[মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৯]
অনুবাদ: আ-আল মামুন
১৯৪৭ সালে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। তারপর থেকেই এই অঞ্চলের ইতিহাস উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে আছে। ভারতীয় উপমাহাদেশ থেকে দুটি মুসলিম প্রধান অংশ পাকিস্তান নামের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেরিয়ে এলো এবং ভারতও সেসময় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করল। নিম্নে ঘটনাক্রম:
১৯৪৭: মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে আগস্ট মাসে বৃটিশ শাসন এলাকার আলাদা সত্তা হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূত্রপাত করলেন। তিনি প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দশ লক্ষাধিক লোক নিহত হল।
১৯৫১: পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডীতে গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
১৯৫৬: মার্চ মাসে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশটিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। জেনারেল মীর্জা হলেন প্রেসিডেন্ট।
১৯৫৮: ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝামেলার মধ্যে অক্টোবর মাসে প্রেসিডেন্ট মির্জা সংবিধান বাতিল করেন এবং মার্শল ’ল জারী করেন।
তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২৮ অক্টোবর এক ঘোষণার মাধ্যমে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হলেন।
১৯৫৯: জুন মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থার সূচনা করেন। এই ব্যবস্থায় আইয়ুব খান পেয়ে যান ৮,০০০ নির্বাচন সহযোগী। আর তাদের মাধ্যমেই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়।
১৯৬০: ভোটের মাধ্যমে আইয়ুব খানের রাষ্ট্রপতিত্ব নিশ্চিত হয়। ফেব্রুয়ারি ১৭ তারিখে তিনি শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৬২: আইয়ুব খান নতুন সংবিধান পেশ করেন, যা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করে এবং এই সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমান অংশিদারিত্বে এক কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের বিধান দেয়া হয়।
১৯৬৫: আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। বিতর্কিত কাশ্মীরের অধিকার নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে খণ্ড যুদ্ধ হয়ে যায়।
১৯৬৯: পাকিস্তানের দুই অংশে কয়েক মাসের ব্যাপক রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও দাঙ্গার প্রেক্ষিতে আইয়ুব খান মার্চ মাসে পদত্যাগ করেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ অধিগ্রহণ করে সামরিক শাসন জারী করেন, নভেম্বর মাসে তিনি এক ব্যক্তি এক ভোট ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৭০: পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের দাবি মিটিয়ে জাতীয় পরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বণ্টনের জন্য মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন যে জাতীয় পরিষদের ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ আসন থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬০টি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলীর পিপলস পার্টি লাভ করে ৮৩টি আসন।
১৯৭১: পাকিস্তানের দুই অংশের নের্তৃবৃন্দ নতুন সংবিধানের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে একমত হতে না পারায় ২২ মার্চ দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রয়েছে। এই মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুই নেতার মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ঢাকা এসেছেন এবং শেখ মুজিবই মূলত এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন পূর্ব পাকিস্তান।
রয়টার্স
দ্যা গার্ডিয়ান
২৭ মার্চ, ১৯৭১
সম্পদকীয়
পাকিস্তানের ট্রাজেডি
সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত দু’পক্ষ আলোচনার টেবিলে ছিল ততক্ষণ তবু সমঝোতার কিছু সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার সাথে সাথেই সন্দেহজনক দ্রুতগতিতে জাহাজে করে সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়ে সাঁজোয়া অভিযান চালানো হলো। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে এবং সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার অভিসন্ধি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে তিনি পাকিস্তানের ঐক্য অক্ষুন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর। প্রেসিডেন্টের এরূপ অবস্থান শেখ মুজিব কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণাকে অপরিহার্য্য করে তুলেছিল। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই দ্রুতগতিতে উত্তেজনা বাড়ছিল।
পাকিস্তানের বিভক্তি ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট যে সংকল্প নিয়েছেন তা হয়তো সফল হবে না। কিন্তু এর ফলাফল যাই হোক না কেন দুর্দশা, রক্তপাত ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা অনিবার্য্য।
পাকিস্তান থেকে বাংলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাধ্যমে পবিত্র ইসলামী আদর্শে যে যুক্ত পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল তার অযৌক্তিকতাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা। বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক আঞ্চলিক উত্তেজনার পরও যে একক পাকিস্তান এতোদিন টিকে ছিল সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে যে বিপুল অসন্তষ্টি জমে উঠেছে তাতে এবারের গণজোয়ার যেকোনো সমঝোতা অসম্ভব করে তুলতে পারে।
