"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কফিশপ - ( প্রথম পর্ব )
রিকের কথা: ভালোবাসা কিংবা কনফিউশন
সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে কার মুখ দেখেছিলাম সেইটা নিয়ে টেনশনে আছি। নিশ্চয়ই কোন হতচ্ছাড়া ছিল। নইলে সারাটা দিন এমন যাবে কেন? ক্লাসে যাওয়ার সময় মাঝ পথে বাইকের ফুয়েল শেষ। আধ কিলোমিটার বাইক ঠেলে ফিলিং স্টেশন পেয়েছি। ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভরে টাকা দিতে যেয়ে দেখি মানিব্যাগ রেখে এসেছি।
শেষে আবার দৌড়ে বুথ থেকে টাকা তুলতে হলো। ক্লাসে আসতে লেট একঘন্টা। শারমিন ম্যাম আজ ক্লাসে আসেনি, রিপ্লেসে এসেছেন এক বোরিং টিচার। এখন নেশা পেয়েছে সিগারেটের। আমার একটা বদ অভ্যেস হচ্ছে ক্লাসের মাঝে সিগারেটের বেড়া উঠলে সোজা ক্লাসের বাইরে চলে যাই, ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।
আর আমার ড্যাফোডিলের টিচাররা পর্যাপ্ত মধু পান করেছে ছোটবেলায়। নইলে আমাদের এত অত্যাচারের পরেও হাসিমুখে লেকচার কিভাবে দেয়? ওহ মনে পরেছে, সকাল বেলায় যার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলাম সে অন্য কেউ না, স্বয়ং আমি। ঘুম থেকে উঠেই নিজের ওয়াল ফটো দেখেছিলাম। মোবাইল বের করে পাওয়ার অফ স্ক্রিনে চেহারা দেখলাম, হুম ঠিকই আছে সব।
আজকে আবার চারটায় নুশার সাথে মিট করার কথা বিকেলে, ওর জন্য একটা রিং কিনেছি প্লাটিনামের।
কেন কিনেছি আমি নিজেও জানি না। দেখে পছন্দ হলো আর কল্পনায় সেটা নুশা মানে নিশাতের আঙ্গুলে দেখলাম। প্রথমে ভাবলাম রিং দিলে আবার কি না কি ভেবে নেয় নুশা। পরে সব বিভ্রান্তি তোয়াক্কা না করে নিয়েই নিলাম। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় একটি।
কোন সম্পর্কের উপরে ভিত্তি করে নুশাকে গিফট করবো? বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা? এই দুটির কোনটাই আমাদের মাঝে নেই। মাঝে মাঝে ভাবি আমাদের এই রিলেশনটা কি সংজ্ঞা দেয়া যায়। খুব নতুন কিছু একটা আমাদের দুজনের সম্পর্ক, ভালোলাগা আর সম্পর্কের পরিচ্ছন্নতাই আমাদের নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করেছে অনুভুতি, রেসপেক্ট আর ভালোবাসা; নাহ ভালোবাসা না, আবার হতেও পারে। আমি ওকে ভালবাসি কি না এখনো জানি না কিন্তু আমি চাই ও আমার হোক আর পৃথিবীটা আমাদের দুজনের। নুশা কি আমাকে ভালোবাসে?
এই নুশাটার জন্য কেন যেন আমার একটু বেশী টান।
কত মেয়ে আমাকে পাওয়ার জন্য ঘুরঘুর করছে কিন্তু আমার মাঝে জায়গা করে নিয়েছে এই নুশামনিটা। ছেলেবেলা থেকে কোন কিছুর অভাব বোধ করেছি কি না মনে নেই। আমার কোন কাজে বাবা কখনো অমত করেনি, কখনো করবেনও না। কারন তার একমাত্র ছেলেকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। ছেলেবেলায় একবার স্কুলে যাওয়ার সময় রিক্সা থেকে পরে গিয়েছিলাম, পরদিন দেখি বাবার গাড়ি থাকা স্বত্বেও আমার জন্য আরেকটা গাড়ি কিনে গ্যারেজে রেখেছে আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
আমার মা ভাবেন তার রেসিপির মাঝেই সব আদর নিহিত আছে। বাসায় যতক্ষন থাকা হয় ততক্ষনই আম্মুর একের পর এক রেসিপি টেস্ট করতে হয়।
মাঝে মাঝে নুশার অভিমান কিংবা কঠোর দৃষ্টি দেখলে মনে হয় আমার উপরে ওর একটা দাবি আছে। হ্যাঁ সত্যিই আছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে সেই দাবী? আমাদের অসঙ্গায়িত সম্পর্ক? কফিশপে একদিন নুশাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “আমাদের মাঝে রিলেশনটা কি নুশা বলতে পারো? “
নুশা দারুন বুদ্ধিমতী মেয়ে।
আমাকে এক্সপ্লেইন করেছিল এভাবে,
”আমাদের মাঝে যে সম্পর্কটা আছে সেটা আমরা জানি না, ইন্ডিভিজ্যুয়াল্লি যদি চিন্তা করো তাহলে আমি যেভাবে নেব আমাদের সম্পর্কটা তাই আর তুমি যেভাবে নেবে সেটা টোটালি তোমার উপরে ডিপেন্ড করবে। “
- তাহলে তো আমাদের রিলেশনটা ঝুলন্ত একটা রিলেশন বলা যায়। রিলেশন হ্যাং অন। পুরাই কুয়াকাটার ঝুলন্ত ব্রিজ।
- রিক, ফাজলামি ছারো, রিলেশন আবার ঝুলে থাকে নাকি? তাহলে সেটা কি রিলেশন বলে?
