আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কফিশপ- তৃতীয় পর্ব

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... কফিশপ- প্রথম পর্ব কফিশপ- দ্বিতীয় পর্ব নিশাতের কথাঃ মেঘ-রৌদ্রের খেলা অনেকদিন পর আজকে সূর্যোদয় দেখলাম। ছাদের রেলিংএ ঠেস দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত সূর্যের দিয়ে চেয়ে আছি আমি… অপূর্ব এক লালিমায় চারপাশ পরিপূর্ন। শেষ সূর্যোদয় দেখেছিলাম বোধ হয় দুই বছর আগে, কুয়াকাটাতে। আমি ভীষন ঘুমকাতুরে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মাতাল হবার ইচ্ছে পুরোমাত্রায় থাকলেও ঘুমের দেশে স্বপ্নের মাঝে হারানোটা আমার কাছে বেশী উপভোগ্য।

কিন্তু বাবার জন্য পারলাম কই? ভোর পাঁচটায় টানতে টানতে নিয়ে গেলো সৈকতে। ঘুম ঘুম চোখে কৌতুক নিয়ে দেখছিলাম আমার পঞ্চাশোর্ধ বাবার আহলাদ আর মার সাথে প্রেম। হঠাৎ রক্তাক্ত আভায় আকাশ জেগে উঠতেই আমি অবাক হয়ে দেখি সাগরের ঠিক মাঝখানে ডিমের কুসুমের মত একটা সূর্য উদিত হচ্ছে, বিশ্বসংসারকে যেন জানান দিচ্ছে তার শ্রেষ্ঠত্ব। মাতাল করা সে আবহাওয়ায় আমি কিছু না বুঝেই হেঁটে চলছিলাম সূর্যের দিকে, আচ্ছন্ন এক নির্বোধের মত। ঢেউএর পর ঢেউ এসে আমাকে সাবধান করেছিলো, “ফিরে যাও নিশাত।

আমি এক সর্বনাশা প্রেম”। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেয়েছিলাম আমি সেই প্রেমকে। হঠাৎ মার চিৎকারে বাস্তবে ফিরে দেখি আমার কোমরের উপর পর্যন্ত জল, সর সর করে সরে যাচ্ছে পায়ের নিচের বালি, আমি ডুবে যাচ্ছি। প্রচন্ড ভয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। সাগরের নোনা জল নাক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে কখনো না পাওয়া সেই প্রেমের আবেগকে গ্রাস করেছিলো এক মুহূর্তে।

আমাকে পানি থেকে উঠিয়ে এনে বাবা বুকে চেপে ধরে রেখেছিলো অনেকক্ষণ, স্পস্ট শুনেছিলাম বাবার হৃদপিন্ডের ধুক ধুক শব্দ। এতদিন ভুলেই ছিলাম সেই ভয়ংকর অনুভূতি, হঠাৎ কাল বিকেলের পর ফিরে ফিরে আসছে অনুভূতিটা। রাতে অনেকবার ঘুম ভেঙেছে আমার, মনে হচ্ছিলো কিছু যেন বুকের উপর চেপে বসে আছে। একটা কষ্টের দলা, অথবা জমাট বাঁধা ভালোবাসা। মনের অজান্তেই একবার আঙ্গুল নিয়ে স্পর্শ করলাম নিজের ঠোঁট, দম বন্ধ করা সে অনুভূতি।

কাল সকালে রিক যখন ফোন করে তখন আমি ক্লাসে। রিকের সকাল শুরু হয়ে দুপুরে, তাই স্ক্রিনে রিকের নাম দেখেই চমকে উঠেছিলাম। জানি না কেন আজকাল এরকম হয়। গতানুগতিকের বাইরে কিছু হলেই ভয়ে শিউরে উঠি, কোন খারাপ খবর নয়তো? রিকের সান্নিধ্য পাবার জন্য রবিবারে ক্লাস অফের মিথ্যে অজুহাত দিয়ে দিলাম। এরকম অজুহাত আমি অসংখ্যবার দিয়েছি।

