"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কফিশপ - (প্রথম পর্ব)
কফিশপ - (দ্বিতীয় পর্ব)
কফিশপ - (তৃতীয় পর্ব)
রিকের কথাঃ সূর্যাস্তে ভালোবাসার রোদন।
সাতটি বছর পেরিয়ে গেছে। এরই মাঝে বদলে গেছে অনেক কিছু, বদলে গেছি আমি নিজেও। মানুষ দ্রুত নিজেকে বদলে নিতে পারে, কিন্তু বদলে যাওয়া সময় ভুলে যেতে পারে না। আজো সেই পুরনো স্মৃতিরা বারে বারে এসে বিলীন হয় আমার মাঝে।
নিয়তি আমাকে দিয়েছে অনেক, শুধু কেড়ে নিয়েছে অমূল্য একটি কিছু। আমি রাত দেখি, চাঁদ দেখি, শুধু তাকে দেখিনা আর। বাবার বিশাল ব্যাবসার ভার আমার উপরে, সাথে আছে শখের ফটোগ্রাফি। আমার স্বপ্ন আমি ধরেছি, আজ দেশের সেরা ন্যাচারাল ফটোগ্রাফারদের মধ্যে আমি একজন। বাইরের বিভিন্ন বড় সেমিনারে ডাক পরে আমার।
এইতো ছিল আমার স্বপ্ন, নাকি আরও কিছু? হ্যাঁ আরও কিছু ছিল, কিন্তু আমার হেঁয়ালিপনায় তা আজ আমার থেকে অনেক দূরে, এত বেশী দূরে যে আমি সেই ঠিকানা জানি না।
আজ আমি বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রীর সাথে বেঁধে নিচ্ছি জীবন। বাবার বন্ধু ওবায়দুল করিমের মেয়ে তিথি। আমার ছেলেবেলার খেলার সাথী। খুব ছোট থাকতে একবার তিথির উপরে রেগে যেয়ে প্রকান্ড এক থাপ্পর মারলাম, বেচারির একটি দাঁত ইন্তেকাল করলো।
মেয়েটি সবসময় হাসিখুশি আর চঞ্চল। উদ্দীপনায় ভরা একটি মেয়ের সাথে প্রানহীন আমি জড়িয়ে যাচ্ছি বাকি জীবনের সন্ধিতে। মেয়েটি খুব সহজে আপন করে নিতে জানে। ওর কথায় মনে হয় কতদিনের পরিচয় আমাদের। এই মেয়ের সান্নিধ্য পাওয়া হয়ত ভাগ্যের ব্যাপার।
রূপ গুন সবদিক থেকেই অতুলনীয়। আমার বাবা মা অনেক দিন থেকেই পছন্দ করে রেখেছে তিথিকে। তিথি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করছে। প্রায়ই এসে হাজির হয় আমাদের বাসায়। এরই মাঝে সে আপন করে নিয়েছে সবাইকে।
আমার মা খুব বেশী পছন্দ করেন এই মেয়েকে। মায়ের কথাতেই তিথির সাথে পারি দিতে হচ্ছে বাকি পথ।
গেস্টদের মাঝে তিথির কাজিন রোদেলা আপুর হাজবেন্ড নীরব সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই নিশাতের কথা খুব বেশী মনে পড়ছে। ভদ্রলোক হয়ত আমাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু আমি ঠিকই তাকে কফিশপে দেখতাম একটা ল্যাতে নিয়ে নেটবুকে বসে আছেন। আমার আর নিশাতের কথার মাঝে প্রায় সময় চোখ তুলে তাকাতেন আমাদের দিকে।
প্রথমে রোদেলা আপুর সাথে তাকে দেখে চিনতে পারিনি, রোদেলা আপু-ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে,
“হাই, অ্যাম রিক”
“নীরব”
“আপনাকে কোথাও হয়ত আগে দেখেছি নীরব সাহেব”
“পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসছে, হয়ত জীবনের কোন সফরে দেখা হয়েছিল, বাই দ্যা ওয়ে কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো, অনেক ভালো। আপনি কিন্তু বেশ কাব্যিক ধরনের মানুষ, রোদেলা আপু তো ঠিক আপনার বিপরীত, বেশ চঞ্চল দেখছি তাকে। ”
