আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কফিশপ- শেষ পর্ব

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... কফিশপ-প্রথম পর্ব কফিশপ-দ্বিতীয় পর্ব কফিশপ-তৃতীয় পর্ব নিশাতের কথাঃ চেনা অচেনা নির্লিপ্ততা দশ বছর পরঃ আজকাল প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে আমার ঘরের দেয়ালঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটার শব্দ। সারাদিনের ব্যস্ততায় মিনিটের হিসাবও যেখানে আমি করিনা, মাঝরাত্রির সেকেন্ডগুলোও যেন দীর্ঘ এক এক ঘন্টা। আমি কান পেতে শুনি ঘড়ির অবিরাম টিক টিক শব্দ। ঘুম ভাঙ্গার পর আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি আবার ঘুমিয়ে পড়তে, ব্যর্থ হই।

পানি খাই, হাঁটাহাঁটি করি এমনকি মিউট করে টিভি খুলেও বসে থাকি, ঘুম আর আসে না। শব্দহীন টিভির ভেতরের মানুষগুলোর হাঁটাচলা আর মুখ নাড়া দেখতে দেখতেই মাঝে মাঝে ফজরের আজান শুনি; শুনি আরেকটি কর্মব্যস্ত দিনের পদচারণা। মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে আসে, এই যেমন আজকের রাতটা। ঘড়িতে একটা বাজার ধ্বনি শুনেছি, এখন শুনছি দুইটার টিং টং আওয়াজ। ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে পাশে শোয়া আবিরের দিকে তাকাই, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে; শোনা যাচ্ছে তার মৃদু নাসিকা ধ্বনি।

আমার নির্ঘুম রাতে আবিরের কিছুই এসে যায় না। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আবিরকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে আমার, আদুরে গলায় ডাকতে ইচ্ছে হয়, “এই শুনছো, আমার ঘুম আসছে না”। হাত বাড়িয়ে থমকে যাই, একজন স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে সহজ কাজটি করা আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন। কার দোষ দেবো, নিয়তির? ডাইনিং রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে বরফশীতল পানি গলায় ঢালি টনসিলের সমস্যাকে উপেক্ষা করে। নিজেকে কষ্ট দেই আমি, গত ১০ বছর ধরেই দিচ্ছি।

কি লাভ তাতে? কেউ খবরও নেয় না। কিন্তু নিজেকে কষ্ট দেয়াটা একটা নেশার মত, একবার দেয়া শুরু করলে থামানো যায় না। পড়ার ঘরে গিয়ে এলোমেলোভাবে বই টানতে থাকি। মেডিকেলের ভারী ভারী বইএর গন্ধে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। আর পারিনা, ভীষন ক্লান্ত লাগে।

টেনে সরাতে গিয়ে হুড়মুড় করে একরাশ বই মুখ থুবড়ে পড়ে মেঝেতে। বই সাজাতে গিয়ে হঠাৎ জীবনানন্দের একটি বই হাতে ঠেকে, সাতটি তারার তিমির। পাতা উলটাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি। এই কবিতা একসময় আমি পড়তাম? কবে শেষ কবিতা পড়েছি মনে পড়েনা। মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেই আমি, পুরনো পাতার নেশা ধরানো ঘ্রাণ, কাঁপন ধরায় বুকে।

বইটা বুকে চেপে বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে পড়ি আমি; ক্লান্ত শ্রান্ত। তিরিশ বছর বয়সেই নিজেকে মধ্যবয়স্ক লাগে। একটু ঝিমানি চলে এসেছিলো হঠাৎ নিজের নাম শুনে চমকে উঠি… “নিশাত… নিশাত” আমি দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরি। একা একা থাকলেই এই কন্ঠস্বর জেঁকে বসে… অস্থির করে তোলে আমাকে। “পারলে না তো নুশা… আমাকে ভুলতে পারলে না”।

“একদম চুপ। তুমি কে? আমি কি তোমাকে চিনি?” ফাঁপা ধমকে প্রকম্পিত হই নিজেই। উত্তরে সেই চেনা হাসি বিদ্রুপ করে আমাকে, “পারলে কি? কোনদিনও পারবে না”। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার, নিজের ব্যক্তিত্বকে ধরে না রাখতে পারার অপমানে নিজেই ছোট হতে থাকি নিজের কাছে। গলা ভেঙ্গে আসে আমার, হ্যাঁ, আমি ব্যর্থ, আমি রিককে ভুলতে ব্যর্থ।

