আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কফিশপ (তৃতীয় পর্ব)

আকাশ ভরা গাঙচিল কফিশপ (দ্বিতীয় পর্ব) অন্ধকার যাপন এ্যাপার্টমেন্টের ১২ তলায় আমার ফ্ল্যাট। শহরের কোলাহল পেরিয়ে, নিষ্করুণ শুষ্ক শহর থেকে বেশ কাছেই ফ্ল্যাটটা। বন্ধুর ডেভেলপার বাবার প্রথম এ্যাপার্টমেন্ট। এ্যাপার্টমেন্টের কাজ চলাকালীন সময় আমরা সব বন্ধুরা এখানে এসেছিলাম। আড্ডা, হৈ হুলোর করে সময় কাটিয়েছিলাম।

মনে গেঁথে গিয়েছিলো জায়গাটা। নতুন গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকার এক কর্ণারে বিল্ডিঙটা। বিল্ডিঙের এক পাশে প্রশস্ত রাস্তা আর অন্য পাশে পরিত্যাক্ত ফাঁকা অংশ। ১৪ তলার বিল্ডিং এর নির্মাণাধীন ১০ তলায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিলো, আহা এখানে যদি আমার একটা ফ্ল্যাট থাকত! সেদিনের এই হঠাৎ চেয়ে ফেলা ইচ্ছা যে এতো দ্রুত পূরণ হবে তা ভাবিনি কখনো। বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা আর আমার উপার্জনের টাকা মিলিয়ে চাকরীতে জয়েন করার ২ বছরের মাথায় এই ফ্ল্যাট নিজের নামে কিনে নিলাম।

বন্ধুর বাবা ডেভেলপার হওয়াতে একটু সুবিধা হয়তো পেয়েছি তবে আমার এই কর্ণারের ফ্ল্যাট পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বন্ধু সৈকতের অবদানই বেশি। সেই সব কিছু ম্যানেজ করে দিয়েছিল। এখন আমি হাতে কফির একটা মগ নিয়ে বারান্দায় দাঁড়াই। রেলিঙের উপর কনুইয়ের ভর দিয়ে আয়েস নিয়ে তাকিয়ে থাকি দূরে, বহুদূরে। আমার এই ব্যালকনি থেকে শহরের অনেক দূর দেখা যায়।

আর বিল্ডিঙের পাশের রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ আর গাড়ির আনাগোনা দেখি। খেলনার মতো দেখতে মানুষগুলোকে দেখে বেশ অবাক হই। এই ছোটো ছোট মানুষ গুলোই কি ভীষণভাবেই না জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। চাইলেই ছেড়ে দেয়া যায় না আবার খুব আপন করে কাছে ধরে রাখাও যায় না। বেশ কিছুদিন ধরে আবহাওয়া মেঘলা।

তবে খুব একটা বৃষ্টি নেই। হালকা শীতল বাতাস আর রাতের আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। ছুটির দিনগুলোতে সাধারণত বাড়িতেই থাকি। আজ দুপুর শেষে মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই শরীরের সাথে লেগে থাকা খুব পরিচিত এক বিষন্নতায় চোখে জলের অস্তিত্ব জানিয়ে দিল, আমি ভাল নেই। কফি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই বৃষ্টি নামলো।

অঝোর বৃষ্টি। আমার ঠাণ্ডার খুব সমস্যা। একটু ভিজলেই সাইনাসের তীব্র ব্যাথায় খুব কষ্ট পাই। তবুও আজ সব কষ্ট ভুলে বৃষ্টির মাঝে নিজেকে সঁপে দিলাম। আমাকে নিয়ে বৃষ্টি খেলতে লাগলো তার সিক্ততার খেলা।

ভাসিয়ে দেয়ার এই খেলায় সব সময় বৃষ্টিই জয়ী হয়। আমি অসহায় শালিকের মতো শুধু ভিজে গেলাম। ঝাপসা মানুষ, ঘর, গাড়ি আর খুব প্রিয় ভালবাসা বিবর্ণ ক্যানভাসে আমাকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে গেল। আমি হাতে তুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঁকলাম ভীষণ বাঁচতে চাওয়ার আকুতি নিয়ে প্রতিনিয়ত মৃত এক পরাজিতের বীভৎস রঙহীন সাদা কালো ছবি। সেদিন বিকেলে রোদেলাকে দেখলাম ক্যাফেটেরিয়ার জানালা সংলগ্ন চেয়ারে বসে আছে।