“হুম, আমার শ্যালিকাও কিন্তু আপনার মত ছটফটে। আপনাদের জমবে ভালো” বলেই মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন তিনি।
তার কথার অর্থ যখন বুঝতে পারলাম, চিনতে পারলাম তাকে।
সে হয়ত আমাকে এখনো সাত বছর আগের সেই রিক ভাবছে। কিন্তু এই রিক আর সেই পূর্বের রিকের মাঝে যে বিস্তর কিছু তারতম্য ঘটে গেছে তা হয়ত তার চোখে ধরা পরেনি। একবার ভাবলাম তার কাছে জানতে চাইব নিশাতের কোন খবর জানে কি-না, পরেই আবার ভাবলাম এই ভদ্রলোকের সাথে তো আমার কিংবা নিশাতের কখনো কোন কথাই হয়নি।
নিশাতকে সেই প্লাটিনাম রিং আর দেয়া হয়ে উঠেনি। সুযোগ এসেছিল ঠিকই কিন্তু পরিস্থিতি সহায় হয়নি।
প্রতিটি ব্যার্থ প্রেমিক যেমন ভালোবাসার বিচ্ছেদের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়, ভেবে নেয় নিজেকে অপরাধী, আমিও কিন্তু এর ব্যাতিক্রম নই। ভুল তো আমারই ছিল, আমিই তো ছেড়ে গিয়েছিলাম তাকে তিনটি বছরের জন্য। কিন্তু এই তিনটি বছর যে আমি কতখানি ব্যাকুল ছিলাম, কতটা স্বপ্ন গড়েছি তাকে নিয়ে, কতবার হেটে গেছে অসীমে তার হাত ধরে, নিশাত কি বুঝতে পারেনি? পেরেছে হয়ত, ভেবে নিয়েছে নির্ভরতার যোগ্য আমি নই, সত্যিই তো আমি ছিলাম না। কিন্তু যখনই পরম যতনে বাড়িয়েছি হাত, সে হাতে কেন মেলেনি স্পর্শ?
সেই তিনটি বছরে অকথ্য তৃষ্ণা নিয়ে আর হারানোর হাহাকার নিয়ে আগুনে ঝাপ দেয়া উইপোকার মত জীবন্ত জ্বলেছি আমি। আমার ভাবনা জুড়ে একটি নাম, একটি মুখ জানান দিত নিজেকে, এখনো দিয়ে যায়।
প্যারীর টুকরো ইটের শত বছরের পুরনো পথে হেটে যাওয়ার সময় আনমনে তাকে পাশপাশি কল্পনায় দাঁড় করিয়েছি, অজান্তেই বাড়িয়ে দিতাম হাত। কিন্তু সেই হাত নিশাতের উষ্ণ স্পর্শ পায়নি। শহরের শ্বেত মানুষগুলো হয়ত এই উদভ্রান্ত ছেলেটিকে বহুবার দেখেছে মাঝ পথে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তুষার পড়া বিকেলে যখনই কোন কফিশপে ঢুকে যুগলবন্দী ভালোবাসা দেখেছি, পকেট থেকে সেই প্লাটিনাম রিং বের করে ভাবনায় ডুবে গেছি পুরনো অতীতে। নাফ নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখেছি তাকে পাশে নিয়ে।
আইফেলের চুড়ায় চিৎকার করে ডেকেছি একটি নাম, “নিশাত!”
আমি প্রথম যখন বুঝতে পারি নিশাতকে অনেক দূরে রেখে এসেছি, ঠিক তখনি আবিষ্কার করলাম নিশাত আমাকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্যারিসে পৌঁছে প্রথমেই নিশাতকে জানাতে চাইলাম আমার অনুভূতি, আমার আবেগ, আমার ভালোবাসা। কিন্তু সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি অভিমানি মেয়েটি। তার সাথে যোগাযোগের কোন পথ সে খোলা রাখেনি আমার জন্য। মোবাইল সিম থেকে শুরু করে ফেসবুক,ইয়াহু সব ডিএকটিভেট করে দিয়েছিল।
তার অভিমানের কাছে আমি অনেক আগে থেকেই কি পরাজিত ছিলাম না? এভাবে এতটা শাস্তি আমাকে না দিলেও কি হতো না? আমি যে নিজের সীমানার বাইরে চলে এসেছি সেকি নিশাত বুঝতে পাড়ছে না? কেন ভালোবাসায় এমন হয়?