যখন যেদিন রিক ফোন করে, সেদিনই আমার অফ ডে। রিকের একদিনও সন্দেহ জাগে না যে একটা মেডিকেলের ছাত্রীর শুক্রবার ছাড়া অফ থাকে কি করে। আসলে রিক এসব মনে রাখার দরকারও বোধ করে না। জানতাম সে আড়াইটায় কখনো কফিশপে থাকবে না, তারপরেও লাঞ্চ না করেই সোয়া দুইটা থেকেই কফিশপে বসে ছিলাম। রিকের জন্য অপেক্ষা, ক্ষণে ক্ষণে ঘড়ি দেখা আর বুকের মাঝে অস্থিরতা… উফফ, কে বলে ভালোবাসা শুধু কবিদের পসার বাড়ানোর হাতিয়ার? পেছন থেকে রিক এসে চোখ চেপে ধরতেই আমি কেঁপে উঠেছিলাম।

রিক জানা সত্ত্বেও হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিলাম ওর হাত। কিন্তু রিককে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছিলো। অস্থিরতা নেই; কেমন যেন উদভ্রান্ত ভাব, যেন নিজের সাথে যুদ্ধ করছে। ঘোরলাগা অদ্ভুত দৃষ্টি অস্বস্থিতে ফেলে দিয়েছিলো আমাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দেরী করার জন্য অভিমানী ভাব দেখানো শুরু করলাম।

“আহা নুশামনি! তুমি স্কুলের মিস এর মত আমাকে উপদেশ দিতে থাকো কেন? তারচেয়ে ভালো কফি অর্ডার করি, তাছাড়া আজ একটা প্ল্যান আছে”। বুক আবার দুরু দুরু করে ওঠে আমার, প্ল্যান? রিকের কোন সারপ্রাইজই এপর্যন্ত আমার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি। “নুশা, আজ সারা বিকেল তুমি আর আমি রিকশায় করে ঘুরব”। যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বললাম, “আর তোমার বাইক”? আস্তে করে আমার কপালের চুল সরালো রিক, কিছু একটা বললোও সাথে। কিন্তু আমি কিছু শুনলাম না।

চুলের নাকি অনুভূতি নেই? তাহলে রিক আমার চুল স্পর্শ করলেই আমার সমস্ত অস্তিত্ত্ব এভাবে কেঁপে ওঠে কেন? কি ভীষন ভালো লাগায় ভরে যায় চারিদিক। আল্লাহকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দেই যে একজন মানুষ আরেকজনের মনের কথা বুঝতে পারেনা। যদি রিক এসব বুঝতো তাহলে সুইসাইড ছাড়া আমার উপায় থাকতো না। বিকেলে রিকের সাথে রিক্সায় উঠতেই আকাশ কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলো। প্রকৃতিও মনে হয় চায় না যে আমরা একটু শান্তিমত আন্তরিক সময় কাটাই।

আর রিকের মাথাও আজ এমনি নষ্ট ছিল, যে ছেলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতেও রেইনকোট ছাড়া নড়ে না; সে আজকে বৃষ্টিতে ভিজবে। ঠিক উপন্যাসের মতই আমরা রিক্সাতে ওঠা মাত্র বৃষ্টি শুরু হলো, ঢাকা ভার্সিটিতে দেখলাম অজস্র লাল, বেগুনি আর হলুদ ফুলে ছেয়ে গিয়েছে রাস্তা। বৃষ্টিস্নাত পথ, নির্জন রাস্তা আর রিকের সান্নিধ্য – কি যে হলো আমার মাঝে নিজেই বুঝলাম না। অসঙ্কোচে রিকের হাতটা ধরলাম, এই মুহূর্তটার স্বপ্নেই বুঝি কেটেছে আমার সারাটি কিশোরীবেলা। রিকের তীব্র দৃষ্টির সামনে নিজেকে ভীত কবুতর ছানা মনে হচ্ছিলো; এক মুহুর্তে রিক কি ভীষন রকম অচেনা হয়ে গেলো।