সে তো নিজের কাছে, বাইরের মানুষের কাছে তো আমি পৃথিবীর অন্যতম সুখী মানুষ। লোক দেখানো সফলতায় ভরপুর আমি, আমার জীবন দেখে ঈর্ষান্বিত আমার পরিচিত পরিজন। কোন পার্টিতে যখন আমি নীল অথবা সবুজ রঙের শিফন বা কাতান পড়ে ঠোঁটে আত্মঅহমিকার হাসি ঝুলিয়ে সবার সাথে আবিরকে পরিচিত করিয়ে দেই, আমার মেডিকেলের বন্ধুদের চোখে স্পস্ট ঈর্ষা ফুটে ওঠে। মিথ্যে বলবো না, এই ঈর্ষা আমি উপভোগ করি। বার বার নিজেকে বোঝাই, হ্যাঁ, আমি সফল।

কিন্তু এই নির্ঘুম নির্জন রাতে, যখন কেউ নেই চারপাশে, নিজের ক্ষুদ্রতা আর ব্যর্থতায় কুঁকড়ে থাকি আমি। চাওয়া পাওয়া আর অভিযোগের খাতায় সব পেয়েও পাওয়ার ঘরটা ফাঁকা থাকে আমার। টুকরো টুকরো স্মৃতি বারবার ঘুরপাক খায় আমার মাঝে। প্রতিনিয়ত কল্পনা করি, ঐ পরিস্থিতিতে যদি আমি ওরকম না করে এরকম করতাম, তাহলে আমার জীবনটা কেমন হতো? ইজি চেয়ারের কাছে নিজেকে সমর্পন করে চোখ বুজি আমি, অশ্রুগুলো গড়িয়ে যাবার পথ না পেয়ে আমার চুলগুলোকেই ভেজায় শুধু। রিক যখন আমাকে ছেড়ে যায়, বিশ্বাসই করতে পারিনি আমি।

মেডিকেলে থাকতে অনেক হিন্দি সিনেমা দেখতাম বন্ধুদের সাথে। কে জানতো সিনেমার কাহিনীটাই আমার সাথে হবে? ১ মাস কেটে যাবার পরেও আমি বিশ্বাস করিনি যে রিক চলে গেছে। বারবার মনে হতো রিক অবশ্যই ফিরবে। আমাকে নেটেও খুঁজে না পেয়ে কতদিন আর থাকবে ঐ পোড়া দেশে? কিন্তু জীবন তো আর সিনেমা না, তাই নায়করা শুধু চলেই যায়। ফিরে আর আসে না।

বারান্দার এক পাশে টেবিলে স্তুপিকৃত করে রাখা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। আবির পড়ুক আর না পড়ুক সে সবকিছুর গ্রাহক। কোন এক জীবনে হয়ত সে এক পাতা রবীন্দ্র আর দুই পাতা হুমায়ূন আহমেদ পড়েছিলো, এখন সবই বাকির খাতায়। সবার উপরে তিন মাস আগের পানকৌড়ি ম্যাগাজিনটা পড়ে আছে। আমি জানি ৪৬ নং পৃষ্ঠায় নীরবের কবিতা আছে।

হঠাৎ গত পরশু পৃষ্ঠা উলটাতে গিয়ে নজরে পড়ে নীরবের নাম। অনেকদিন পর নীরবের কথা মনে পড়ে আমার; দশ বছর আগে শেষ দেখা হয়েছে। কেমন আছে এখন নীরব? রোদেলা কি ফিরে এসেছিলো তার কাছে না এখনো সে একাই আছে? আচ্ছা, আমি যদি সেদিন কফিশপে নীরবের হাতটা ধরতাম… এই কবিতাটা কি আমাকে নিয়ে লেখা হতো? নীরব না রোদেলাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছিলো, বইটা কি বেরিয়েছে? অলসতা আর ঈর্ষায় পারিনা খোঁজ নিতে। যদি দেখি রোদেলা ফিরে এসেছে আর আমি আজও রয়ে গেছি একলা। অতৃপ্তি আর অন্ধ ভালোবাসা আমাকে ক্ষুদ্রই করেছে শুধু, আকাশের মত বিশাল করতে পারেনি।

