আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লড়াইয়ের নায়ক আমজাদ, স্বীকৃতি স্বরূপ পেলন বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস পুরস্কার।

প্রথম আলোতে লেখাটি দেখার পর ভাল লাগল বিধায় সবার জন্য শেয়ার করলাম। গত ৩ জানুয়ারি ভারতের বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ২০১২ সালের জন্য বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য অ্যাওয়ার্ড পেতে যাচ্ছেন। এই খবরের পর বিহারের সরকারি মহলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ২৪ জানুয়ারি ১১৭ জন মনোনীতের মধ্যে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। সবাইকে চমকে দিয়ে দেখা গেল: নীতিশ কুমার নন, ‘গেটস ভ্যাকসিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ নামের ওই পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলাদেশের এক তরুণ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এ এস এম আমজাদ।

জেলা পর্যায়ে শিশুদের পোলিও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে সফলতা পাওয়ায় তাঁকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। নাম ঘোষণার পর মেলিন্ডা গেটসের হাত থেকে পুরস্কার নিতে আমজাদ ছুটে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সারা দুনিয়ার গণমাধ্যম উৎসুক হয়ে উঠল আমজাদ সম্পর্কে জানতে। আর আমজাদ নিজের কীর্তি সম্পর্কে বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, তিনি বেশি কিছু করেননি; শুধু কয়েকটি এলাকার সব শিশু যাতে টিকার আওতায় আসে, সেই লক্ষ্যে বাস্তব অবস্থা বুঝে নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়েছেন। আড়াই লাখ মার্কিন ডলারের ওই পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করার আগে আমজাদের সৃজনশীলতা সম্পর্কে খোঁজ নেয় গেটস ফাউন্ডেশন।

তারা জানতে পারে, আমজাদ ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় টিকাদান কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছিলেন। আমজাদের নেওয়া উদ্যোগের কারণে সে সময়ে ওই তিন জেলায় শিশুদের পোলিও টিকা নেওয়ার সংখ্যা ১৭ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছিল। পোলিওর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নায়ক আমজাদ ছাড়া অন্য মনোনীত ১১৬ জনের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন হয় রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী অবস্থানে থাকা ব্যক্তি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সবার মধ্য থেকে আমজাদকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে স্বয়ং বিল গেটস তাঁর ওয়েবসাইটে দেওয়া নোটে বলেছেন, একমাত্র আমজাদই বিদ্যমান টিকা দেওয়ার সুযোগকে কীভাবে আরও বেশি শিশুদের কাছে পৌঁছানো যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বিদ্যমান সুযোগকে নিজের উদ্ভাবনী চিন্তা দিয়ে আরও বেশি কার্যকর করে লাখো শিশুকে পোলিওর মতো রোগ থেকে রক্ষা করেছেন।

বিল গেটস আমজাদকে পোলিওর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন, ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ৬৫ শতাংশ কমেছে। এই সাফল্যের পেছনে আমজাদের মতো মাঠকর্মীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তাঁর দেখানো এই কৌশল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রয়োগ করা যাবে বলেও মনে করেন মাইক্রোসফটের এই উদ্ভাবক। কী করে এল এই উদ্ভাবনী চিন্তা, আর কীভাবে পেলেন ওই সফলতা—এ কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) হয়ে নাইজেরিয়াতে কর্মরত আমজাদের কাছে। জবাবে তিনি জানিয়েছেন, টাঙ্গাইলে সম্প্রসারিত টিকাদান প্রকল্পে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়ে দেখলেন, অনেক শিশুই জন্মের পর টিকা নেয় না।

চার থেকে ছয় মাস পরেও অনেকে টিকা নেয়। আমজাদ তাঁর সহকর্মীদের বললেন প্রতিটি গ্রামের গর্ভবতী নারীদের একটি তালিকা করতে। কোন মাসে কোন গ্রামে কোন কোন নারীর সন্তান জন্ম নেবে, তার একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তুললেন আমজাদ। সন্তান হওয়ার পরই তাঁরা হাজির হতেন। কেউ টিকা থেকে বাদ পড়ল কি না, তা জানতে একটি মূল্যায়ন কৌশলও (চেকলিস্ট) নিজে থেকে তৈরি করলেন তিনি।

