আকাশ ভরা গাঙচিল
কাগজের খেলাঘর
রোদেলার একটা চমৎকার বিষয় আছে, সে যখন কারো উপর বিরক্ত হয় তখন চোখটা ছোট করে যথা সম্ভব কোটরে ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিরক্তি নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টি সবার কাছে ভাল না লাগলেও আমার কাছে খুব ভাল লাগে। এই যে এখন সে ঠিক সেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু একটু করে হাসছি আর রোদেলার চোখ ক্রমাগত ছোট হচ্ছে।
রোদেলার রেগে যাওয়ার কারণটা খুব তুচ্ছ।
আজ ক্যাম্পাসে আরিয়ানের সাথে বেশ হেসে হেসে কথা বলছিল। আমি ওর সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম অথচ সে আমার দিকে তাকাল না। বিকেলে ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসতে বলল। মেজাজটা গরম ছিল সকালের ঘটনায়। রুমে শুয়ে ছিলাম।
কোন কাজ ছিল না। একটু আগে একটা ছবি আঁকলাম। একটা মেয়ে। গায়ের রঙ গাঢ় নীল। মুখে বিচিত্র খাঁজ কাঁটা।
হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু বীভৎস ধরনের ছবিটা। ছবিটা কেন আঁকলাম তা জানি না। কোন মানে খুঁজে পাচ্ছি না। হাতে তুলি নিয়ে শুয়ে শুয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় রোদেলার ফোন।
ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে যেতে হবে। ইচ্ছে হল বলি, বিজি আছি। যেতে পারব না। কিন্তু না বলতে গিয়েও হ্যাঁ বলে দিলাম।
বিকেল ৪ টা।
আমি বসে আছি ক্যাফে মেঙ্গোর ডান পাশের এই ফাঁকা অংশটাতে। আমরা প্রায়ই এখানে আসি। আর আমাদের এই জায়গাটাও নির্দিষ্ট। সবসময় রোদেলা আমার আগে আসে, আজ আমি চলে এসেছি রোদেলার আগে। ঠিক ৪ টায় রোদেলা এলো।
এসেই মিষ্টি হাসিটা দিয়েই কফির অর্ডার দিল। আমাদের প্রিয় ল্যাতে কফি। আমি আজ চুপ করে বসে আছি দেখে রোদেলা গভীর দৃষ্টিতে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর আমিই কথা বললাম, কি একা কেন? আরিয়ান এলো না?
আমার কথা শুনেই রোদেলা চোখ ছোট করে বসে আছে আর বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলাকে রাগিয়ে খুব ভাল লাগছে।
সকালের প্রতিশোধটা খুব ভাল করেই নিয়েছি মনে হচ্ছে।
রোদেলার সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দুরন্ত দিনগুলোতে। রোদেলা এসেছিল অনেক পরে। তখন আমাদের প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিতির বাঁধনে জড়িয়ে গেছি তবে আড্ডা আর পুরনো সেই স্মৃতি রোমন্থন করার ঘটনাগুলো তখনও ঘটে নি।
সেদিন ক্লাসে সবাই বসে আছি, টিচার আসেন নাই এমন সময় রোদেলা এলো। আমি রুম থেকে বাইরে যাচ্ছি সিগারেট ধরাব বলে। হঠাৎ করেই দুইজন থেমে গেলাম। আমি রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছি আর রোদেলা চোখটা ছোট করে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
আমিও মনে হয় চোখে বিরক্তি টেনে এনেছিলাম। হয়তো সে কারণে রোদেলাই কথা বলল কোন সম্বোধন ছাড়াই, ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাস কি এইদিকে?
আমার হ্যাঁ শোনার পর ছোট একটা থেঙ্কস জানিয়ে রোদেলা ক্লাসরুমে ঢুকে গেল। আমি সৈকতকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় গেলাম।
চা সিগারেট শেষ হয়নি এমন সময় সানির মিসকাল। দৌড় দিলাম ক্লাসে।
স্যার চলে এসেছেন। আমি আর সৈকত পেছনের ডেস্কে বসে আছি। আমার চোখ নীল ড্রেস পড়া একজনকে খুঁজছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সবাই মুখ টিপে হাসছে। ব্যাপার কি??? ও আচ্ছা।
রোদেলার সাথে কথা হয়েছে বলেই এমন টিপ্পনী। যাই হোক, সবার চোখের বাঁকা ভাষা উপেক্ষা করে নীল পরীকে খুঁজে পেলাম। প্রথম থেকে দ্বিতীয় সারির কর্নারের ডেস্কে বসে খুব মন দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে। স্যারের মধুর বাণী শুনতে শুনতে মনে হল কাল রাতে ঘুম হয় নি। ঘুম পরী যেন আমার চোখে ডিম পেড়ে গেল।
এখন ডিমে তা দিতে হবে। মানে এখন না ঘুমালে নতুন প্রজন্ম এই পৃথিবীর আলো ছায়ায় চোখ মেলে তাকানোর সুযোগ পাবে না।
ক্লাসে ঘুম কাটানোর ভাল উপায় চিরকুট চালাচালি করা। গতরাতে ছন্দ আর অক্ষর বিন্যাস মেলাতে মেলাতে যে কালজয়ী বর্ষা কাব্য রচনা করেছি ভাবলাম সেইটাই লিখে পাস করে দেই। কিন্তু পরক্ষনেই থেমে গেলাম।
না থাক, আমার সাধের বর্ষা কাব্য সবার হাসাহাসির পাত্র হয়ে যাবে। কিছু লিখবো বলে চিরকুটের উপর কলম ধরে রেখে বসে আছি এমন সময় সজল সামনের ডেস্ক থেকে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটে লেখা, মামা মামিটা কে?
