১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের পথ বেয়ে নানা আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভেদ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে লাখ লাখ দেশপ্রেমিকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪২ বছরেও আমাদের স্বাধীনতা সংহত হতে পারছে না। কিন্তু কি কারণে? আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষা নিজ দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে চরমভাবে অনাদৃত এবং উপেক্ষিত। সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অনুষ্ঠানাদিতে শুধু লিপ সার্ভিস দিয়েই বাংলা ভাষা সম্পর্কিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
জাতীয় সিলেবাস সিস্টেম বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণের কোনো নির্দেশ না থাকায়, শুধু গ্রামীণ স্কুলগুলোতেই শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করছে।
আর ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে নানা সুযোগ-সুবিধা লাভের চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে জাতীয় সিলেবাস সিস্টেমে ইংরেজির মাত্রা বৃদ্ধি করে তা অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করা যায়। কিন্তু তা না করায় শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। দেশপ্রেমের প্রমাণ কই? অথচ ৩০০ বছর আগেও আমেরিকানরা তৎকালে ইউরোপে প্রচলিত দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা (ঙহব ভড়ৎ অৎরংঃড়পৎধপু ধহফ ধহড়ঃযবৎ ভড়ৎ পড়সসড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব) মেনে নেয়নি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দীতেও বিরাট বৈষম্য ও অনাচার নির্বিঘ্নে চলছে, যেমন চলছে এই স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে ঔপনিবেসিক প্রশাসন ব্যবস্থা।
খোঁজ নিয়ে দেখুন, দেশের সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই বিয়েশাদি ও অনুষ্ঠানাদির কার্ড ছাপান ইংরেজিতে। যারা ইংরেজি জানেন না, তারাও হাল ফ্যাশন অনুযায়ী প্রেসে কার্ডের নমুনা বাছাই করে বিয়েশাদিসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতেই ছাপেন। অতি সাধারণ লোকেরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করলে, ধনিক, বণিক, মুৎসুদ্ধি ও আমলাদের অনেকেই ইংরেজি ভাষাই বেছে নেন। টকশোতে বড় বড় শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ব্যক্তিদের এ বিষয়ে বক্তব্য কি?
যারা ইংরেজিতে বিয়েশাদি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের কার্ড ছাপান, খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাদের আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একজনও ইংরেজ লোক নেই। শুধু বইমেলা, ভাষা দিবস ইত্যাদি পালন করে জনগণের ভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা হতে পারে কি?
পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা ভিন্ন।
শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও ভারতে যতগুলো প্রদেশ ততগুলো ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। খুব অল্প লোকের ভাষা হিন্দি হওয়া সত্ত্বেও তা ভারতের রাষ্ট্র ভাষা। কোনো স্টেটই রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করার জন্য এগিয়ে আসছে না। ফলে ভারত বাধ্য হয়ে বিভিন্ন স্টেটের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকেই বেছে নিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের সেরা ট্রেডিং নেশন চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ তাদের তৈরি জিনিসপত্র বিদেশে বেচাকেনার দোহাই দিয়ে, তাদের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি করেনি বা ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করেনি।
বিশাল রাশিয়া, ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশগুলো ইংরেজি ভাষা নির্বিচারে গ্রহণ করেনি। অথচ আমরা বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছি, লড়াই করেছি এবং এই ভাষা বৈষম্য ও অন্যান্য বৈষম্যের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু নিজস্ব ভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কই? উচ্চ ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঐক্য নেই কেন? এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অস্পষ্ট কেন? এক্ষেত্রে আমরা নাগরিকরা সরকারের কাছে কোনো কৈফিয়ত তলব করতে পারি কি?
লেখক : সাবেক পরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।