তপ্ত একজোড়া ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ওপর অনুভব করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। রিকের বাহু শক্ত করে চেপে ধরলাম; প্রাণপণে বোঝাতে চাইলাম, “please, don’t let me go”. হঠাৎ করেই যেমন কাছে এসেছিলো, তেমনি হঠাৎ করেই রিক দূরে সরে গেলো। কেমন ঘোরের মাঝে সময় কাটলো, হঠাৎ দেখি আমার হোস্টেল এসে গেছে। রিক নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো, একটা কথাও বললো না। বিশাল এক শূন্য মাঠের মাঝখানে আমাকে একা ফেলে রিক চলে গেলো।

কি লজ্জা, কি লজ্জা। ভাগ্যিস আমার সামনে এখন কোন আয়না নেই। আমি নিশ্চিত যে আকাশের লালিমা এখন আমার দুই গালে আর কানে শোভা পাচ্ছে। ক্লাসের ফাঁকে বা ওয়ার্ড থেকে ফেরার সময় অথবা ক্ষনিকের বৃষ্টির অবসরে লাজুক মনে এতদিন যে ভালোবাসার স্কেচ আমি কল্পনার পেন্সিলে আঁকতাম, তাতে রঙ বসানোর জন্য রিক আমার হাতে রঙতুলি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। রেলিংএর উপরে রাখা মোবাইলটা আরেকবার চেক করলাম, নাহ রিকের কোন মেসেজ নেই।

ভীষন কথা বলতে ইচ্ছে করছে, ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে রিকের চিন্তার প্রতিটি জাল। কি ভাবছে সে এখন? কেন ফোন করছে না? বারবার স্ক্রিনে রিকের নাম এনে কল কেটে দেই… কিসের এক দ্বিধায় ফোন করতে পারিনা। হঠাৎ মোবাইলে টুং টুং শব্দ শুনে কাঁপুনিতে মোবাইল হাত থেকে ফেলে দেই; রিকের মেসেজ? মোবাইল তুলে দেখি রিমাইন্ডার বাজছে, সকাল সওয়া সাতটা বেজে গেছে কোন ফাঁকে। নিজেকে শোনাই, “ক্লাসে যাবার সময় হয়েছে নিশাত!” সকাল ১০টায় ফার্মাকোলজী লেকচার শেষ করেই হুড়মুড় করে ক্লাসরুম থেকে বেরুচ্ছি, আসিফ আটকালো। “কিরে, এভাবে দৌড়ে কই যাস?” “আরে দোস্ত, আজকে ওয়ার্ডে মুকুল স্যার সিভিএস আইটেম নিবেন।

একবারো প্রাকটিস করিনাই”। “হেহেহে, তুই এখনো জানোস না? স্যার তো আজকে আসবেন না, আইটেম ক্যান্সেল”। অপ্রত্যাশিত সংবাদে লাফিয়ে উঠলাম আমি। “বলিস কি!” পরমুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে গেলো। আইটেম না হলেও বা কি? ক্লাস অফ পাওয়ার জন্য তো আর রিককে ফোন করা যাচ্ছে না।

রিক কেন এখনো ফোন করছে না? সময় কাটানোর জন্য আজিজ সুপারের দিকে রওনা হলাম। বিদিতে আজকে আমি মনের আশ মিটিয়ে বই ঘাটবো। নতুন বইএর ঘ্রাণ নেবো, বুকে চেপে অনুভব করবো শব্দাবলী। “নিশাত না? কি খবর?” ওয়েডিং সং বইটা থেকে মুখ তুলে অপ্রত্যাশিতভাবে নীরবকে দেখে চমকে উঠি আমি। “আরে, আপনি এখানে! অফিস ফাঁকি দিয়ে বই ঘাটছেন?” নীরব শব্দ করে হেসে ফেলে।

“এভাবে অ্যাকিউজ করলে কেমন হবে? অফিস ফাঁকি দেইনি, ছুটিতেই আছি। তা ডাক্তারদের কি সকালে ক্লাস থাকে না নাকি?” কপট রাগ দেখালাম আমি। “আজকে আমার ক্লাস অফ। আমি কিন্তু সিরিয়াস স্টুডেন্ট”। “তা কি বই কিনছো?” “এখনো জানি না, যেই বইএর ঘ্রাণ পছন্দ হবে সেটাই নেবো”।