ঘটনা তো বুঝেই গেছি। আমি লিখলাম, মামিরে রেগ দে। সব বাইর হয়ে যাবে।
ঠিক হল ক্লাস শেষে রোদেলাকে রেগ দেয়া হবে। যথাসময়ে ক্লাস শেষ হল আর আমরা নড়েচড়ে বসলাম। আমাদের মাঝে ছিল ইমরুল কায়েস। ক্লাস মনিটর। কুচকুচে কালো করে দেখতে ছেলেটা মেয়ে ঘেঁষা টাইপের।
মনিটর বিধায় ডায়াসে দাঁড়িয়ে সে নিজেই শুরু করলো, আজ আমাদের মাঝে নতুন একজন এসেছে তাঁকে অনুরোধ করছি ডায়াসে এসে নিজের পরিচয় দেয়ার জন্য।
ইমরুলের এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমি হাসিনি আর এই অর্থহীন হাসাহাসির মানেও বুঝিনি। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু সজলের গলায় মামি ডাক শুনে হাসি আটকে রাখতে পারি নাই।
রোদেলা ডায়াসে দাঁড়িয়েই নিজের কথা বলা শুরু করলো।
যারা রেগ দেয়ার মুডে ছিল তারা মোটামুটি ছোট খাট একটা ধাক্কা খেলো। তবে তারা রোদেলাকে আটকানোর ফন্দি করতে থাকলো।
রোদেলা একে একে তার নাম, স্কুল, কলেজের নাম বলে গেল। কথা শেষ করে বলল, আর কিছু কি বলতে হবে?
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
‘প্রহর শেষে রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ ’
আচ্ছা এখন কি চৈত্র মাস? খুব যে গরম! রোদের ঝলকানিতে চোখ তুলে তাকানো দায়।
ধুর, আমি এসব কি ভাবছি!
কেউ একজন রোদেলাকে বলল, ম্যাডাম আপনি আমাদের একটা গান শোনান। আচ্ছা আপনি গান গাইতে জানেন তো?
রোদেলা উত্তর দিল, হ্যাঁ। একসময় গান করতাম তবে আজ আমার গলা একদম ভাল না। সরি আজ গাইতে পারব না।
কিন্তু কে শুনে কার কথা! গান গাইতেই হবে।
রোদেলার চোখ ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। সে চোখে বিরক্তি নিয়েই বলল, সবাই আমাকে আপনি করে বলছে কেন? আমি তো তোমাদেরই ক্লাসমেট। আচ্ছা ঠিক আছে, গান দু লাইনের বেশি গাইতে পারব না।
সবাই সমস্বরে ঠিক আছে বলে সায় দিল। রোদেলা সেদিন গেয়েছিল শ্রীকান্তর ‘বধুয়া আমার চোখে জল এনেছে হায় বিনা কারণে’ গানটা।
কি মিষ্টি গলা! কি মায়া কাড়া চাহনি। রোদেলার এই গান শুনলে যে কারো চোখে জল চলে আসবে। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রোদেলার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে একটু আগে দেখা সেই সর্বনাশী চোখে নিজেকে পুড়ে যেতে দেখছিলাম।
সে দিনের পর থেকে রোদেলার চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। বলতে গেলে এড়িয়েই চলতাম।
তবে রোদেলা বেশ সাবলীল ভাবে সবার সাথে মিশে যেতে লাগলো। যারা সেদিন রোদেলাকে রেগ দিতে গিয়ে নিজেরাই রেগ খেয়ে পেট ফুলিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে চুপ করে বসে ছিল তারাও রোদেলার বেশ ভাল বন্ধু হয়ে গেল। শুধু বাকি রইলাম আমি।
আমার সাথে রোদেলার বন্ধুত্ব কিংবা আমি বলব ভালবাসা শুরু হয়েছিল আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যাগাজিনের বর্ষা সংখ্যায় আমার কবিতা প্রকাশ হওয়ার পর। রোদেলা প্রথম যেদিন এসেছিল ঠিক তার আগের রাতেই কবিতাটা লিখেছিলাম সারারাত জেগে।
আমার মনে হয় আমাদের পরিচয় বন্ধুত্ব দিয়ে নয় বরং ভালবাসা দিয়েই শুরু হয়েছিল। যদিও রোদেলার কথায় সবসময় একটা বিষয়ই প্রাধান্য পেত যে আমরা আসলে কে? আমাদের দু জনের সম্পর্কই বা কি?