আমজাদের নেওয়া এই কৌশল প্রয়োগের দুই বছরের মাথায় টাঙ্গাইলে টিকা নেওয়া শিশুদের সংখ্যা ২০ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে এই কৌশল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ জেলায় প্রয়োগ করা হলো। ওই দুই জেলাতেও টিকাদানের হার ১৭ দশমিক ৪ ও ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গেল। বাংলাদেশে শুরু হওয়া এই কৌশল অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে বলে মনে করেছে গেটস ফাউন্ডেশন। গ্রামে চলো জনস্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার এই দিশারি আমজাদের শুরুটা অবশ্য ভিন্ন রকমের ছিল।

ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শুরুতে নিওরোসার্জন হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০০৩ সালে জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন তিনি। বন্ধুরা অনেকে বড় বড় হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যোগ দিলেও আমজাদ রাজধানী ছেড়ে ছুটে গেলেন গ্রামে। গ্রামের শিশুদের টিকা দেওয়ার পর যখন তারা সুস্থভাবে বেড়ে উঠত, তখন আমজাদের বারবার নিজের ছোট্ট মেয়ে আদিবার কথা মনে হতো। তবে টাঙ্গাইলের একটি ঘটনা তাঁকে বেশ নাড়া দিয়েছিল।

এক বাড়িতে একটি শিশুর জন্ম হওয়ার খবর পেয়ে আমজাদ টিকার বাক্স নিয়ে ছুটে যান। গিয়ে জানতে পারেন, পাশের আরেকটি বাড়িতে ছয় মাস আগে একটি মেয়েশিশুর জন্ম হলেও তাকে এখনো টিকা দেওয়া হয়নি। ওই মায়ের কাছে গিয়ে আমজাদ এর কারণ কী, তা জানতে চান। ওই মা উত্তরে জানান, এ নিয়ে তাঁর চতুর্থ মেয়েশিশুর জন্ম হলো। তাই পরিবারের কেউ খুশি নয়।

তাই টিকাও দেওয়া হয়নি। আমজাদ ওই মাকে বোঝালেন, ‘এই মেয়েশিশু যদি পোলিও টিকা না নেয়, আর বড় হয়ে সে যদি পোলিও-আক্রান্ত হয়ে ঠিকমতো হাঁটতে না পারে, তাহলে সেটা তাঁর জন্য আরও বড় বোঝা হবে। ওই মেয়েকে বিয়েও দেওয়া যাবে না। ’ এত কথা বোঝানোর পরও টিকা দিতে রাজি না হওয়ায় আমজাদ রাগ করে ওই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গ্রামের পথ ধরে কিছুদূর এগোতেই আমজাদ দেখতে পান, ওই নারী তাঁর সন্তানকে টিকা দেওয়ার জন্য ছুটতে ছুটতে আসছেন।

তাঁর চিন্তা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত গ্রামের সব নবজাতক শিশুকে টিকা দেওয়ার পণ করে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন আমজাদ, তা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াতেও নবজাতকদের টিকা দেওয়ার কাজে ডব্লিউএইচওর হয়ে কাজ করছেন আমজাদ। সেখানেও শতভাগ শিশুকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে আমজাদের ওই সৃজনশীল কৌশল কাজে লাগানো হচ্ছে। আপাতত নাইজেরিয়াতে কাজ করলেও দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা আমজাদের। পুরস্কারের আড়াই লাখ ডলার বাংলাদেশের শিশুদের টিকা দেওয়ার কাজে খরচেরও পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

তবে বিনয়ী আমজাদের মতে, তাঁর এই অর্জনটা কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর মনে হয়েছে, বিশ্বের যেকোনো জাতির মানুষের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের বুদ্ধিমত্তার গড় মান বেশি। স্বাধীনতার পরের বছরের মার্চে জন্ম নেওয়া এ এস এম আমজাদ মনে করেন, জাতিগতভাবেই বাংলাদেশের মানুষ সৃজনশীল ও নিষ্ঠাবান। দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করলে পৃথিবীর যেকোনো দুঃসাধ্য কাজই এ দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব। শুধু কাজের পরিবেশটা দেওয়া চাই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.