নীরবের চোখে কৌতুক খেলে গেলো, “বইয়ের ঘ্রাণ তো আর লেখার মানের উপর নির্ভর করে না। এখন যদি বিদিশার এরশাদের লেখা বইয়ে তুমি ফুলের সুবাস পাও, তখন?” থতমত খেয়ে চুপ করে গেলাম আমি, মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো হঠাৎ করেই। বয়সে ছোট পেয়ে ফাজলামি করছে? “আপনি এত খোঁচা দিয়ে কথা বলেন কেন?” “সরি সরি। আরে এমনিতেই বলেছি। বইয়ের ঘ্রাণ আমারো খুব পছন্দ”।

“এখন পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বানিয়ে বানিয়ে বলছেন?” “বাপ্রে, এক কথা বলে তো ভালো ঝামেলায় পড়লাম। তা ডাক্তার সাহেব, বই কেনার পর কি আমি আপনাকে এক গ্লাস লাচ্ছির দাওয়াত দিতে পারি? পেনাল্টি হিসেবে?” “হু পারেন, তবে যদি ডাসের লাচ্ছি হয় তবে”। নীরবের ডান ভুরু একটু উঁচু হলো। “ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র নই, সেজন্য ডাসে খুব কম যাওয়া হয়েছে। দেখি আজকে ডাস কেমন লাচ্ছি বানায়!” ডাসের পিছনে লাচ্ছি হাতে একটা গাছের নিচে বসে আছি আমরা।

আজকের আবহাওয়া ভালো না, গরম বাতাস যেন মুখের সাথে আঠালো হয়ে সেঁটে যাচ্ছে। “তারপর? আর কি খবর তোমার? আর তোমার বন্ধুর?” “উমম, ও আছে, ওর মতো। আমি আছি, আমার মতো”। “চমৎকার উত্তর। কিছুই বোঝার উপায় নেই কার মনে কি চলছে”।

হেসে ফেললাম আমি। “আপনি কি ম্যাগাজিন কিনলেন এটা, পানকৌড়ি নাকি?” “হ্যাঁ”, ম্যাগাজিনটা আমার হাতে দিলো নীরব। “পেজ নাম্বার ৩৮টা খোলো। তিন নাম্বার কবিতা”। “আপনি রাইটার, মানে লেখালেখি করেন?” বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলাম আমি।

“এত চোখ বড় করে তাকানোর কোন দরকার নেই। যে লেখে সেই রাইটার। আমাকে শব্দের কারিগর বলতে পারো”। শব্দের কারিগর! অবশ্য পানকৌড়িতে যার লেখা ছাপা হয় সে যদি ভাব না মারে তবে কে মারবে? আমি লাচ্ছি পাশে রেখে পত্রিকাটা খুলি। তিন প্যারার ছোট্ট কবিতাটায় আবেগের মেঘ জমাট বেঁধে যেন বৃষ্টি নামাতে চাচ্ছে, কিন্তু রোদের প্রকোপে পারছে না।

অজান্তেই আবৃতি করে উঠি, “জলে মেঘে বেশ গল্প থাকে গল্প থাকে না এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না রোদ থাকে সে নগর জুড়ে”। হঠাৎই নীরবকে আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে হলো। কোথা থেকে পাশ করেছে, প্রথম বইপড়া, অতর্কিত প্রেম, আর ভবিষ্যতের ভাবনা- সবকিছুই। কিছু না ভেবেই হঠাৎ বলে বসলাম, “আচ্ছা, সত্যি কি এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না?” নীরবের হাত থেকে লাচ্ছি একটু চলকে পড়ে গেলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।

নীরবের চোখে ইমোশন যেভাবে খেলা করে, সেরকম আর কারো দেখিনি। তার ভেতরের সব চিন্তাই যেন চোখে ফুটে ওঠে। এই যেমন এখন দেখেই মনে হচ্ছে ঝড় বইছে তার মনে, কবিতার ঝড় কি? অদ্ভুত গলায় থেমে থেমে বললো সে, “এটা…একটা কবিতা…শুধু কবিতা…”। অদ্ভুত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, আমি কি পুরনো কোন আঘাতে নতুন করে খোঁচা দিয়েছি? এক চুমুকে বাকি লাচ্ছিটুকু শেষ করলো নীরব। “আমার একটু যেতে হবে।