- চেইতা যাও কেনো নুশামনি? আসলে আমি জানি না আমাদের রিলেশন কি, তাই তোমাকে বললাম।
আচ্ছা আমরা এভাবে কতদিন চলবো? মানে এভাবে কতদিন আমাদের দেখা হবে এই কফিশপে?
- হুম, ডিপেন্ড করে, তোমার উপরে। আচ্ছা হঠাত একথা কেনো? আমার সাথে দেখা করতে কি খারাপ লাগে তোমার?
- আহ বাবুনি, সিরিয়াসলি নিচ্ছো কেন? আমিতো এমনিতেই বললাম। থাক বাদ দাও, আমার চোখের দিকে তাকাও দেখি তোমার চোখ কি বলে। আমার কথা নাকি অন্য কারো কথা।
- আবার ঢং! চলে যাব কিন্তু?
ওর চলে যাবার হুমকি শুনলে আমি কেন যেন চুপ হয়ে যাই।
ওর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আবেশে ঘেরা। ইচ্ছে করে এই আবেশ ধরে রাখতে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নুশাকে বলি, “নুশা, তুমি কি আমার হবে?” কিন্তু আমি পারি না, আমার বাঁধা কোথায় আমি নিজেই জানি না।
ওহ হেল। যত্তসব আতেল মার্কা কথা মাথায় ভর করেছে।
উদ্ভট সব চিন্তাভাবনা। শালার এইগুলা ভাবতেও ভালো লাগে। কি যে বিশ্রি অবস্থা আমার সেইটা শুধু আমিই বুঝতেছি। হে খোদা এত কঠিন পরীক্ষা নিও না আমার, তুমিত জানোই আমি না পইড়া পরিক্ষা দেই। আর নুশাকে আমি হারাতে পারবো না।
আবার ওই মেডিকেলের বইকে তো আমি ভালবাসি না কিন্ত নিজের সেলফে তুলে রাখতে চাই। আজিব ! পুরাই আজিব!
দুইদিন পরে ভার্সিটির ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এরেঞ্জমেন্ট আমার উপরে ছেড়েছে ক্লাস মনিটরার। তাছারা ফেস্টিভ্যালের প্রেজেন্টেশনও আমাকেই করতে হবে। ক্লাস শেষে সবাইকে নিয়ে প্রস্তুতির কাজ।
ছোট খাট একটা সাইক্লোন যাচ্ছে আমার উপর দিয়ে।
“রিক আমার হাত দেখবা একটু?” তাকিয়ে দেখি আদ্রিতা। এই মেয়ে দিনে দিনে আমার ছায়া সঙ্গি হয়ে যাচ্ছে। হুট করে কোথা থেকে এসেই হাত দেখতে বলছে। আজিব !
“দেখলাম তো , তোমার হাত খুব সুন্দর।
“ এই মেয়েকে এড়িয়ে যাওয়াটাই বিজ্ঞের কাজ। তাই সোজাসাপ্টা বলে দিলাম।
“ আরে আমি হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলতে বলছি, ইরিন বললো যে তুমি নাকি হাত দেখতে পারো, ওর হাত দেখে বলেছ যে ওর দুইটা বয়ফ্রেন্ড আর সেটা নাকি সত্যি! “
“আমাকে কি তোমার গনক টিয়া পাখি মনে হয়?”
জানি এবার এই মেয়ে প্লিজ প্লিজ প্লিজ বলা শুরু করবে। কফিশপে একবার নুশা ভীষণ রাগ করেছিল। কি করবো কিছু বুঝতে না পেরে ওর হাতটা টেনে হাতের রেখা দেখতে লাগলাম।
আমার স্পর্শে নাকি জ্যোতিষ বিদ্যায় জানি না, কিন্তু ও রাগ ভেঙ্গে হেসেছিল। মিষ্টি হেসে বলেছিল,
- কি দেখলা হাতে?
- নুশামনি! তোমার দুইটা প্রেম!
- মানে কি?
