"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রিকের কথাঃ ছন্নছাড়া জীবনে নিশাত
"ঐ রিকশা সামনে টান দে...."
আধঘন্টা হয়ে গেলো এই সায়েন্সল্যাব মোড়ে আটকে আছি। ঢাকা শহরের এই একটা সমস্যা, যার জন্য কত প্রেমিকের প্রেম বিসর্জিত হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। প্রাথমিকভাবে একটা জরিপ করলে এই সংখ্যাটা নেহায়েত কম হবে না। মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগে লাল সবুজ বাতির ট্রাফিক সিগন্যালটা দেখলে। সবুজ বাতি জ্বলছে অথচ যানবাহন সব স্থির আটকে আছে।
ডানদিকের টয়োটা পিরামিড কারে একটা মেয়ে বসে আছে। দেখতে ভালোই। আমি পুরাই পাঙ্খা ভাবে আছি, মেয়েটা দুই তিনবার তাকিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষনে ব্যার্থ। এই জিনিসটা ব্যাপক মজার আমার কাছে। ঢাকা শহরে যারা বাইক চালায় না তারা এই মজা থেকে বঞ্চিত।
এই জ্যামে বোরিং বসে থাকার চেয়ে একটু এন্টারটেইনমেন্ট হলে খারাপ হয় না, তাকালাম মেয়েটার দিকে। লজ্জা পেয়েছে, হা হা। বাঙালী মেয়েদের এই দিকটা ভালোই লাগে, কেউ তাকালেই এমন একটা লজ্জার ভাব ধরে যে প্রেম হয়ে গেছে। লাভ এট ফার্স্ট সাইড।
ওহ নুশা!!!
ইদানিং আমার কি হয়েছে কে জানে, প্রেম ভালোবাসার কথা মনে হলেই নিশাতের মুখ ভেসে আসে।
আমি কি নিশাতকে ভালোবাসি? আমার মন থেকে এই প্রশ্নটা প্রায়ই আসে। কিন্তু মানুষের ব্রেইন বলে আরেকটা জিনিস আছে। আমার ব্রেইন এই প্রশ্নের উত্তরে বলে,
"বাবা রিক! এসব কি? এসব প্রেম ভালোবাসা তোমার সাথে যায়না বোকা ছেলে। তুমি কি জেনে শুনে বলির পাঠা হতে চাও? স্থির হও বৎস, তুমি এসব ভাবলে কি করে হবে বলো? আজিব!!! "
ধুর ব্যাটা ব্রেইন আপাতত দূরে গিয়া মর। নুশাকে বলেছিলাম ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসতে।
মেয়েটা অনেকক্ষন থেকে অপেক্ষায় আছে মনে হয়। আদ্রিতাকে ভার্সিটি থেকে ড্রপ করে দিয়ে আসতে যেয়ে এত বিরম্বনা। আদ্রিতা আমার ড্যাফোডিল ফ্রেন্ড, ব্যাচমেট। শালি আমাকে ওর ফ্রি ড্রাইভার পাইছে, "রিক আমাকে একটু ড্রপ করে দাওনা, প্লিজ প্লিজ প্লিজ। " এমন আবেদনময়ী আবদার কিভাবে ফেলি? আজিব নারী জাতি।
ওহ নুশা!!!
এই মেয়েটা কি আমাকে শান্তিতে একটু থাকতে দেবে না! সারাদিন মাথায় ঘুরপাক খায়। ব্যাপক যন্ত্রনায় আছি এই সম্পর্কের উর্দ্ধে থাকা মেয়েটিকে নিয়ে। একরাত ছাদের বড় ট্যাঙ্কের উপরে শুয়ে ভেবেছি এই মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক কি। প্রথমে ভাবলাম বন্ধু, কিন্তু ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হলো কবে সেটাই খুঁজে পেলাম না। পরে ভাবলাম ভালোবাসার একটা সম্পর্ক হতে পারে, কিন্তু কিসের প্রেম ভালোবাসা? আমাদের মাঝে এমন কোন স্বীকৃত রিলেশন নেই।
লাস্ট ভাবলাম স্যোলমেট হতে পারে, নাহ এটাও না। মাত্র দুই বছর হলো এই মেয়ের সাথে পরিচয়, ও কিভাবে আমার স্যোলমেট হয়! তাছারা আমি ওর মাইন্ড রিড করতে পারি না আর টেলিপ্যাথির মাধ্যমে আমি জানতেও পারি না ও কি করছে। সুতরাং ও আমার সোলমেটও না। পুরা একটা রাত জেগে শেষে কোন ডিসিশনেই আসতে পারলাম না।
নুশা মানে নিশাত নামের এই মেয়েটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ফেসবুকে।
তারপর মেসেন্জারে নিয়মিত বার্তা চালাচালি। আতেল টাইপ মেয়ে। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট। প্রথম দিকে ইউরোলজি অথবা কার্ডিয়াক সার্জারি নিয়ে মাথা নষ্ট করে দিত। ধীরে ধীরে বুঝলাম এই মেয়ের মাঝে খুব সুন্দর একটা মন আছে।
একদিন নিজ থেকেই বলে ফেললাম " নুশা লেটস মিট..." আমি ভেবেছিলাম এই মেয়ে দেখা করার কথায় ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অফার এসেপ্ট করে নিলো! কি আর করার, ডেট ফিক্সড ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে। সেই থেকে এই কফিশপটা আমাদের নিয়মিত দেখা করার স্থান হয়ে গেলো। ছিমছাম এই কফিশপের সবথেকে আকর্ষনীয় প্লেস হলো স্মোকিং জোন। সেই দিকটায় আমার ভালো ঝোক থাকলেও পাশে থাকা মেডিকেলের একটা মেয়ের সামনে দিয়ে সেখানে গেলে কি পরিমান বয়ান শুনতে হবে সেটা ভেবে আর যাওয়া হয়না।