চার বছর আগে আমি ঠিক-ই ফিরে এসেছি। হন্যে হয়ে খুঁজেছি নিশাতকে। প্রতিদিন বিকেলে সেই ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে বসে থাকতাম, যদি কোনদিন ভুল করে কিংবা ভালোবাসার টানে ফিরে আসে নিশাত। আমি জানতাম এ শুধু গল্প উপন্যাসেই সম্ভব, বাস্তবতার নায়িকারা কখনো ভুল করে আসে না। তবুও কিসের আকর্ষণে আমি কাটিয়ে দিতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে আমি নিজেও জানতাম না।
অপেক্ষা কিংবা প্রতিক্ষা ছাপিয়ে অনেক এগিয়ে ছিল ভালোবাসা। দৃষ্টি বিছিয়ে বসে থেকেছি প্রতিটি দিন। হঠাত এলোচুলের কাউকে দেখে মনে হতো এই বুঝি নিশাত এলো, অভিমানী স্বরে বলবে,”এতদিন কোথায় ছিলেন। “ নাহ, নিশাত জীবনানন্দের বনলতা নয়, হয়ত এসে রাগত চোখে তাকিয়ে থাকবে। আমিই বলবো, “হাই নুশামনি! তুমি এখানে?”
নুশা বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলবে, “কেন তুমি ছিলেনা বলে কি এখানে আসা নিষেধ ছিল?”
“আচ্ছা, তুমি কি আমার উপরে রেগে আছো?”
“কেন? কোন অধিকারে আমি তোমার প্রতি রাগ করবো?”
“শোন বাবুনি, রাগ করলে তোমার ঠোঁট কাঁপে, চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে যায়।
এখনো কিন্তু তার ব্যাতিক্রম নয়, সুতরাং আমি ধরে নিতে তুমি রেগে আছো। আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই, যা শুনলে তোমার রাগ চলে যাবে। “
“আহা যত ঢং, কি বলবে বলো”
“নুশা! আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মেয়ে তুমি কি চিরদিনের জন্য আমার হবে?”
নাহ, নিশাত আর আসে না; সার্ভিসম্যান এসে বলে, “স্যার, ইটস ক্লোজিং টাইম নাউ। “
মাঝে মাঝে অজানার আশঙ্কায় দুরু দুরু করতো বুক। নিশাত কি এই তিন বছরে অন্য কোন বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে? বাঁধা পড়েছে অন্য কোন রোদের মায়ায়? সে কি অপেক্ষায় নেই আমার? আর অপেক্ষায় থাকবেই বা কেন? কিসের ভিত্তিতে সে আমার জন্যে অপেক্ষায় থাকবে? আমিত আমাদের সেই রিলেশনকে কোন স্বীকৃতি দিতে পারিনি।
নিশাত কি ভালবাসেনি আমায়? তবে কি তার অপেক্ষায় থাকাটা উচিৎ নয়?
ক্লান্ত হয়ে পড়ি আমি। এই জবাবহীন প্রশ্নগুলোর চাপ আমি নিতে পারি না, অসহ্য লাগে সব। কোথায় আমি খুঁজিনি তারে? নিশাতের হোস্টেলে যেয়ে জানতে পারি সে আগেই পাশ করে বেড়িয়ে গেছে। ওর মেডিকেলে যেয়ে বর্তমানের কোন ঠিকানাই মিলেনি। নিশাত কি জানে এই ভালোবাসা কত গভীর? এত ভালোবাসা অস্থির করে দেয় আমায়।
অস্থির প্রতিটি রাতে রিল্যাক্সিনের পাতা থেকে একের পরে এক ঘুম পাড়ানি দানা উঠে আসে, তবুও নিদ্রা জড়ায় না আমায়।
একদিন ভাগ্যক্রমে এক প্রাইভেট মেডিকেলে দেখা হয়ে যায় নিশাতের বান্ধবী প্রীতিলতার সাথে। ভাগ্যিস সেদিন আনমনে গাড়ি চালিয়ে ল্যাম্পপোস্টের সাথে দুর্ঘটনা হয়েছিল। আমাদের চারপাশের এক অদৃশ্য বলয় আমাদের কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে আমাদের চাওয়া পাওয়া। সেদিন দুর্ঘটনায় কপালের বাঁ-পাশ কেটে যায়।
ঝিকাতলায় জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালে যেতে হলো ড্রেসিং করাতে। সেখানেই এপ্রন পড়া প্রীতিকে দেখলাম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ড্রেসিং করার ফাঁকে আমাকে সে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো, “আপনার নাম রিক না?”