কফিশপে সেদিন নীরবের প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলতে পারিনি, উদভ্রান্তের মত বেরিয়ে এসেছিলাম। আমার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে রিক, হাতে রিকের স্পর্শ। নীরবের হাত আমি কি করে ধরতাম? দিনটার কথা মনে হতে আজ মৃদু হাসি দেই। ২১ বছর বয়স কি অস্থির আর হতবুদ্ধির একটা বয়স! বাস্তব বুদ্ধি যদি আমার থাকতো, এক মুহূর্ত দেরী না করে আমি নীরবের হাতটা ঠিকই ধরে ফেলতাম। তার চার-পাঁচ মাস পর নীরবের সাথে আমার আরো একবার দেখা হয়েছিলো।

নেটবুক কোলে নিয়ে নীরব গাড়িতে বসে ছিলো, আমি সেই টিএসসির মোড়ে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। এক পলকের জন্য চোখাচোখি হয়েছিলো, ভীষন লজ্জা আর ভয় আঁকড়ে ধরেছিলো আমাকে। নীরবের মুখোমুখি হবার সাহস ছিলো না আমার। ব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে তাচ্ছিল্যভরে মুখ ঘুরিয়ে হন হন করে হেঁটে গিয়েছিলাম আমি। একবারো ফিরে তাকাইনি ব্যাথিত সে মুখটির দিকে।

আজকাল নীরবের মুখাবয়ব কল্পনা করতেও আমার কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়, দশ বছর কতটা সময়? রয়ে গেছে শুধু সেই অনুভূতিগুলো, আবেগের কম্পনগুলো, যা কখনো পুরনো হয় না, হবেও না। দীর্ঘ দুইটি বছর লেগেছিলো আমার নিজের ভুল বুঝতে। বন্ধুদের বকা, আশে পাশের মানুষদের ধোঁকাবাজি দেখেও আমি বিশ্বাস করেছিলাম যে রিক ফিরবে; বিদেশ গেলে কি আর এক বছরের আগে ফেরা যায়? দুইটা বছর আমি কোনদিকে তাকাইনি, শুধু বাবার কথা মনে রেখে ডাক্তার হবার চেষ্টায় বই, ওয়ার্ড আর স্যারদের লেকচারের মাঝে ডুবে ছিলাম। এক দুপুরে কলেজ বোর্ডে পাশ করা ডাক্তারদের মাঝে নিজের নাম দেখে বাবাকে ফোন দিলাম, বাবার উচ্ছসিত ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে টের পেলাম, আমি বড় হয়ে গেছি। আমার বাবা এখন আমার মাঝে অবলম্বন খুঁজছেন।

হঠাৎ করে সেদিন মনে হয়েছিলো আমি বুঝি আকাশও চাইলে ছুঁতে পারবো, পৃথিবীর কেউ তাদের সুখের সময় আমায় না খুঁজলেও তাদের দুঃখের সময় আমাকেই খুঁজবে। ইন্টার্নশিপের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিনেই একটা ১৭ বছরের মেয়ে আমার হাতে হাত রেখে মারা গেলো। জীবন-মৃত্যুর এই খেলায় স্তব্ধ হয়ে গেলেও ভেঙ্গে পড়িনি আমি। তার বাবা-মার বুক ফাটা আর্তনাদেও চোখজুড়ে অশ্রু নামেনি আমার। আমি তো আগের নিশাত নেই, আমি এখন ডাঃ নিশাত।

শোকে স্তব্ধ হবার সময় আমার নেই। আমার সেটুকু সময় এখন মেঝেতে পড়ে থাকা তিনটি অবিবাহিত মেয়ের লিভার ফেইলুরের সাথে যুদ্ধ করা জনক আর ঐপ্রান্তের বিছানার লিউকোমিয়ার কাছে অসহায় ছেলেটির জন্য। যে চলে গিয়েছে, তার জন্য শোকাবহল হয়ে সময় নষ্ট না করে আমি যাব তার কাছে যে এখনো বেঁচে আছে। শপথ গ্রহণের দিনটির কথা মনে হলে এখনো কেমন যেন হয়ে যাই। আমিসহ আরো একরাশ সাদা অ্যাপ্রোন পড়া তরুন ডাক্তার শপথ গ্রহণ করছি, “I solemnly pledge myself to consecrate my life to the sercive of humanity”. কি তীব্র আবেগ, সেবা করার কি বলিষ্ঠ শপথ।