আমাকে যদি কখনো দরকার হয়, তুমি জানো আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে। যাই আজকে”। একবারও পিছনে তাকালো না নীরব। সামনে রিক্সা আসতেই উঠে বসলো। ভীষন অবাক লাগল আমার।

হঠাৎ কি হলো? যা ইচ্ছে হোক, আমার কি? লাচ্ছিটা শেষ করে মোবাইলটা আরেকবার চেক করলাম, নাহ রিকের কোন পাত্তা নেই। হঠাৎ ভীষন জেদ চেপে বসলো আমার মাঝে। দেবো না ফোন, রিক ফোন না দিলে কখনোই দেবোনা। ভালোবাসার দায় কি শুধু আমার? রিক আমাকে চায় না? চোখের কোণে জ্বালা করতে থাকে। অভিমানের বাস্প জমাট বেঁধে জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে চায়, জোর করে নিজেকে সামলিয়ে রিক্সার খোঁজে হাঁটি আমি।

ভীষন তপ্ত রোদে মনের মাঝে একটা লাইন ঘুরপাক খায়, “অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না, রোদ থাকে সে নগর জুড়ে”। সাতটা দিন পেরিয়ে গেলো, রিকের এখনো কোন খবর নেই। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। সাতটা দিনে এক মুহূর্তের জন্যও মোবাইলটা কাছছাড়া করিনি। শব্দ হলেই অস্থির হয়ে যায় মন, ভাবি রিক কিনা।

চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে আমার, রিক এমন কেন করছে? এর মানে কি সে আমাকে ভালোবাসে না? ক্ষণিকের ভুলের জন্য অপরাধবোধে ভুগছে? ভালোবাসার কয়েক সেকেন্ডের স্পর্শ রিকের কাছে এখন পাপ? অপমানের খোঁচায় রক্তাক্ত হতে থাকি আমি প্রতিটি মুহূর্তে। রাত আড়াইটায় আর থাকতে পারিনা আমি, নিজের অহংবোধ আর আত্মসম্মান জলাঞ্জলী দিয়ে রিককে ফোন দেই। ওপাশে অর্ণবের “হারিয়ে গিয়েছি” গানটা শুনতে শুনতে লালচে মুখে পাশবালিসটা শক্ত করে চেপে ধরি। নিজের হার্টবিট নিজেই টের পাচ্ছি। ১০ সেকেন্ডকে আমার মনে হয় দীর্ঘ ১০টি বছর।

“হ্যালো?” “রিক?” কেঁপে ওঠে আমার গলা। “কেমন আছো তুমি?” রিক চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ আমার ভিতরের জমানো অভিমান আর ক্ষোভ বন্যার জলের মত তোলপাড় করে বেরিয়ে আসে। হড়বড় করে কথা বলতে থাকি। অনেক প্রশ্ন আমার, অনেক জমানো কথা।

যান্ত্রিক কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছে, হট্টগোল। রিক কোথায় যাচ্ছে? আর্তচিৎকার করে উঠি আমি। “তোমাকে বলা হয়নি, প্যারিসের উদ্যেশ্য কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার ফ্লাইট ছাড়বে”। প্যারিস? আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। অন্ধকার এক গর্তে অসহায়ের মত পড়তে থাকি আমি।

“রিক… আমি…” হঠাৎ গ্রাস করা শূন্যতাকে আমি প্রাণপণ চেষ্টাতেও সরাতে পারিনা। মোবাইলটা সুইচ অফ করে দেই। আজ আমার কান্না আসে না; শুকনো চোখে সামনের দেয়ালে ঝোলানো কার্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি, আমার জন্মদিনে রিকের দীর্ঘ মেসেজ। প্রতিদিন ঘুমুতে যাবার আগে আমি একবার করে শেষের লাইনটা পড়ি, “doc, heal me from all these sorrow and I’ll follow you in your afterglow”. তার দুঃখগুলো আপন করে নেবার সুযোগ রিক আমাকে দেয়নি, আমার আর কার্ডটার প্রয়োজন নেই। অক্ষম আক্রোশে কার্ডটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করতে থাকি আমি।