“হ্যাঁ ডক্টর, আপনি কি আমাকে চিনেন?”
“আপনাকে আমি অনেকবার দেখেছি, নিশাতের সাথে হোস্টেলের গেইটে। ওর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি, আমরা রুমমেট ছিলাম দুজনে। ”
“আমি নিশাত কে খুঁজছি, ও কোথায়? আমি ওকে সমস্ত শহর খুঁজে বেড়াচ্ছি।
নিশাত কোথায়?”
“আপনি চলে যাওয়ার পরে নিশাত একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। ও আছে এই শহরেই। “
“প্লিজ আপনি আমাকে ওর এড্রেস দিন, প্লিজ ডক্টর”
“আমাকে ডক্টর বলার দরকার নেই, আমি প্রীতিলতা, নিশাতের এড্রেস আমার কাছে নেই, তবে ফোনে প্রায়ই কথা হয়, আমি আপনাকে ওর ফোন নাম্বার দিতে পারি, কিন্তু আমার নাম বলা চলবে না। আর আপনি কিছুক্ষন রেস্ট নিন, নতুবা আবার ব্লিডিং শুরু হয়ে যাবে। অনেকখানি কেটে গেছে।
“
“থ্যাঙ্কস প্রীতি, আমি বলবো না। আচ্ছা নিশাত কি বিয়ে করেছে?“
“হঠাৎ এমন উদ্ভট প্রশ্ন করছেন কেন?”
“না, মানে আপনার কপালে সিঁদুর দেয়া দেখলাম। সেখান থেকেই এই প্রশ্নটা মনে আসলো, কিছু মনে করবেন না প্লিজ। “
“হা হা, আমাকে তো সিঁদুর দেখে বুঝেছেন বিবাহিতা, কিন্তু নিশাতকে দেখে তো বুঝতে পারবেন না, যেহেতু আপনাদের ধর্মে বিবাহিতা আর অবিবাহিতার মাঝে লাল দাগ টানা নেই। আমি ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি, আপনি নিজেই যাচাই করে নিবেন।
“
“থ্যাঙ্কস এগেইন। “
যতটা সহজ ভেবেছিলাম নিশাতকে ফোন করা ততটা সহজ ছিল না। আমি ছিলাম ভীষণ মাত্রায় এক্সাইটেড, নুশাকে কি বলবো ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। অন্ধকারে বেশকিছু সময় থাকার পড়ে আলো যেমন চোখ ধাঁধানো মনে হয়, আমার ফিলিংসগুলো সেই সময়ে ঠিক তেমনি ছিল। বইয়ের ভাঁজে থাকা কিশোরীর সুপ্ত ও গুপ্ত গোলাপের ন্যায় আমার চাপা আবেগ বহুদিন পরে কোন বানের ডাকে উছলে পড়তে চায়।
আমার ভাবনারা আরও বিকাশিত হয়, নিশাত কি সেই আগের মতোই আছে? সেই ছেলেমানুষি কান্না, ঠোঁট কাপিয়ে অভিমান, মিষ্টি সেই হাসি, বাতাসে কপোলে উড়ে আসা চুল, শুভ্র নরম হাত, অন্য মেয়েদের প্রতি ঈর্ষাকাতরতা; হা হা পাগলী একটা। নাকি সে বদলে গেছে অনেক? চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, গলায় স্টেথোস্কোপ, ডক্টরদের মত খুব গম্ভীর ভাব। এই পাগলী গম্ভীর হয়ে থাকলে কেমন দেখাবে? ভাবতেই হো হো করে হেসে উঠলাম। সেদিন ছিলো কৃষ্ণপক্ষের রাত, রাতের আকশে তাই ঢেকে গিয়েছিল চাঁদ।
ভাবনার ঘুড়িতে সুতো ছেড়ে উড়িয়ে দিলাম দূর আকাশে।
অনেক্ষন ধরে স্ক্রিনে তাকিয়ে অবশেষে ফোন করলাম নিশাতকে। ওপাশে রিং বেজে যাচ্ছে, সমান তালে আমি শুনতে পাই আমার হৃদস্পন্দন। পঞ্চম বারে ওপাশ থেকে ভারী এবং ক্লান্তির গলায় ভেসে এলো, “হ্যালো। ” নিশাত! কতদিন পরে শুনতে পেলাম নিশাতের গলা। এই কয়েকটি বছরে অলস ক্লান্তি কিভাবে বদলে দিলো তার স্বর? নিশাত কি সত্যিই বদলে গেছে?