দুই নিশাতের মাঝে এখন যোজন যোজন তফাত। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমি প্রথমবারের মত স্বীকার করলাম যে রিক আমার সাথে ছলনা করেছে, সে আর কখনোই ফেরত আসবে না। Though my Love was right, it was for a wrong person. “কি ব্যাপার, তুমি এখানে বসে আছো কেন?” চমকে তাকাই আমি। কখন যেন আবির চলে এসেছে ঘুম থেকে উঠে। ঘুম ঘুম চোখে নীল রাতপোশাকের আবিরের কন্ঠে রাজ্যের বিরক্তি।

“ঘুম আসছে না”। বড় ইচ্ছে করে বলতে, “আবির একটু আমার পাশে বসো না”। বাক্যটা ভোকাল কর্ডে এসে আটকে থাকে, আমি স্পস্ট অনুভব করি। কিন্তু জিহবা অসার আমার। “এত কাজের প্রেসার না নিয়ে একটু রেস্ট নিলে এসব ইনসোমনিয়া আর হতো না।

তা ডাক্তার হয়ে লাভটা কি যদি নিজের চিকিৎসাই না করা যায়? দেখো কি করবা”। আবীর চলে যায়। এতক্ষনের জমাট বাঁধা মেঘ এবার বৃষ্টি হয়ে দু’গাল বেয়ে ঝরে। চমৎকার স্বামী আবির। দেখতে চৌকস, বুয়েট থেকে করা হাস্যজ্জ্বল যুবক।

নিজের ফার্ম আর বিজনেস ভালোই বোঝে সে। মেয়ে বিয়ে দিতে হলে একটি ছেলের মাঝে যা যা খোঁজে বাবা মা প্রতিটি উপাদান চমৎকার ভাবে বিদ্যমান তার মাঝে। কিন্তু চার বছরের বৈবাহিক জীবনে কখনো বলেনি, চলোনা আজকে আমরা বিকেলে একটু হেঁটে আসি লেক বরাবর, হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে গেলে কেমন হয়? কখনো না দেখা ভালোবাসার সমুদ্র দেখার তীব্র সাধে আমি নতুন বউ হয়েও লাজ লজ্জা ভেঙ্গে বলেছিলাম যে হানিমুনে যাবো, সমুদ্রের পাড়ে। বেশীদূর না, আমি কক্সবাজারই যেতে চেয়েছিলাম। আবিরের বাবা-মা অতি উৎসাহে ছেলের আপত্তি কানে না তুলে দুইজনকে পাঠিয়ে দিলেন মালদ্বীপে।

ছবির মত একটি দেশ, পাগলপারা ভালোবাসা উন্মত্ত ঢেউ হয়ে আমাদের ভাসিয়ে নেবার কথা ছিলো, কিছুই হলো না। আবির সাগরের উপরের একটি হোটেলে মুখে বিরক্তিভাব নিয়ে বই নিয়ে বসে রইলো, একবারো জানালা দিয়ে তাকিয়েও দেখলো না। আমি একা একা হেঁটে বেড়ালাম বালুর সৈকত ঘেঁসে। লেমোনেড হাতে সূর্যাস্ত দেখলাম, ভালোবাসার স্বাদ পেলাম না। সাগরের গর্জন ছাপিয়ে শুধু রিকের কন্ঠস্বরই ভেসে এলো, “পারবে কি নুশা? পারবে আমায় ছাড়া থাকতে?” রিকের কন্ঠস্বর অগ্রাহ্য করে দেশে ফিরেই আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমার কাজ নিয়ে।

আর এখন আমি একজন সফল এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট হবার পথে। ডিপ্লোমা হয়ে গেছে, আগামি বছর এফসিপিএস দেবো। ছোট্ট চেম্বারটাতে এখনই ভীড় করে বেশ কিছু রুগী। সব পরীক্ষা একবারে পাস করা নিশাত ভালোবাসার পরীক্ষায় পর পর দুইবার সাপ্লি খেয়ে গেলো। থমকে গেলাম, মেডিকেলে সাপ্লি খেলে আরেকবার পাস করার সুযোগ থাকে।