- বিয়ের পরে তোমার এগারোটা বেবি হবে, তুমি চাইলে ফুটবল, ক্রিকেট, রাগবি,বেসবল যেকোন খেলার টিম করতে পারবা।
- ফাজলামি রাখো, পারলে বলো আমার হাত কার হাতে যাবে?
- এখন তো আমার হাতেই আছে, মানিয়েছে বেশ। এখানে থাকতে পারে যদি তুমি চাও। স্পর্শের উষ্ণ অনুভব আমাকেও ক্ষত বিক্ষত করে, হাতটা কি ধরে রাখব?
কথাটা বলার পরে পুরাই আবুল হয়ে গেলাম।
এটা আমি কি বলে ফেলছি! এদিকে আবেগের আতিশায্যে নুশার চোখ ছলছল,একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । বুঝলাম ঘটনা খারাপ, ভেতরে এরই মাঝে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার রেশ কাটাতে শব্দ করে হেসে বললাম,” নুশা কেমন অভিনয় করলাম? পারফেক্ট হয়েছে না? দেখলা তোমার রাগ ভেঙ্গে গেছে, সুতরাং আমার এক্টিং ভালো হয়েছে। “ নুশার দৃষ্টি অদ্ভুত ভাবে বদলে গেলো, পারলে আমাকে খেয়ে ফেলে আস্ত।
মেয়েদের ইমোশন নিয়ে খেলতে বরাবরই আমার ভালো লাগে।
কিন্তু নুশার বেলায় আমি পারি না। শুধু এই মেয়ের চোখে তাকালেই অপরাধবোধ টের পেয়ে যাই। তাই বলে ক্রাশ খাইছি ভাবা যায় না। অন্য একদিনের কথা বলা যায়, সেদিনের কথোপকথন এমন ছিল,
- আমাকে প্রেমিক হিসেবে কেমন মনে হয় নুশা?
- হুম, স্মার্ট ইন্টেলিজেন্ট ভালই তো, তোমার অন্যান্ন প্রেমিকারা ভালো বলতে পারবে।
- আজিব! তুমি এত হিংসুট কেন? মেয়েরা আমাকে লাভ করতেই পারে।
আমি নিজে ঠিক থাকলেই হল, ইদানিং একটা প্রেম করতে ইচ্ছে করছে। আমার কি যোগ্যতা আছে নুশা?
- শোন রিক, আমি মোটেও হিংসে করছি না, আর আমাদের তো সেই রিলেশন নেই যেখানে আমি দাবী নিয়ে হিংসে করতে পারব।
- একটা কথা বলবো?
- বলো,
- আমার মনে হয় আমি প্রেমিক হিসেবে ভালো হতে পারি কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে কখনই যোগ্য না। তাই তোমার অপিনিয়ন চাইছিলাম। ভালো কথা, আমার সাথে প্রেম করবা?
- আবার দুস্টামি শুরু করলা?
- নাহ, আমি সিরিয়াস।
- তুমি প্রেমিক হিসেবেও যোগ্য না।
- আমিও তাই জানি, এতক্ষনে সত্য বলার জন্যে থ্যাঙ্কস। Thats why i like you most.
আমাদের সম্পর্ক। এভাবেই চলেছি আমরা। একজন বলতে চাই অন্যজন লুকিয়ে যাই।
তবুও আমি বুঝতে পারি না ভালোবাসি কি না। ভালোবাসা পরিমাপের স্কেল থাকলে দারুন হতো। আমার এত কনফিউশন থাকতো না।
আদ্রিতার হাত দেখে আর ফ্যাস্টিভালের কার্যক্রম সামলাতে পাঁচটা বেজে গেছে। নুশার কথা মনে পরে গেলো।
প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়েছে ও ওয়েট করছে কফিশপে। একবার ভাবলাম বাইক টান দিয়ে দেখা করে আসব, পরে এত কাজ দেখে আর যাওয়া হলো না। একটা মেসেজ করা যায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা মেসেজ লিখে সেন্ড করে দিলাম যে যেতে পারছি না। নুশা একা অপেক্ষায় এতক্ষন ছিল ভাবতেই নিজেরি খারাপ লাগছিল।
এই মেয়েটা আমার জন্য সব ফেলে চলে আসে আর আমি ওকে ফেলে সবকিছুর পেছনে ছুটছি। অদ্ভুত। পুরাই আজিব।
কফিশপ - দ্বিতীয় পর্ব - ব্লগার ত্রিনিত্রি
কফিশপ (দ্বিতীয় পর্ব)- ব্লগার নীরব ০০৯
কফিশপ - প্রথম পর্ব - ব্লগার ত্রিনিত্রি
কফিশপ (প্রথম পর্ব) - ব্লগার নীরব ০০৯
প্রচ্ছদ করেছেন- বোকা ছেলে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।