এই মেডিকেল পড়ুয়া আতেল মেয়েটাকে বিরক্ত করতে আমার কেমন যেন ভালো লাগে। সেজন্য ফোন বন্ধ করে রেখেছি যাতে ফোন দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে যায়।
প্রথম যেদিন নুশার সাথে দেখা করতে যাই সেদিনও অনেক দেরী করে গিয়েছিলাম। আসলে টাইম নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা আমার কোন কালেই ছিল না। আজরাঈল আঙ্কেলতো আর বলে কয়ে আসবে না।
সুতরাং এসব ক্যালকুলেশনে সময় দিয়ে সময় নষ্ট করা আমার নীতির বাইরে। যাইহোক, সেদিন কফিশপের পাশে বাইক পার্ক করে ঢুকতে যেয়ে ভাবলাম প্রায় ৪০ মিনিট লেট, মেয়েটা চলে গেছে হয়ত। দরজার কাছে যেতেই মেয়েলি একটা কন্ঠ থেকে শুনলাম,
"এসেছো তাহলে?"
তাকিয়ে দেখলাম ছিমছাম সুন্দরী একটা মেয়ে। হলদে গায়ের বর্ন আর ব্ল্যাক ড্রেসের সাথে ম্যাচ করিয়ে কালো টিপ আর চোখে কাজল। মেয়েরা চোখে কাজল দিলে তাদের সৌন্দর্য কয়েকশগুন বেড়ে যায়।
আমার জানা মতে মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে এই মেয়ের চোখে ব্রিলিয়ান্ট ভাবধারী একটা কালো চশমা থাকার কথা। কিন্তু মেয়েটা একটু ডিফ্রেন্ট। একটু না অনেকখানি। কোন ছেলের সাথে সরাসরি আই কন্ট্যাক্ট করে খুব কম মেয়েই কথা বলে, এই মেয়েটির সেই সাহস আছে। কিছুটা অবাক হলেও কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে আমার চিরচারিত হাসি দিয়ে বললাম,
“আসলাম তো; আলমাসে আসছিলাম একটা পারফিউম নিতে।
ভাবলাম রাস্তাটা ক্রস করে তোমাকে দেখা দিয়েই যাই "
নুশা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। বলতে ইচ্ছে করতেছিল," আমার কি রূপ গজাইছে নাকি? এমনে তাকায়া আছো কেন?" কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বললাম,"তারপর?"
পাশেই ওয়েটার দাড়িয়ে ছিল। নুশার কোন কথা শোনার অপেক্ষার চেয়ে ওয়েটারকে অর্ডার দিয়ে বিদেয় দেয়াটাই আমার কাছে মূখ্য তখন। ওয়েটারকে একটা এক্সপ্রেসো আর একটা কোল্ড কফি আনতে বললাম। আমার অভিজ্ঞতা বলে মেয়েরা কফি টফি এত খায় না, খেলে আইসক্রিম জাতীয় জিনিসই ভালোবাসে বেশী।
নুশা স্বাচ্ছন্দের সাথেই কোল্ড কফি গ্রহন করলো। বুঝে নিলাম ভুল হয়নি , তাছারা রিক ভুল করতে পারে না। সেদিন ভালো একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো ওর সাথে। একসাথে বেড়িয়ে পড়লাম দুজনে। মেঘলা আকাশের নীচে রিক্সায় চড়ে যেতে ইচ্ছে হলো তাই আমার জি এফ মানে আমার বাইকটাকে রেখেই নুশাকে পৌছে দিতে মেডিক্যাল হোস্টেলের দিকে রওনা দিলাম।
সেদিন নুশাকে হাত ধরে রিক্সা থেকে নামানোর সময় আমার মাঝে অদ্ভুত একটা অনুভূতি খেলেছিলো, আজও ওর হাত ধরলে ঠিক তেমনি একটা অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু আমার মাইন্ড এন্ড ব্রেইন গেইমে ব্রেইন বরাবরই জয়ী হয়। সুতরাং দৈববানী,"বাবা রিক! সংযত হও"
ওগ গড, জ্যাম ছেড়েছে। এতক্ষনে আমার মোবাইলে ট্রাই করতে করতে নুশা নিশ্চিত ক্লান্ত হয়ে গেছে। কফিশপে পৌঁছে দেখি চেয়ারটাতে চুল ছেড়ে বসে আছে নুশা।
বিরক্তি নিয়ে হাতে মোবাইলটা ঘুরাচ্ছে আর সময় দেখছে। মনে হচ্ছে ডান পাশের টেবিলে বসে থাকা চশমা পরা কর্পোরেট ব্যাটার কপালে ছুরে মেরে চশমাটা ভেঙে দেবে। এই লোকটাকে দেখছি কিছুদিন ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাটা বজ্জাত, যদিও চেহারায় ইনোসেন্ট গোবেচারা টাইপের একটা ভাব আছে। এই ধরনের ছেলেরা একটু ভাবুক টাইপের হয়।
প্রেমিকার জন্য কবিতা লিখতে এদের জুড়ি নেই। যাইহোক সামনে যেয়ে দাড়ালে নুশার মোবাইল আমার কপালেও জুটতে পারে। সুতরাং পেছন থেকে যেয়ে বললাম,
“নুশা, অর্ডার দাওনি কিছু?”