আসলে আমি ফেল করে গেছি, একে সাপ্লি বলে না। রিক যাবার পর কতদিন আমি কল্পনার সাগরে ডুব দিয়েছি, কল্পনার পাহাড় চূড়ায় গিয়ে রিকের নাম ধরে চিৎকার করেছি; সেসব মনে হলে এখনো গলার কাছটা ব্যথা করে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখা স্বপ্নগুলোতে এমনভাবে তন্ময় হয়ে যেতাম যে ঘুম থেকে উঠেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে রিক ফিরে আসেনি। আর যখন আমি রিককে সম্পূর্ন এড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি, ঠিক তখনই সাড়ে তিনবছর পর সবকিছু তছনছ করে রিক ফিরে এলো। কেন ফিরে এলো রিক? সেদিনটা ছিল অন্য সব দিনের মতই, ভ্যাপসা গরম আর রোদের হলকায় বিপর্যস্ত জীবন।

হাসপাতালে রুগীর প্রেসার ছিলো বেশ। টি ব্রেকে হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার সাধারনত ধরিনা, সেদিন কি মনে করে ধরলাম। কিন্তু ওপাশে কেউ কথা বলছে না। বিরক্ত হয়ে একটু রাগ হয়েই বললাম, “হ্যালো, কথা বলছেন না কেন?” “নিশাত, আমি”।

হঠাৎ করে মনে হয়েছিলো আমার পৃথিবী যেন ওই একটি শব্দে থেমে গেলো। আমি… এই আমিকে আমার চেয়ে ভালো করে কে জানে? এই আমির কন্ঠস্বর দিনের পর দিন আমাকে অন্ধ ভূতের মত তাড়া করে ফিরেছে নির্জন গলি আর কোলাহল মুখর ক্যান্টিনে। কলিগরা সবাই তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে, ওরাও ধরতে পেরেছিলো যেন কিছু হয়েছে। আমার পায়ের সাথে বাঁধা তিনমনি ওজনের পাথর সহ পাটাকে জোর করে টেনে করিডোরে নিয়ে গেলাম। প্রাণপনে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করলাম, “কেমন আছো রিক?” “ভালো, অনেক বেশী ভালো”।

বুকে শেল বেঁধে আমার; ভালো তো রিক থাকবেই। আমার ইমোশনের কোন মূল্য কি কখনো রিকের কাছে ছিলো? অবলীলায় আমাকে দূরে ঠেলে রিক চাকচিক্যের শহর প্যারিসে ভাল তো থাকবেই। “কবে এসেছো রিক?” “প্রায় ছয় মাস, তুমি যে এত অভিমানী ভাবতে পারিনি”। আমি যে কি উত্তর দিয়েছি আমি তার কিছুই জানি না। শুধু মনে আছে শক্ত করে গরম চায়ের কাপটা মুঠো করে ধরে ছিলাম আমি।

মানব জাতির স্বাভাবিক রিফ্লেক্সে যে উত্তর মাথায় আসছিলো তাই বলছিলাম আমি। আমি যে প্রস্তুত ছিলাম না, আমি যে রিককে ছাড়া বাঁচতে শিখে নিয়েছি ততদিনে। রিক দেখা করতে চাইলে আমি না করে দিয়েছিলাম। “ক্যাফে ম্যাংগো, বিকাল ৪টা” শব্দ কয়টা উচ্চারণ করেই রিক ফোন কেটে দিলো, সে জানতো এইই চারটি শব্দই যথেষ্ট ছিলো। রিকের অ্যা্রোগেন্ট ভাব আর আমার সহ্য হচ্ছিলো না।

কি অল্প কয়েকটা কথাই না সে বললো, যেন আমি তুচ্ছ কেউ। হাত পা কাঁপছিলো আমার, মনে হচ্ছিলো অজ্ঞান হয়ে যাবো। সারাটা রাত ক্লিনিকে কি এক অস্থিরতায় পার করেছি সে আমিই জানি। শেষে বুঝলাম, না গিয়ে আমার উপায় নেই। নিয়তি আমায় এমন বানিয়েছে, রিকের জন্য আমার অপেক্ষা আসলে সারা জীবনের।