তোমাকে আমার পাশাপাশি দেখলে যতোটা না ভাল লাগে তার চেয়ে তোমার অনুপস্থিতি আমার বেশি ভাল লাগে। এই অনুপস্থিতি এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়। এটুকু শূন্যতাই মনে হয় আমাদের সম্পর্ক। ভালবাসা।
আর আমরা দু জন এই শূন্যতার শুরু আর শেষ। ঐ শূন্যতার পূর্ণতার জন্যই তোমার কাছে আসতে ইচ্ছা করে।
আমার এই কথা রোদেলাকে অবাক করেছিল। সে চোখ ছোট করে নয় বরং মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ঠিক এইভাবে সেদিন তাকিয়েছিল।
ম্যাগাজিনে ‘মেঘ বৃষ্টি প্রেম’ কবিতাটা পড়েছিল। ক্লাসের শেষে সেদিন রোদেলা চুপ করে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল। আমি বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কিছু বলতে যাব এমন সময় সে নিজেই কথা বলল, নীরব তুমি খুব সুন্দর কবিতা লেখ। আচ্ছা সত্যি করে বোলো তো, এ নগরে কি অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না?
আমি একটু লজ্জা পেয়ে কি বলব আর কি বলা উচিত তা ঠিক করতে না পেরে, কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম, আরে কবিতায় তো কতো কিছুই লেখা যায়!
রোদেলা ঝটপট বলল, কবিতায় যা বলেছ তা যেন কবিতাতেই বন্দি থাকে।
এ কথা বলেই রোদেলা উড়ে চলে গেল যেন। আমি চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম। আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো কবিতার লাইনটা
‘অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না
রোদ থাকে সে নগর জুড়ে। ‘
এই টুকু লিখে নেটবুকের পুরনো ফোল্ডার খুলে ‘মেঘ বৃষ্টি প্রেম’ কবিতাটা বের করে পড়ছি। কফির মগ তুলে চুমুক দিতে গিয়ে দেখি কফি শেষ।
আর একটা কফির অর্ডার দিয়ে নেট বুক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আজও মেয়েটা একা একা বসে আছে। ছেলেটা মনে হয় এখনো আসে নি। তাই হয়তো অপেক্ষা। রোদেলাও কি ঠিক এভাবে বসে থাকত? আমার জন্য অপেক্ষা করতো? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপাশের টেবিলে তাকাতেই মেয়েটির চোখে আটকা পড়ে যাই। মেয়েটি যেন বিভ্রান্ত।
কিছু কি ভাবছে সে? না কি তার এই অপেক্ষার ক্লান্তিটা আমি প্রতিনিয়ত দেখছি বলে অসস্থিতে পরেছে?
আজ কি বার? শনিবার। গতকাল এবং গত পরশু ওদের দেখিনি। তারমানে শনিবার, রবিবার আর বুধবার সপ্তাহের এই তিন দিন তারা এখানে বসে। অবশ্যই স্টুডেন্ট। তবে ছেলেটাকে একদম পছন্দ হয়নি আমার।
আমার মনে হয় মেয়েটিকে এভাবেই সারাজীবন অপেক্ষা করতে হবে।
ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রোদেলার প্রিয় কবিতার মাঝে ডুবে গেছি।
মেঘ বৃষ্টি প্রেম
১.
মেঘমালারা তথাপি মেঘ দেখে, জলের বুকে
মেঘ নিয়ে যায় জলের কণাদের, ভালবেসে
জলে মেঘে বেশ গল্প থাকে
গল্প থাকে না এই নগরে
অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না
রোদ থাকে সে নগর জুড়ে
মেঘ জলের শীতল প্রেম ছুঁয়ে যায়, নগরে
মানুষ ক্রমশ আড়াল হয়, বৃষ্টি শেষ হলে।
২.
পথ ফুরোয়, ডানে বামে
বাঙ্গালি যমুনার তীরে
মেঘ ঘন দুঃখরা মিলে
আড়াল হয়েছে বৃষ্টি জলে।
জীবনের সুতো বাঁধা ছিল যে নীড়ে
নীড় ভেঙ্গেছে প্রবল ঝড়ের তোড়ে
শূণ্য বালুচর জ্বলে পুড়ে
জমাট বাঁধে কাঁচের হৃদয়ে।
কাঁচের বুকে বৃষ্টি জমে
অনেক সময় পরে,
ঘরের মাঝে চাতক থাকে
কাঁচের বুকে মেঘ
দেখা হয়নি আজন্ম পরে
অপেক্ষায় থেকেছে প্রেম।
কবিতার মাঝে এতটাই নিমগ্ন ছিলাম যে একদম খেয়ালই করি নি ওপাশের টেবিলে মেয়েটির অপেক্ষার ক্লান্তি শেষ হয়েছে।
নিশাতের কথাঃ আবছা ভালোবাসা - ত্রিনিত্রি।
রিকের কথাঃ ছন্নছাড়া জীবনে নিশাত- রিয়েল ডেমন।
প্রচ্ছদঃ বোকা ছেলে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।