একটু আগে হয়ে যাওয়া ঝুম বৃষ্টির বড় বড় কিছু ফোঁটা রোদেলার চেয়ার ঘিরে জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। রোদেলাকে দেখলাম হাত দিয়ে বৃষ্টি ফোটাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। আঙ্গুল দিয়ে বড় বড় এক একটা ফোঁটাকে অন্য ফোঁটার সাথে যোগ করে দিচ্ছে ফলে জমে থাকা বৃষ্টি কণা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। রোদেলা একটু একটু করে হাসছে। আবার পরক্ষনেই বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে।

কি যেন ভাবছে। বৃষ্টি ফোঁটার সাথে হয়তো কথা বলছে। কতো আপন করে নিয়েছে বৃষ্টিকে। আজ তার সব কথাই বৃষ্টির সাথে। আমার উপস্থিতিতেও তার কোন ভাবান্তর নেই।

রোদেলার কাছে আজ অনেক অচেনা আমি। আজ বিশ্ববিদ্যালয় পেরুনোর চারটি বছর পার হয়ে গেছে আর রোদেলার সাথে যোগাযোগ ছাড়া পেরিয়ে গেছে ৪ বছর তিন মাস ১৮ দিন। অনেক সময়। একজন মানুষের ফিরে আসার জন্য ব্যার্থ অপেক্ষা করার জন্য এই সময় যথেষ্ট বেশি। এটা অনেক সত্য, যে যায় সে আর কখনো ফিরে আসে না।

হয়তো ফিরে আসে তবুও তাকে ফিরে আসা বলে না। অনেক বেশি মুখোশ পড়ে ফেলে মানুষ। বিচিত্র মুখোশের আড়ালে প্রকৃত মানুষ হারিয়ে যায়। রোদেলা খামখেয়ালীপনায় বিশ্বাসী ছিল। কেউ তার কাছে এলে তাঁকে সে খুব আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করতো।

মিশত বন্ধুর মতো। তবে এই মেলামেশাটা এমন পর্যায়ের ছিল যে পর্যায়ে গিয়ে আমি নিজেও রোদেলার নাগাল পেতাম না। সে অনেক উচ্চে অথবা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকত। কতদিন, কতদিন যে এভাবে কেটে গেছে যেখানে রোদেলা তার নিত্য নতুন বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকত, আমার সাথে কথা বলারও তার সময় হতো না। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো।

আর খারাপ লাগার পরিমান বেশি হলেই আমার সিগারেট খাওয়ার মাত্রা বেড়ে যেত। তবে এই কষ্টকর অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হতো না কেননা রোদেলার সেই সব তথাকথিত নতুন নতুন বন্ধুরা একদিন ঠিকই রোদেলাকে ছেড়ে চলে যেত। কারণ একটাই, রোদেলার অত্যধিক অহংবোধ। রোদেলা এ কথা মানতে চাইত না। আমিও মানিনি তবে গত ৫ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে শেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রোদেলাকে পড়তে পারা।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারতাম সে কি ভাবছে। ওর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে কাউকে খোঁজার মানে আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। আমি এও জানতাম কখন, কোনদিন রোদেলার মন খারাপ থাকবে এবং কেন। কখন এবং কি কারণে তার মন আবারো ভাল হয়ে যাবে এ বিষয়ও রোদেলার আচরণ দেখে বলে দেয়া আমার পক্ষে খুব একটা কষ্টের কিছু ছিল না। রোদেলা কাউকেই তার সমকক্ষ ভাবতে চাইত না।