যাবার আগে একনজর নিজের উপরেও বুলিয়ে নেই। আমি আরো শুকিয়ে গিয়েছি, চোখের নিচে রাত জাগায় হালকা কালি। প্রসাধনহীন মুখে ক্লান্তির ছায়া। একজনের চোখেই শুধু সুন্দর হতে চেয়েছিলাম আমি, সে একজনের সাথে দেখা হবার দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম এক রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুরে ক্যাফে ম্যাংগোতে হাজির হই আমি। দীর্ঘ ৩ বছরে একটিবারও এই পথ মাড়াইনি আমি।

পরিচিত টেবিলটি খালি দেখে শিশুর মত খুশী হয়েছিলাম, অভ্যাসবশত চোখ চলে গিয়েছিলো নীরবের টেবিলের দিকে। এক জোড়া কপোত কপোতি কফি আর ভালবাসার গল্পে মগ্ন, নীরব নেই। সেদিনও রিক আগের মতই দেরী করেছিলো, ক্লাসিক রিক। চোখ বন্ধ করলেই এখনো দৃশ্যটা দেখতে পাই আমি; নেভী ব্লু জিন্স আর সাদা শার্টে রিক আমার সামনে এসে দাঁড়ানো। আমি কিছুই বলতে পারিনি অনেকক্ষণ, রিক… এত দিন পর? যেদিন রিককে শেষ দেখেছিলাম সেদিন সে কি পোষাকে ছিলো? স্মৃতি প্রতারণা করে, কিছুই মনে পড়ে না।

জোর করে শক্ত হই আমি, “আজকেও অপেক্ষায় রাখলে রিক?” পুরনো অজুহাতটা শুনে কি ভালো লাগাতেই না ভরে গিয়েছিলো আমার ভিতরটা। রক্ত মাংসের রিক আমার সামনে ছিলো, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারতাম আমি। তিন বছর ধরে আমি লাল নীল আর কালো রঙের একটা বাক্সে বন্দি ছিলাম, রিক যেন তাতে সবুজ রঙের স্পর্শ বুলাতে এসেছে। কিন্তু আমি কি রিক কে বিশ্বাস করতে পারবো? “নিশাত, আমি চলে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে দুজনের অজান্তে সেই বৃষ্টিতে যা হয়েছিল তার জন্যে আমি কিংবা তুমি দুজনের কেউ দায়ী ছিলাম না, আমাদের পরিবেশ আর পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল নিশাত। “ আমি থমকে যাই, এতদিন পরে এটাই রিকের প্রথম কথা? যে স্পর্শের ছোঁয়া আর কল্পনার শিহরণে একাকিত্বের মুহূর্তগুলোকে আমি সজীব করার ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন ছিলাম, সেটা রিকের কাছে এখনো অপরাধ আর দায়বোধ? আমায় রিক বোঝেনি, কখনোই বোঝেনি।

আচমকা রূঢ় হয়ে যাই আমি। “সে অনেক পুরনো কথা রিক। ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এখন আর নেই। তার চেয়ে বলো তুমি আমাকে কেন ডেকেছো”। রিক উত্তরে অনেক কথা বলে, সারমর্ম একটাই।

এতদিন পরে সে বুঝতে পেরেছে যে আমিই ছিলাম তার ভালোবাসা। কেন যেন কথাটা আমার বুকে আলোড়ন তোলেনি। যে কথাগুলোর জন্য প্রতিটি ক্ষণ প্রতিক্ষায় ছিলাম, কথাগুলো বড্ড মেকি আর ফাঁপা শোনালো আমার কানে। “তাই?” “নুশা আমি অভিনয় করছি না, আজকে আমি বাস্তবতার কথা বলছি। আমার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ইমাজিনেশনে ছিলে তুমি, তুমি আছো তুমি থাকবে নিশাত।

শেষ বারের মত একবার বিলিভ করো আমাকে……” রিকের কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি আমি। “রিক, তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? তাহলে আমি কি কিছু বলতে পারি?” “নুশা… প্লিজ…” “রিক, এটা সত্যি কথা যে আমি তোমাকে ভালবাসতাম, এখনো বাসি। এটাও সত্যি যে আমার জীবনে আমি তুমি ছাড়া কাউকে কখনো কল্পনাও করিনি। কিন্তু তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছো রিক। তুমি কি জানো রাতের পর রাত আমি সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখে আর চোখের জল ফেলে কাটিয়েছি? তুমি কি একবারো খোঁজ নিয়েছো এই তিনটা বছর আমি কিভাবে নিজেকে সামলিয়েছি?” “নিশাত…” আমি রিককে থামিয়ে দেই, “তুমি যে নুশাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে সে এখন মৃত।