“হ্যালো, কথা বলছেন না কেন?”
“নিশাত আমি”
দুই প্রান্তে তারপরে বেশ কিছুক্ষনের নীরবতা।
ওপাশ থেকে নিশাতের ভারী বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আবার থেমে যায় সে শব্দ। থমথমে বেশ কিছুটা সময়। হঠাত কেন এত নীরবতা? আজ কেন আমার এতদিনের এত কথা একেবারেই ফুরিয়ে গেলো? শত চেষ্টাতেও কিছু মনে করতে পারলাম না। অথচ অনেক কিছু বলার জন্য অস্থিরতায় আমি রীতিমত ঘামছি।
এই জড়তা থেকে নিশাতই আমাকে উদ্ধার করলো। নীরবতা ভেঙ্গে বললো, “কেমন আছো রিক?”
“ভালো, অনেক বেশী ভালো, চিনতে পারছো তাহলে? কেমন আছো তুমি?"
“কবে এসেছো?”
“প্রায় ছয় মাস, সেই থেকে খুঁজছি তোমায়। তুমি যে এতটা অভিমানী ভাবতে পারিনি। “
“অনেক কিছুই ভাবনার আড়ালে থেকে যায়, তুমি যে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাবে, আমিও সেটা ভাবতে পারিনি। “
“আমি পালিয়ে যাইনি নিশাত, তখন সে পরিস্থিতি ছিলোনা তুমিও খুব ভালো করেই জানো।
তোমার সাথে আমার ইমিডিয়েট দেখা করা প্রয়োজন, কাল কি সময় হবে তোমার?“
“সেই প্রয়োজন তুমি রাখোনি”
“প্লিজ নিশাত, আমি কাল বিকেল চারটায় ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসছি, তুমি চলে এসো। “
ফোন কেটে দিলাম। আমি জানি ও আসবে। ওর যতটা পরিবর্তনই হোক না কেন, আমার ডাকে সে আসবেই। কতদিন, কতদিন পরে দেখা হবে দুজনে! সেই স্নিগ্ধ মুখ, সেই পরিচিত কফিশপ আর আমাদের গল্প।
কত স্মৃতি, কত কথা, কত সময় কাটিয়েছি দুজনে। ঘুমুতে পারলাম না সে রাতে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে চাঁদ খুঁজে কিংবা চাঁদের মত সেই মুখটি খুঁজে কেটে গেলো রাত।
রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আস্তে সাড়ে চারটা বেজে গেলো। সেই টেবিলেই বসে আছে নিশাত।
আজ আমার অন্য এক অনুভূতি। এই সেই নিশাত, কিন্তু এই নিশাতকে আমি অনেক ভালোবাসি যা পূর্বে কখনো বলতে পারিনি। আজ বিমর্ষ এক সুখের বেদনায় যেন পূর্ণ হয় বুকের ভেতরটা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম, হয়ত নিশাত টের পেয়েছিল আমার অস্তিত্ব। ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আজকেও অপেক্ষায় রাখলে রিক?”