তার যোগ্যতা, সৌন্দর্য আর মানুষকে প্রভাবিত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। সে না বললেও এবং তার সব বন্ধুরাও আমার এই কথার বিরোধিতা করলেও আমি জানি রোদেলা খুব বেশিদিন কাউকেই সহ্য করতে পারত না। রোদেলা নিজের ভুল গুলো বুঝতে চাইত না কিন্তু অন্যের সামান্য কোন ভুলের কারণে তাকে নাজেহাল করতেও ছাড়ত না। আমি তাকে বলেছি সে কেন এরকম আচরন করে? জবাবে রোদেলা চুপ করে বসে থেকে আমার হাতটা তার হাতের মাঝে বন্ধ করে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। কোন কথা বলল না শুধু তার মাথাটা আমার বুকে রেখে বসে রইলো।

রোদেলা বরাবরই এরকম। যখন কষ্ট পায় তখন আমাকে ছেড়ে যায় না কখনো কিন্তু যখন আনন্দে থাকে তখন আমাকে ভুলে যায়। এমন অনেক বারই হয়েছে যখন আমাদের মাঝে কথা হতো না। প্রথম প্রথম ১ দিন, সর্বোচ্চ ২ দিন আমাদের কথা হয়নি। সে এগিয়ে আসেনি কখনোই।

আমিই নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ওর সাথে কথা বলেছি। তবে সে আমাকে এড়িয়ে চলেনি। আমি কথা শুরু করে দেয়ার পর সে ঠিক আগের মতোই আমার সাথে ভাল করে কথা বলেছে। তবে এই কথা না বলে থাকার স্থায়ীত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রোদেলার এক রোখা স্বভাব আর রোদেলার প্রতি আমার অত্যধিক ভালবাসা বারেবারে রোদেলার কাছে নিজেকে ব্যাক্তিত্বহীন করে তুলেছিলাম।

ভালবাসার কাছে আবার ব্যাক্তিত্বের বিবাদ হবে কেন? আমি তাঁকে ভালবাসি এটাই সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু রোদেলা তার প্রচণ্ড রকমের ব্যাক্তিত্ব দেখাতে গিয়ে আমাকেও অবহেলা করেছে। কখনো এক মাস, কখনো তারও বেশি সময় আমার সাথে কথা বলেনি কোন কারণ ছাড়াই। রোদেলার শীতলতা দেখে মাঝে মাঝে আমিও এগিয়ে যাইনি। তাহলে কি রোদেলার প্রতি আমার ভালবাসার ঘাটতি পড়েছিল? কখনোই না।

এ কথা মানতে পারব না। যতক্ষণ আমরা পাশাপাশি থাকতাম তার চেয়েও বেশি স্পর্শে থাকতাম যখন আমরা দূরে থাকতাম। এক একটা রাত বড়ই যন্ত্রণার কেটেছে। অপেক্ষা করে ছিলাম শুভ্র সুন্দর একটা সকালের আশায়। সকাল এসেছে কিন্তু আমরা হয়তো কেউই ঠিক ফিরে আসতে পারিনি।

আমরা পাশাপাশি বসে থাকতাম পুরনো কিছু চিরাচরিত অভ্যাসের কারণে ... যদিও অনেক পুরনো এ আত্মীয়তা পাশাপাশির ছন্দপতন আমাদের অজান্তেই তবুও পাশাপাশি বসে থাকা নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাসে। আমাদের শেষ কথা হয়েছিল সেদিন ক্যাফেটেরিয়ায়। রোদেলা বসে বসে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে খেলা করছে অথবা কে জানে হয়তো অভিমানে বৃষ্টি ফোঁটাকে চোখের জল ভেবে অবহেলে ফেলে দিচ্ছে। জানা হয়নি সে কথা। রোদেলাও বলেনি।

এই ধারাবাহিক নির্লিপ্ততা আমাদের মাঝে দুস্তর ব্যাবধান করে দিয়েছে। আজ আমরা একে অন্যকে ভালবাসলেও হয়তো কেউ কাউকে আপন করে চাই না। আমাদের কাছাকাছি থাকার স্মৃতি খুব একটা সুন্দর না। পরিমানও কম। হতাশা বেশি।

তাই হয়তো আমরা সেদিন চুপ চাপ বসে ছিলাম পুরনো কিছু অভ্যাসে। এর পর রোদেলা আমার সাথে কোন যোগাযোগই করেনি। আমি প্রথম দিকে খোঁজ নিতাম। তখন তাকে কিছু সময় হাস্যোজ্জ্বল দেখেছি আবার কখনো নির্লিপ্ত নয়নে রাজ্যের মেঘ দেখে চমকে উঠেছি। এই পর্যন্তই।