তোমার সামনে এখন ডাঃ নিশাত বসে আছে, যার কাছে রিক শুধুই একটা ছায়া মাত্র। যার কাছে অতীতের চিন্তা করা বিলাসিতার নামান্তর”। “আবার সব ঠিক হয়ে যাবে নিশাত। আমি তুমি, আমরা দুজনে মিলে ঠিক করে নেব। “ “একবারো কি খেয়াল করেছো যে তুমি এখন আর আমাকে নুশা ডাকতে পারছো না? আর তুমি বলছো আমরা সব ঠিক করে নেবো? আমি সরি রিক, আমাকে ক্ষমা করে দিও।

সন্ধ্যা ছয়টায় আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে, আমাকে যেতে হবে। দয়া করে আর কোন যোগাযোগ করো না। অনেক কষ্ট দিয়েছো, এখন একটু শান্তিতে থাকতে দাও”। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া রিককে আমি কফিশপেই রেখে জীবনে প্রথমবারের মত উঠে এসেছিলাম। চোখের জল লুকানোর কোন চেষ্টা করিনি, এতো স্বাভাবিক।

একবারও পিছে ফিরে তাকাইনি, হয়ত রিকের চোখে চোখ পড়লে আবার টালমাটাল হয়ে যেতাম। আজ এত বছর পর বিষন্ন এই রাতে বুকের মাঝে নতুন করে হাহাকারের জন্ম হয় আমার। কি হত, কি হত যদি আমি রিককে ফিরিয়ে না দিতাম? এখন আমার জীবন কেমন হতো যদি রিক থাকতো আমার পাশে? নির্ঘুম রাত গুলোতে কি রিক আমার পাশে বসে থাকতো না? প্রতি বছর কি একবার আমরা সমুদ্রের বুকে যেতাম না? গোধূলি লগ্নে লালচে আকাশের নিচে কি আমি আর রিক বালুতে পা ঘষে ঘষে হাঁটতাম না? হয়ত সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি কফি বানিয়ে রিকের ঘুম ভাঙ্গাতাম, পিছনে ফুল ভলিউমে অর্ণবের গান বাজতো। রাতে ডিউটি শেষ করার পর রিক আমাকে বাসায় নিয়ে আসতো। ডিপ্লোমা ডিগ্রীর কাগজটা নেবার সময় রিক ক্যামেরা হাতে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো।

হয়ত এতদিনে একটা ছোট্ট শিশু আমাদের দুইজনের মাঝে ঘুমাতো। কে আগে বাবুকে চুমু দেবে সেটা নিয়ে ঝগড়া হতো। আর ভাবতে পারিনা আমি, শান্তি স্নিগ্ধ একটা জীবন না পাওয়ার বেদনায় আচ্ছন্ন আমি ফুঁপিয়ে উঠি। হঠাৎ চোখ খুলে কেমন যেন মনে হয় আমি বুঝি তিন বছর আগের সেই কফিশপেই আছি, আমার সামনে কাঁচের টেবিল। টেবিলের উপর একটা কোল্ড কফি, রিকের সামনে ধূমায়িত কফি।

রিকের দিকে চোখ পড়তেই হাসি আমি, রিক কফিতে চুমুক দেয়। আমি টেবিলের দিকে তাকাতেই চমকে উঠি, এ কোন নিশাতের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে? এ যে বর্তমানের আমি, শ্রান্ত ক্লান্ত সব পেয়েও কিছু না পাওয়ার অতৃপ্তিতে ভোগা আমার প্রতিবিম্ব। ব্যথিত চোখে আমি নিশাতের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকি, ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে ফেলা এক পরাজিত নারীর প্রতিবিম্ব। রিকের কথাঃ সূর্যাস্তে ভালোবাসার রোদন - রিয়েল ডেমন নীরবের কথাঃ আলো-আধাঁরি - নীরব০০৯ প্রচ্ছদঃ বোকা ছেলে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।