিত করার জোর চেষ্টা চালাতে থাকে। এতে সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ২৪ ফেব্র“য়ারি রাত ৩টার দিকে আমার দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। জিজ্ঞেস করলাম কে? দারোয়ান বলল, আপনার কাছে লোক এসেছে, আমি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একজন জবরদস্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর আমাকে জাপটে ধলো।

আমি বেতমিজ বেয়াদব বলে ধমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে এসপি এবং ডিএসপি এগিয়ে এলেন। বললেন আমরা দুঃখিত আমরা আপনাকে গ্রেফতার করার জন্যই এসেছি। আমার পাশের কামরায় তখন খয়রাত হোসেন থাকতেন। তিনি পুলিশের আওয়াজ পেয়ে আমার কক্ষে এলেন, জানতে চাইলেন কেবল মাওলানা সাহেবের বিরুদ্ধেই গ্রেফতারি পরোয়ানা, না আর কারও বিরুদ্ধেও আছে।

তৎক্ষণাৎ অফিসারটি জানালেন, আপনাকেও গ্রেফতার করা হল। প্রথমে আমাদের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে দেখলাম শ্রী মনোরঞ্জন ধর ও গোবিন্দ বল্লভ ব্যানার্জিকে আগেই আনা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম একজনের কাঁধে হাত রেখে আবুল হাসিম এসে হাজির, তিনিও এসেছেন গ্রেফতার হয়ে। অতঃপর আমরা পরস্পরের কুশল বিনিময় করলাম।

ওই রাতেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, জেল গেটে রাতের আঁধার কেটে গেছে। সেখানেই আমি ফজরের নামাজ আদায় করলাম, যতদূর মনে পড়ে আমাদের ৫ নং খাঁচায় রাখা হয়। দেখলাম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে কারাগারের চার দেয়াল। এমনই সময় একদিন দেখলাম আমার বিশিষ্ট বন্ধু নরায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য খান সাহেব ওসমান আলী ও তার পুত্রকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। শুনলাম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য ১৪ ঘণ্টা অবরোধ করে রেখে তার বাসভবন তছনছ করেছে।

এমনকি পুলিশ লাঠিচার্জ করে তার বৃদ্ধা মায়ের একটি হাত ভেঙে ফেলেছে। বন্ধুর এহেন দুঃসংবাদ শুনে কোন সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার ছিল না। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের যে সূর্য সন্তানেরা জীবন দিয়েছে, তাদের ত্যাগের তুলনায় বন্ধু ওসমান আলীর ক্ষতি তেমন কিছু নয়। তবুও মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ কোন স্বৈরাচারের দুঃশাসনের কবলে নিপতিত হল এই জাতি। ১৯০৫ সালে ভাগকর, শাসনকর নীতি ও ভিত্তিতে ব্রিটিশ বঙ্গ বিভাগ করে।

কিন্তু পূর্ববঙ্গের মানুষ ভঙ্গভাগকে স্বাগত জানায়। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, শিক্ষা দীক্ষাসহ আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই তারা নিষ্পেষিত বঞ্চিত। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাঙালি মুসলমানদের কোন অনীহা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্নতর। ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিবেশী সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমানদের প্রতি যে মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটান, তা ছিল সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট।

ফলে অত্র এলাকার মানুষকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এ কারণেই এ এলাকার মানুষ বঙ্গভাগকে স্বাগত জানান। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও অনুরূপ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরই এ দেশের মানুষ উপলব্ধি করল যে, মানচিত্র ও পতাকা বদল হলেও বঞ্চনার অবসান হয়নি। তারা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন।

ভাষা সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমতাবস্থায় ১৯০৫ ও ১৯৪৬ সালের চেতনায় আবারও তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং বিস্ফোরণ ঘটে ৮ ফাল্গ–ন ২১ ফেব্র“য়ারি। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাপক, তাই আংশিক হলেও লক্ষ্য যে, অর্জিত হয়েছে এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে, যদিও জীবনের সর্বস্তরে এখনও চালু হয়নি। না হওয়ার কারণ স্বদেশী চেতনার পরিপন্থী মানসিকতা ঔপনিবেশিক আমলের ঘুণে ধরা আমলাতন্ত্র।

’৫২-এর একুশে ফেব্র“য়ারি আমাদের ঐতিহাসিক ধারানুক্রমে একটি মাইলস্টোন। এখান থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে উত্তরণের পথ আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই পথ ধরেই আমরা ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করেছি স্বাধীনতা। অবশ্য চূড়ান্ত গন্তব্যে এখনও পর্যন্ত আমরা উপনীত হতে পেরেছি কি না ভেবে দেখার বিষয়। আমার মনে হয়, ’৫২-এর পথ ধরে আমাদের আরও হাঁটতে হবে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য।

অসংখ্য নেতাকর্মী ছাত্র এবং যুবসমাজ যার যার অবস্থান থেকে ভাষা সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে। আমিও রাখতে চেষ্টা করেছি। আমার সেদিনের বন্ধুদের আজ অনেকেই বেঁচে নেই। জানি না আগামীদিনের মানুষ আমাদের ভূমিকাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে। তবে একটুকু বলে যেতে চাই যে, আমরা সেদিন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতবাদে প্রভাবিত ছিলাম না।

যা কিছু করেছি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেছি। অন্তরের তাগিদে করেছি। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সেদিন যে চেতনা কাজ করেছে আমার মধ্যেও সেই একই চেতনা কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। আবুল হাসিম, খয়রাত হোসেন, গোবিন্দ ব্যানার্জি, ধীরেন দত্ত, খান সাহেব ওসমান আলী, অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী এদের যে কেউ বেঁচে থাকলে অনুরূপ কথাই বোধ করি বলতেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.