“স্যরি, আসলে অনেক দিন পড়ে দেখা, আমি লিটল বিট আপসেট ছিলাম।
তাছারা ট্রাফিক ছিল খুব। “
“সেই পুরনো অজুহাত?”
“ডিপেন্ড অন ইউ। আমি অর্ডার করে আসছি, একটু প্লিজ। “
আমি কফি অর্ডার করে বেড়িয়ে গেলাম, গাড়িতে রেখে এসেছিলাম সেই প্লাটিনাম রিং যেটা নিশাতকে প্রেজেন্ট করে বলবো সেই পুরনো কিন্তু প্রতিদিনে ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে রাখা বাক্যটি। ফিরে এসে দেখলাম কফি চলে এসেছে।
নিশাত আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বললো, “তারপরে?” লক্ষ্য করলাম নিশাত সত্যিই খুব গম্ভীর হয়ে গেছে, চোখে মুখে কেমন অস্বচ্ছ থমথমে ভাব। তার ক্ষীণ হাসিটুক যে গম্ভীরতার মাঝে কিছুটা সময়ের জন্য তার সৌন্দর্য শত কোটি গুন বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই কথাটি হয়ত নিশাত কোনদিন জানতে পারবে না। আমি নিশাতের চোখে তাকিয়ে কিছুটা অপ্রস্তত হয়ে গেলাম, এতটা বিষণ্ণতার ছায়া আমি এই প্রথম লক্ষ করলাম। সেই চোখে দীর্ঘক্ষণ চোখ রাখা যে কতখানি কষ্টের সে কথা হয়ত কোনদিন কাউকে বলা হবে না। আমি চোখ নামিয়ে আবার নিশাতের চোখে চোখ রেখে বললাম,
”নিশাত, আমি চলে যাওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে দুজনের অজান্তে সেই বৃষ্টিতে যা হয়েছিল তার জন্যে আমি কিংবা তুমি দুজনের কেউ দায়ী ছিলাম না, আমাদের পরিবেশ আর পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল নিশাত।
“
“সে অনেক পুরনো কথা রিক। ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় এখন আর নেই। তার চেয়ে বলো তুমি আমাকে কেন ডেকেছো”
“আমি শুধু বলতে চাই আমি পালিয়ে যাইনি নিশাত। আমি বুঝতে পারিনি তুমি আমার কতখানি জুড়ে আছো। আমি যতক্ষনে বুঝতে পারলাম, ততক্ষনে আমি অনেক দূরে।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমি দেশে এসে পাগলের মত খুঁজেছি তোমায়। “
“তাই?”
“নুশা আমি অভিনয় করছি না, আজকে আমি বাস্তবতার কথা বলছি। আমার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ইমাজিনেশনে ছিলে তুমি, তুমি আছো তুমি থাকবে নিশাত। শেষ বারের মত একবার বিলিভ করো আমাকে।
নিশাত আমি সত্যিই তোমাকে অনেক বেশী ভালোবাসি। তিনটি বছর এইটুকু কথা বলার জন্য ভেতর ভেতরে জ্বলেছি আমি। প্লিজ ডোন্ট লিভ মি। “
“রিক, তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? তাহলে আমি কি কিছু বলতে পারি?”
“নুশা… প্লিজ…”
“রিক, এটা সত্যি কথা যে আমি তোমাকে ভালবাসতাম, এখনো বাসি। এটাও সত্যি যে আমার জীবনে আমি তুমি ছাড়া কাউকে কখনো কল্পনাও করিনি।
কিন্তু তুমি অনেক দেরী করে ফেলেছো রিক। তুমি কি জানো রাতের পর রাত আমি সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখে আর চোখের জল ফেলে কাটিয়েছি? তুমি কি একবারো খোঁজ নিয়েছো এই তিনটা বছর আমি কিভাবে নিজেকে সামলিয়েছি?”
“নিশাত…!”