চোখের আড়াল হতে হতে আমরা একসময় মনেরও আড়াল হয়ে গেলাম। রোদেলার কোন খোঁজ আমি আজ আর পাই না। সেও কি আমার কোন খোঁজ জানে? দেশের সবচেয়ে পাঠক প্রিয় ম্যাগাজিন মাসিক ‘পানকৌড়ি’র কার্ত্তিক সংখ্যায় একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম। সম্পাদক সাহেব নিজেই আমাকে ফোন করে কবিতা দিতে বললেন। অনেক সম্মানিত বোধ করেছিলাম।

খুব ভাল লেগেছিল। আজ কার্তিকের ৭ তারিখ। সৌজন্য সংখ্যা এখনো হাতে পৌঁছায়নি। তবে বাজারে না কি এসেছে। শোনার পর দেরি করলাম না।

দ্রুত ছুটলাম আজিজ মার্কেটে। ‘পানকৌড়ি’ তে নিজের লেখা পড়ে খুব আনন্দিত আমি। খুশি মনে মার্কেট থেকে বের হয়ে আসছি এমন সময় চোখ যেন কোথাও আটকে গেল। তাকিয়ে দেখি বইয়ে মুখ গুজে খুব মনোযোগ দিয়ে নিশাত কি যেন পড়ছে। “নিশাত না? কি খবর?” নিশাত যেন চমকে উঠল।

তবে ভাল কিংবা খারাপ কোন খবরই জানাল না। কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, 'কি বই কিনছ?' নিশাতের উত্তর শুনে ভাবনাতে পড়ে গেলাম। আজ পর্যন্ত এমন মানুষ চোখে পড়েনি যারা কিনা বইয়ের ঘ্রাণ শুকে বই কিনে। এটা নিশাতের চপলতাও হতে পারে। যাচাই করার জন্যেই বললাম, “বইয়ের ঘ্রাণ তো আর লেখার মানের উপর নির্ভর করে না।

এখন যদি বিদিশার এরশাদের লেখা বইয়ে তুমি ফুলের সুবাস পাও, তখন?” নিশাত যেন একটু বিরক্ত হল। চোখে মুখে একটা বিরক্তির আভাস দেখতে পেলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নিশাতকে লাচ্ছি খাওয়ার কথা বললাম। হেমন্ত চলে এলেও এখনো প্রকৃতি অনেকটাই রুক্ষ, শুষ্ক। ভাবলাম একটু ঠাণ্ডায় বসে নিশাতের সাথে কিছু আলাপ জমান যায়।

অনেকদিন পর দেখা। বেশ ভাল লাগছিলো। ভাবিনি কখনো এভাবে কোথাও দেখা হবে। নিশাত দাওয়াত কবুল করলে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা, আমার উপর কেউ কোন কারণে বিরক্ত হয়ে আছে জানলে ভীষণ অস্বস্থি হয়।

আপাতত এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচা গেল। নিশাতই ঠিক করলো ডাসে লাচ্ছি খাবে। ডাসের পিছনে একটা বড় কড়ই গাছের নিচে আমরা বসে লাচ্ছি খাচ্ছি। “তারপর? আর কি খবর তোমার? আর তোমার বন্ধুর?” বেশ চটপটে উত্তর দিল নিশাত “উমম, ও আছে, ওর মতো। আমি আছি, আমার মতো”।

শুনে বেশ ভাল লাগলো। তবে ক্যাফে মেঙ্গোর সেই নিশাতকে আজ একটু অন্যরকম মনে হল। খুব পরিচিত অভ্যাস বদলে ফেললে মানুষ কিন্তু বদলে যায় না। তাতে অন্য কোন ঘটনা থাকে। থাকে কিছুটা রহস্য।