“রিক, তো্মার আসার কথা কয়টায়? মোবাইলের সমস্যা কি?”
“ওহ, মোবাইল? মোবাইলটা সাজিয়ার কাছে রেখেছিলাম ক্লাসের সময়। আর নিতে মনে নাই”।
এদিকে মোবাইল আমার পকেটে বন্ধ হয়ে পরে আছে।
আমার মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে কিছু বললে নুশার ভেতরে একটা জেলাসি কাজ করে। তপ্ত শিখার মত লাল হয়ে যাওয়া নুশার চেহারাটা তখন দেখার মত। তাই মাঝে মাঝে বানিয়ে কিছু গল্পও বলে ফেলি এমন কিছু মেয়ের নাম নিয়ে যাদের সাথে আমার জিন্দেগীতে দেখা হয় নাই। বেচারী নুশা সেইসব মেয়েদের নাম শুনলে জ্বলে আর আমি মাঝখানে পানি ঢেলে না দিলে প্রায় ভষ্ম হয়ে যায়।
“ভালো।
আর দেরী কেন হলো? সাজিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিলে নাকি?”
“ও মাই গড! নুশা! আর ইউ জেলাস? ওয়াও, ইউ আর সো সো জেলাস”আমি কিছুতেই হাসি দমকে চেপে রাখতে পারছিলাম না। মেয়েরা এতটা পারে কিভাবে?
নুশা রেগে গিয়ে মেয়েদের স্বভাবজাত হুমকি দিতে থাকে, এখনি চলে যাবে। আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলি, “ওরে খাইছে রে ! এই ভালো স্টুডেন্টদের সাথে থাকাই সমস্যা, বুঝলা না? খালি জ্ঞান ঝাড়াঝাড়ি। আর মেডিকেলের ছাত্রী মানে তো……হা হা ”
চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে চলে যেতে উদ্ধত হয় নুশা। আমি জানি ও যাবে না, আমাকে কিছু ফ্রি পরামর্শ দিয়ে আবার বসবে।
আর সেই বয়ান শুনলে আমার মাথা ঘুরায় তাই বললাম,
“আরে বাবা, সরি সরি। বললেই যেতে দেবো নাকি?”
“ঠেকাবে কি করে?” বলেই হাঁটা ধরে নুশা।
বুঝলাম এইবার আর রক্ষা নেই। এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে ও অবাক হয়। পেছন থেকে ওর হাত ধরে প্রথম যে গানের কথা মাথায় আসলো বলে ফেললাম।
“হারাই হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে। পলক না পড়িতে হারাইয়া ফেলি চকিতে। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?”
আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম এই তিনটা বাক্য আমি কত সহজে আবৃতি করে ফেললাম! আমার ভেতরে কবিগুরু আসলো কোথেকে? যাইহোক, নুশা আমার হাত ছারিয়ে যেতে পারেনি। আমি ওকে কাছে টেনে ওর দিকে তাকিয়ে নিজ মনেই ভাবলাম, এই মেয়েটা চলে গেলে আমার আজকের দিনটা শূন্যতায় কাঁদতো। আমার বারান্দার টবে রাখা ফুল রিক্ততায় মাথা নুইয়ে পরতো।
আমি নুশাকে আরেকটু কাছে টানি, ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই যা আমার হার্টবিটের সাথে সমান্তরালে ক্রিয়াশীল। She’s now a part of my life…….
নিশাতের কথাঃ আবছা ভালোবাসা - ব্লগার ত্রিনিত্রি
নীরবের কথা: কাগজের খেলাঘর - ব্লগার নীরব ০০৯
প্রচ্ছদ করেছেন ব্লগার - বোকা ছেলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।