২। ফরেনসিক মেডিসিনের ভাইবা পরীক্ষা দিয়ে কলেজের করিডোরে এসেই বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম আমি। আহ, কি শান্তি! ১৭দিন ধরে টানা পরীক্ষাই দিয়ে যাচ্ছি, টার্ম পরীক্ষাগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন? হোস্টেলে ফিরে ক্যালেন্ডারে বিজয়ীর মত শেষ তারিখে টিক চিহ্ন দিলাম। সাথে একটা ছোট ধাক্কাও খেলাম। রিক দেশ ছেড়েছে প্রায় ১ মাস।

কেমন আছে রিক? প্যারিসে নাকি অনেক ঠান্ডা?তুষারপাত কি হয় ওখানে? ফায়ার প্লেসের সামনে গুটিশুটি হয়ে বসে কি আমার কথা মনে পড়ে ওর? চোখ ধাঁধানো শুভ্রতা আর ধোঁয়াটে আচ্ছন্ন আকাশ কি ওকে একাকী করে না? রাস্তায় হাত ধরে হেঁটে বেড়ানো ভালোবাসার চাদরে মোড়া যুগলদের দেখলে কে ওর বুকে ধাক্কা লাগে না? আমি জোর করে ভাবি, রিক ভালো নেই। রিক অনেক কষ্টে আছে। আমার ফেসবুক ডিএকটিভ করা, মোবাইল নাম্বার বদলে ফেলেছি। আমার ভাবতে ভীষন ভালো লাগে রিক পাগলের মত ফেসবুকে আমার নাম লিখে সার্চ দিচ্ছে, আতি পাতি করে খুঁজছে আমার ফোন নাম্বার, পাগলের মত মেইল পাঠিয়ে উদভ্রান্ত করে দিচ্ছে আমার ইয়াহু ইনবক্সটাকে। চাপা দীর্ঘশ্বাস বুকে চিড়ে বের হয়।

পরীক্ষা শেষে আজকে হোস্টেল বলতে গেলে ফাঁকা। সবাই হয় মামা-খালার বাসায় নতুবা মনের মানুষের হাত ধরে লিখছে তাদের গল্পের নতুন চ্যাপ্টার। সবাই জানে রিক চলে গেছে। তাদের করুণামিশ্রিত দৃষ্টি সারাক্ষণ ঘুরপাক খায় আমার চারপাশে। হঠাৎ করেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।

ঝটপট রেডি হয়ে নিলাম। উদ্দেশ্যহীনের মত হাঁটতে শুরু করলাম। “মামা, কোথাও যাবেন নাকি?” আমি অবাক হয়ে শুনি আমি বলছি, “মামা, ধানমন্ডি পাঁচ, গ্রীনরোডের দিকে”। আমার আমি কারো সঙ্গ পেতে চাইছে, চিৎকার দিয়ে অচেনা কাউকে শোনাতে ইচ্ছে হচ্ছে মনের সব কথা। চেনা মানুষের করুণাভরা দৃষ্টি নয়, অচেনা কারো সহমর্মিতা আমার ভীষন প্রয়োজন।

দুই চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে, আটকানোর চেষ্টা করলাম না আমি। শূন্য থেকে শুরু করবো আমি আমার জীবন, একদম শূন্য থেকে। রিক নামে কেউ কখনো আমার জীবনে ছিলো না, কখনো না। কফিশপে ঢুকেই দেখি নীরব তার নির্ধারিত স্থানে বসে আছে। সাথে সাথে সংশয় আর লজ্জার মেঘ এসে আমায় ঘিরে ধরলো।

কিছুতেই মন সায় দিলো না নীরবের টেবিলে গিয়ে বসতে। আমার আর রিকের টেবিলের দিকে তাকিয়ে নতুন করে জল এলো চোখে। জোর করে শক্ত করলাম নিজেকে। নির্জিব বস্তুর আবার উনিশ বিশ কি? কফির অর্ডার দিয়ে ক্লান্ত ভাবে তাকালাম নীরবের দিকে। সে নিজেই উঠে এলো।