নুশা আমাকে কোন কথা বলতে দেয় না। কাঁদতে কাঁদতে কঠিন গলায় বলতে থাকে, “তুমি যে নুশাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে সে এখন মৃত। তোমার সামনে এখন ডাঃ নিশাত বসে আছে, যার কাছে রিক শুধুই একটা ছায়া মাত্র। যার কাছে অতীতের চিন্তা করা বিলাসিতার নামান্তর।
”
“আবার সব ঠিক হয়ে যাবে নিশাত। আমি তুমি, আমরা দুজনে মিলে ঠিক করে নেব। “
“একবারো কি খেয়াল করেছো যে তুমি এখন আর আমাকে নুশা ডাকতে পারছো না? আর তুমি বলছো আমরা সব ঠিক করে নেবো? আমি সরি রিক, আমাকে ক্ষমা করে দিও। সন্ধ্যা ছয়টায় আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে, আমাকে যেতে হবে। দয়া করে আর কোন যোগাযোগ করো না।
অনেক কষ্ট দিয়েছো, এখন একটু শান্তিতে থাকতে দাও”।
ব্যাস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় নিশাত। বাইরে মেঘলা আকাশ। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে ফ্ল্যাশ লাইটের মত আলোর ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে দূরের আকাশ থেকে বজ্রপাতের ধ্বনি শোনা যায়।
মাথা ভারী হয়ে উঠে। পড়ে দমকা বাতাসের সাথে ধুলো উড়ে যায় নিত্যদিনের ভাঙ্গা গড়ার সাক্ষী এই শহরে, ধুলো হয়ে ভেসে যায় ভালোবাসারা। যে আশার রোদ নিয়ে সকালের সূর্য হাসে, সেই আশার সমস্তটা নিয়ে গোধূলি বেলায় আড়াল হয়ে যায় মন খারাপের রক্তিম আভায়। অতঃপর চাঁদের আলো আসে সূর্যের বিকল্প হয়ে, কিন্তু তার ক্ষীণ আলো কি পারে সেই সকালের সূর্যের অভাব মোচন করতে? চলে যায় সূর্যধোয়া শুভ্রতার দিন। রেখে যায় মন খারাপের বীজ, যার অঙ্কুরোদগমে একসময়ে ছড়িয়ে যায় বিষণ্ণতার ডালপালা।
কফিশপে মৃদু ভলিউমে গান বেজে যাচ্ছিলো, অর্থহীন-সুমনের “কোন এক নিঝুম রাতে............ ”
কোন এক নিঝুম রাতে,
ঝাউ বনে চাঁদের আলোতে।
গান গেয়ে যায় একটি ছেলে,
একরাশ বেদনা বুকে নিয়ে।
তার সেই গানতো কেউ শোনেনা,
হতাশার কথাতো কেউ জানেনা!
তবুও তার আশার প্রদীপ তো নেভে না!
যদি ফিরে পায় সেই হারানো দিন............!
নিশাত চলে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি তার চলে যাওয়ার পথে। সেই প্রথম এবং শেষ বার দেখেছি ভালোবাসার চলে যাওয়া।
প্লাটিনাম রিং হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম, আমি ভেবেছিলাম ফিরে আসবে নিশাত। নাহ, ফিরে তাকায়নি। জীবন উপন্যাসের শেষ পাতা নয়। সেদিন নিশাত আমাকে বাস্তবতার হাত ধরতে শিখিয়ে দিয়েছিল। স্বচ্ছ কাঁচের ওপাশে ঝরো বাতাসে উড়ছে তার শাড়ির আঁচল।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করে। সেদিন নিশাতের গালে তার ছলছল চোখের কিংবা তরুণীর ন্যায় ক্রন্দনরত আকাশের জল মৃদু সন্ধ্যা মেলানো আলো আর ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম বাতির মিশেলে অদ্ভুত এক রং সৃষ্টি করেছিল। চলে যায় আনন্দের সেই সব দিন, রয়ে যায় শুধুই রোদন। হারিয়ে যায় অজস্র স্মৃতি ভরা খাতা বাদল দিনের শেষলগ্নে, শেষ হয়ে যায় একটি কফিশপের গল্প।
কফিশপ- শেষ পর্ব - ত্রিনিত্রি
কফিশপ (শেষ পর্ব) - নীরব ০০৯
প্রচ্ছদ করেছেন- বোকা ছেলে
অর্থহীন-সুমন ভাইয়ের গানটির লিন্ক- "কোন এক নিঝুম রাতে....."
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।