কথা ঘুরানোর জন্যই আমার হাতের ম্যাগাজিন নিয়ে কথা বলল নিশাত। ওকে আমার কবিতাটা দেখালাম। বেশ অবাক হয়েই ম্যাগাজিনটা হাতে নিলো। কিছু সময় যেন সে কবিতার মাঝে ডুবে গিয়েছিলো। হঠাৎ আবৃতি করলো কবিতার কিছু লাইন... “জলে মেঘে বেশ গল্প থাকে গল্প থাকে না এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না রোদ থাকে সে নগর জুড়ে”।

হঠাৎই কেমন যেন এলোমেলো মনে হল নিশাতকে। একটু বিষণ্ণ। এবার মনে হয় সেই পুরনো নিশাতকে ধরতে পাড়ছি। জানতে চাইল, “আচ্ছা, সত্যি কি এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না?” চমকে উঠলাম। ছোট খাট একটা ধাক্কার মতো খেলাম।

হাত থেকে চলকে একটু লাচ্ছি পড়ে গেল মাটিতে। বিরাট রহস্যময় এই পৃথিবী। বিরাট রহস্যময়। রোদেলাও ঠিক এই কথাই আমাকে বলেছিল। তার কথায় একটা আবেগ ছিল।

কিছু কান্না ছিল। নিশাতের কথায় একটা জিজ্ঞাসা ছিল। কোথায় যেন একটা শুন্যতা ছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। কি অবলীলায় না এই প্রকৃতি আমার সাথে হরদম বিভিন্ন খেলা খেলে যাচ্ছে! এই খেলায় আমিই প্রতিবার পরাজিত হচ্ছি।

সেদিন যেমন রোদেলাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি আজ একই উত্তর নিশাতকেও দিতে পারলাম না। শুধু আমতা আমতা করে এটুকুই বললাম, “এটা…একটা কবিতা…শুধু কবিতা…”। আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। খুব দ্রুত লাচ্ছি শেষ করে উঠে পড়লাম। নিশাত একটু অবাক হল।

আমি জেনে শুনেই উঠে পড়লাম, জানি ঠিক হয়নি এভাবে চলে আসা, তবুও। কেন এমন হয়? নিশাত আর রোদেলা আমার চোখে এক মায়াজাল তৈরি করে ফেলেছে। কে আলো আর কে মরীচিকা? বিবর্ণ ক্যানভাসে কখনো নিশাত আবার কখনো রোদেলার পদচারণে আমার পৃথিবীতে এক দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কেউ খুব কাছে আবার কেউ অসীম দূরত্বে। কখনো নিশাত স্মিত হাসির জালে বেঁধে ফেলছে।

আবার কখনো রোদেলার অনুপস্থিতির তীব্র যন্ত্রণা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাঁচতে ইচ্ছে করছে খুব। বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে। এখন নিশাতই যেন রোদেলা আর রোদেলা অনেক বিবর্ণ।

রোদেলার হাসি আমি ভুলে যাচ্ছি। রোদেলার প্রতিনিয়ত নির্লিপ্ত ভাবাবেগ আর নিশাতের ঝলমলে উপস্থিতি আমার চোখে যন্ত্রণার জাল বুনছে। গত এক মাস ধরে প্রতিদিনই ক্যাফে মেঙ্গোতে যাচ্ছি। কফি হাতে নিয়ে বসে থাকি। এক লাইনও লিখতে পারি না।

রোদেলাকে নিয়ে লেখা অংশ গুলো বারবার পড়ি কিন্তু স্বস্থি পাই না। এলোমেলো লাগে। নিশাতের বসে থাকার টেবিলে তাকালে অন্য ধরনের এক ভাল লাগায় মন ভরে যায়। আমি লেখা বাদ দিয়ে, কবিতা লিখতে না পাড়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নিশাতের টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিশাত এতো দিনেও কফি শপে আসেনি।

আজ এলো। নিশাতের দিকে তাকানো যায় না। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখটা অনেক শুকনো। পোশাকেও কেমন যেন জীর্ণতা।

দীর্ঘ বিষণ্ণতা চোখে মুখে। কফি শপে ঢুকেই সে তার নির্ধারিত টেবিলে গিয়ে বসল। ওয়েটারকে কফির অর্ডার দিয়েই আমার দিকে তাকাল। এই নিশাত অনেক বিক্ষিপ্ত। একে আমি চিনি না।