“কি আজ এতোদিন পর যে?” “আমি ভীষন ক্লান্ত, ভীষন। দ্বিধা আর অপূর্ণতার হিংস্র ছোবলে আমি পরিশ্রান্ত। আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনি কি শুনবেন আমার কথা?”- বাক্যগুলো পাগলের মত উঠে এলো আমার ভেতর থেকে। কিন্তু মুখে বললাম, “এইতো…”।

যেন এই একটি শব্দে অচেনা এই ছেলে সব বুঝে যাবে, চেনা রিক ২ বছরে যা বুঝতে পারেনি। প্রাণপনে প্রার্থনা করছি যেন রিক সম্পর্কে কিছু কেউ জিজ্ঞেস না করে, আমি রিককে চিনিনা। নীরব সেটাই করে বসলো। উত্তর দিলাম না আমি, উলটে প্রশ্ন করলাম যেটা মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিলো একটা মাস। “আচ্ছা এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না কেন বলতে পারেন?” ‘নিশাত অষ্টপ্রহর প্রেম আমরা অন্তরে লালন করি কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পাই।

যদি সেখানে রোদের ঝলকানিতে ভালবাসা পুড়ে যায়, এই ভয়ে!’ কথাগুলো একদম বুকের মাঝখানে আঘাত করলো। রোদের ঝলকানিতে ভালোবাসা পুড়ে যায়, এটাই নাগরিক ভালোবাসার সত্যতা। এটা উনিশ শতকের রবীন্দ্র আর শরৎএর উপন্যাস নয়, এটা ফাঁপা আর অকেজো একুশ শতক। মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে না, সূর্য মেঘকে পুড়িয়ে ফেলে। “কষ্ট না পেলে এমন মনে দাগ কেটে যাওয়া সত্য কবিতা লেখা সম্ভব না।

আপনার কবিতার প্রেরণা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে”। দ্বিধাহীন ভাবে বলি আমি। প্রথমদিনের অনুভূতিটা কেন যেন তীব্র হয়ে উঠছে। এ আমারই মত কেউ, আমার মতই একজন। নীরব একটু থমকালো, তারপর গল্প বলতে শুরু করলো; নীরব আর রোদেলার গল্প।

অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো আমার, হিংসার নীল সাপ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আমায়। রোদেলা এতটা নিষ্ঠুর হয়েও এত ভাগ্যবতী? আর আমি রিকের জন্য কি করিনি? নীরব থামলে ঠান্ডা কফির গ্লাসটা আঁকড়ে ধরে তাকালাম তার দিকে। নীরব ভীষন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো সে। আমার বুকটা দুরু দুরু করে উঠলো, কি বলবে সে? “নিশাত আমি কি এই চোখের জল মুছে দেয়ার যোগ্য? তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দিবে?” চমকে উঠলাম আমি। জিহবায় নোনা জলের স্বাদ পেতে বুঝলাম বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আমার দু’গাল বেয়ে।

অস্থিরতায় ফেটে পড়তে চাইছে আমার সত্ত্বা। অজানা অচেনা বহু আকাংখিত যে যত্ম আর নির্ভরতার জন্য বুভুক্ষের মত অপেক্ষায় ছিলাম আমি, সে এসেছে। ভালোবাসা মুখ্য না মানুষটি মুখ্য? নীরব একটু সামনে ঝুঁকলে তার আবেগের বাষ্পেভরা চোখ আমাকে টালমাটাল করে তোলে। অসহায়ের মত থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে আমি তাকিয়ে থাকি নীরবের বাড়ানো হাতের দিকে। রিকের কথাঃ অসংজ্ঞায়িত ভালোবাসা আর অতৃপ্ততার কাহন - রিয়েল ডেমোন নীরবের কথাঃ অন্ধকার যাপন - নীরব০০৯ (আগামি পর্বে সমাপ্য) প্রচ্ছদঃ বোকা ছেলে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।