পূর্ব পাকিস্তান মনে করে যে, পাকিস্তানের অর্থনীতিতে তাদের অবদান, বিশেষত পাট রফতানির মাধ্যমে, প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রতিরক্ষা বাজেটের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তান ভারতের সাথে যে দীর্ঘ সংঘাতে লিপ্ত তার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের খুব সামান্যই সমর্থন আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এবং নিজেদের আত্মপরিচয়ের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস শেখ মুজিবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দানের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনা করছে বা বন্ধ রাখছে। ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সমঝোতার যে একমাত্র পথ খোলা ছিল তাও প্রশাসনের এই জুয়াখেলা বাধাগ্রস্ত করেছে; যদিও শেখ মুজিবের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পদাধিকার পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের চেতনায় সরাসরি প্রভাব ফেলার এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের পথ করে দিত। প্রেসিডেন্ট, শেখ মুজিবুর রহমান এবং সম্ভাব্য বিরোধী দলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এই প্রধান তিন রাজনৈতিক চরিত্রই হিসেবে ভুল করেছেন এবং বিকল্প সমাধানে না পৌঁছাতে পারার ব্যাপারটি অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছেন।
গত নির্বাচন রাজনৈতিক বিভেদকে এমনভাবে প্রকটিত করেছে যা দেশের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। এরূপ স্পষ্ট রাজনৈতিক ফলাফল নিশ্চিতভাবেই সামরিক হস্তক্ষেপকে ত্বরান্বিত করেছে; কারণ এই রাজনৈতিক ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অশক্ত কোয়ালিশন সরকারই গঠন করা সম্ভব। নির্বাচনের পূর্বেও পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রীক বিজয় রাজনৈতিক নেতাদের সম্পূর্ণ বিস্মিত করে দিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান তার কঠোর ছয় দফা দাবি নিয়ে উপস্থিত হলেন এবং আওয়ামী লীগের সমঝোতা প্রয়াসী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কট্টর স্বাধীনতাবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ শেখ মুজিবের প্রবৃত্তি ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোর বাইরে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রক্ষার দৃঢ়তা অনিশ্চয়তায় দুলতে লাগল যখন তিনি দেখলেন নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা রয়েছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করাকে পূর্ব পাকিস্তানীদের কাছে তাদের স্বার্বভৌমত্বের আকাঙ্ক্ষারই মৃত্যুর সামিল গণ্য হলো। জুলফিকার আলী ভূট্টোর স্বার্থ প্রায় সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এটা বিভেদকে আরও তরান্বিত করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তোয়াক্কা না করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শেখ মুজিবুর রহমান সফলভাবে বাংলার শাসন পরিচালনা করছে- এটা হজম করা প্রেসিডেন্টের কাছে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
তিনি সমঝোতার পথ পরিহার করলেন এবং এখন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এক অস্বাভাবিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্ট করছেন।
এই রক্তক্ষয়ের তাৎক্ষণিক ফল হলো যে পশ্চিম পাকিস্তানের পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের অবিশ্বাস আরও তীব্র হবে। কিন্তু সমস্যার এখানেই সমাপ্তি ঘটছে কী! শেখ মুজিবের মতো একজন সহৃদয় সমঝোতাকামী কি বিপ্লবের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? নিজ দলের কট্টর সদস্যদের সামলে রেখে তিনি নিজের অবস্থান সংহত রাখতে পারবেন কি? কিংবা নির্বাচন বয়কটকারী বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে সামলাতে পারবে কিনা তাও অনিশ্চিত। গণআন্দোলনের প্রথমদিকেই তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল। আর এখন স্বাধীনতা প্রশ্নে তার সামনে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো অবকাশ নেই, প্রাকযুদ্ধকালেই পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত।
আর এই গৃহযুদ্ধ অর্থনীতিকে আরও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশ গভীর আগ্রহের সাথে দেশটির বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে। পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক নেতাই পাকিস্তানের আজকের দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়ার ট্রাজেডিতে অবদান রেখেছে। পরিতাপের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট বাংলার স্বতন্ত্র পরিচয়কে স্বীকৃতি দানের কোনো বিকল্প পথ বের করে রক্তক্ষয় কমাতে পারলেন না।
দ্যা গার্ডিয়ান
২৭ মার্চ, ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ১
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ২
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৩
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৪
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৫
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৬
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৭
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবেদন ৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।