আমার দিকে তাকিয়ে ছোটো একটা হাসি দিয়ে নিশাত মাথা নিচু করে বসে রইলো। আমি উঠে গেলাম। হেসে হেসেই বললাম, কি আজ এতোদিন পর যে? নিশাত মাথা নিচু করেই বলল, এইতো... চেয়ারটা সরিয়ে বসলাম। নিশাত যেন একটু বিরক্ত হল। 'আজ কি তোমার মন খারাপ? তোমার বন্ধু কোথায়?' এইবার নিশাতের চোখে মুখে কান্নার একটা ছায়া দেখতে পেলাম।

অবাক হলাম। আগ্রহ হচ্ছিল খুব। আজিজ মার্কেটে দেখা হবার পর এই একমাসে আজই প্রথম দেখা হল আমাদের। সেদিনের নিশাতের প্রশ্ন এড়িয়ে চলে এসেছিলাম। আজ কি নিশাত আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে? উত্তর পেলাম না।

এমন সময় ওয়েটার কফি দিয়ে গেল। নিশাতকে আস্বস্থ্য করলাম কফি খেয়েছি। তুমি খাও। সে মানবে না। তার একা কফি খেতে ইচ্ছে করে না।

তাই আমি আমার কফির জন্য অপেক্ষা করছি। এতোটা সময় আমরা কেউ কোন কথা বলিনি। শেষে নিশাতই শুরু করলো, “আচ্ছা, এই নগরে অষ্টপ্রহর প্রেম থাকে না কেন বলতে পারবেন?” আবারো একই প্রশ্ন। আজ উত্তর দেয়া দরকার। ‘নিশাত অষ্টপ্রহর প্রেম আমরা অন্তরে লালন করি কিন্তু প্রকাশ করতে ভয় পাই।

যদি সেখানে রোদের ঝলকানিতে ভালবাসা পুড়ে যায়, এই ভয়ে!’ নিশাত অবাক হল। বলল, ‘কষ্ট না পেলে এমন মনে দাগ কেটে যাওয়া সত্য কবিতা লেখা সম্ভব না। আপনার কবিতার প্রেরণা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ’ নিশাতকে আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সব।

একে একে সব কথাই বললাম অবশেষে। রোদেলার কথা। তার ফিরে না আসার কথা আর আমার দীর্ঘ অপেক্ষার কথা। নিশাতকে খুব দুঃখী একটা মেয়ে মনে হল। তবে জানতে ইচ্ছে করলো না কেন সে আজ এতোটা বিমর্ষ।

আমার গল্প শুনে নিশাত অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কোন কথাই সে বলল না। আমিই বললাম, ‘নিশাত দিন শেষে রাতের যে তীব্রতা আর দীর্ঘ একাকিত্তের যন্ত্রণা এ সব এখন খুব মিনিংলেস মনে হয়। কেউ কখনো কারো জন্যে অপেক্ষা করে বসে থাকে না। এতদিন রোদেলার জন্য অপেক্ষা করে আমি ভুল করেছি।

আজ মনে হয় আমারও অধিকার আছে ভালবাসা পাবার। রিক্সায় করে বৃষ্টিতে ভেজার'। নিশাত খুব মন দিয়ে কথা গুলো শুনছিল। ওর চোখে রাজ্যের অশ্রু জমা হচ্ছে। এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে ফেলতে ইচ্ছে হল, ‘নিশাত আমি কি এই চোখের জল মুছে দেয়ার যোগ্য? তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দিবে?’ বলে দিলাম সব দোদুল্যমনোতা কাটিয়ে। নিশাত চমকে উঠে তাকাল আমার দিকে। তার চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিশাতের ঝড়ে পড়া কষ্ট স্নাত অশ্রু ফোঁটার দিকে। নিশাতের কথাঃ মেঘ-রৌদ্রের খেলা।

রিকের কথাঃ অসঙ্গায়িত ভালোবাসা আর অতৃপ্ততার কাহন। প্রচ্ছদঃ বোকা ছেলে শেষ পর্ব পড়তে সাথে থাকুন। ধন্যবাদ সবাইকে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।