আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কফিশপ - প্রথম পর্ব

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... নিশাতের কথাঃ আবছা ভালোবাসা অনেকক্ষন ধরে বসে আছি, প্রায় ৩০ মিনিট হয়ে গেলো। নেহায়েত আমাকে প্রতি সপ্তাহে দুই তিনবার করে দেখে, নতুবা এতক্ষণে ওয়েটারগুলো বার বার বাঁকা দৃষ্টি দেয়া শুরু করে দিতো। অসহ্য লাগছে আমার, মনে হচ্ছে উঠে চলে যাই। রিক এসে ঘুরে যাক; ওর জন্য এরকম শাস্তিই ঠিক হবে। কিন্তু ভয়ও হয়, যদি রিক আর না আসে? রিকের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় ২ বছরের, কিন্তু এখনো আমি ওকে বুঝে উঠতে পারিনা।

সম্পর্ক? হাসি পায়। কি ধরনের সম্পর্ক আমাদের? কেউ কাউকে কখনো বলিনি যে ভালোবাসি; কিন্তু কেউ কাউকে না দেখে থাকতেও পারিনা। আমি কি রিকের ভালোবাসা, অভ্যস্থতা নাকি শুধুই বন্ধু? প্রশ্নটা আমার ভেতর বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়; জোর করে দমিয়ে রাখি। না, এর উত্তর আমি জানতে চাইনা; আমি শুধু রিকের কাছাকাছি থাকতে চাই। ওর এলোমেলো চুল আর উদ্ধত দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে চাই, শক্ত করে ধরতে চাই হাত।

একদম কাছাকাছি--- “ম্যাম, কিছু কি নেবেন?” চমকে উঠি আমি। ভাবনায় ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হই। তাকিয়ে দেখি ক্যাফে ম্যাংগোর নতুন ওয়েটার। নতুন বলেই এসে জিজ্ঞেস করেছে, পুরানো কেউ হলে ভুলেও বিরক্ত করতে আসতো না। “না, এখনো না।

আমি ডাকবো”। মোবাইল টিপে নাম্বার বের করি আমি, অস্থির রিক। কিন্তু রিকের অস্থিরতা এখন আমার মাঝেও ছড়িয়েছে; আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো? “সরি, দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ আনরিচেবল নাও। প্লিজ…” বাকি টুকু শোনার আগেই আমি মোবাইল বন্ধ করি। যদি নিজের ইনকাম থাকতো নির্ঘাত মোবাইলটা আছড়ে ফেলতাম।

বাবার দেয়া জন্মদিনের উপহার বলেই ফেলতে পারিনা। ডান পাশে কি মনে করে তাকাতেই দেখি চশমা পড়া ছেলেটা বসে আছে, আজও। আমার ভাব ভঙ্গিই দেখছিলো মনে হয়, তাকাতেই চোখ নিবদ্ধ করলো সামনে রাখা নেটবুকের উপর। একটু লজ্জা পেলাম, কতটা বিরক্তি ছিলো আমার চোখে মুখে? সবাই কি বুঝতে পেরেছে যে আমি রিকের ওপর বিরক্ত? ক্যাফে ম্যাংগো আমাদের ভীষন প্রিয় কফি শপ, আমাদের মানে আমার আর রিকের। খাবারের মান খুব বেশি ভালো নয়, সে অনুযায়ী দামটাও একটু বেশিই হয়ত।

কিন্তু অসম্ভব স্নিগ্ধ পরিবেশ। চমৎকার ধীর লয়ের মিউজিক বাজতে থাকে সবসময়। হালকা লাল আর মেরুন দেয়াল দিয়ে ঘেরা শপটার এক পাশে আড্ডা মারার জায়গা, আরেকদিকে লাজুক হাসির সাথে কফি পানের জায়গা। স্মোকিং জোনটা বাইরে, বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানানো। রিকের সাথে আমার প্রথম দেখা এই কফি শপে।

চোখ বন্ধ করলেই দিনটা এখনো ভেসে ওঠে; ২ বছর আগের মেঘলা একটা দিন। মেঘলা ছিলো বটে, কিন্তু বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা ছিলো না। ৬ মাস ফেসবুক আর ইয়াহুতে মেসেজ চালাচালি আর চ্যাট করে আমাদের ল্যাপটপগুলোর আয়ু কমানোর পর রিকই বলেছিলো, “লেটস মিট নুশা”। নুশা, কাঁপন জাগে আমার এই নাম শুনলেই। আমার নাম নিশাত, বাসায় আদর করে নিশা ডাকে, বন্ধুরা কেউ নিশুও ডাকে।

কিন্তু নুশা…… রিক অধিকার নিয়ে ডাকে। যেন আমার নুশা হবারই কথা ছিলো, জন্ম জন্মান্তর ধরে। সেদিনও রিক দেরী করেছিলো। ৫ না ১০ না পাক্কা ৪০ মিনিট লেট। আমি যখন মোটামোটি নিশ্চিত যে রিক আসবে না, তখনই দরজা ঠেলে ঢোকে সে।

কেউ আমাকে বলে দেয়নি, কিন্তু আমি তাকে দেখামাত্র বুঝি সে রিক। ফেসবুকে তার অনেক ছবি দেখেছি; না সে ছবির জন্য নয়। যে অস্থিরতা সে ছড়িয়ে রাখতো ফেসবুক আর ম্যাসেঞ্জারের উইনডোতে; সেই অস্থিরতা যেন এক মুহূর্তে বাস্তবে চলে এসেছিলো। কেউ লক্ষ্য না করলেও আমি করেছি, রিক ঢোকা মাত্র ক্যাফে ম্যাংগোর ভেতরটা ছটফট করে উঠেছিলো। আমার ৪০ মিনিটে জমা করে রাখা রাগ, ক্ষোভ সব এক নিমিষে কোথায় পালালো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

অবাক হয়ে শুনলাম আমি বলছি, “এসেছো তাহলে?” “আসলাম তো; আলমাসে আসছিলাম একটা পারফিউম নিতে। ভাবলাম রাস্তাটা ক্রস করে তোমাকে দেখা দিয়েই যাই”- ঝড়ো হাওয়ার মত হাসি রিকের। আমি কিছু বলতে পারিনি; নিজের অস্তিত্ব টালমাটাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। রিক নিঃশঙ্কচিত্তে তার বড় বড় কালো চোখ আমার উপর নিবদ্ধ করে প্রশ্ন করতে পারে, “তারপর?” আমি তাও নিশ্চুপ ছিলাম; গলার কাছে জমাট ধরা কিছু একটা আমাকে বাঁধা দেয়। বুক ভরে রিকের গিভেনশি নিও পাই পারফিউমের সুবাস নিতে নিতে শুনি ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে রিক অর্ডার দিচ্ছে, “একটা এক্সপ্রেসো কফি আর ম্যাডামের জন্য একটা কোল্ড কফি”।

আমি তাও কিছু বলতে পারিনি; বলতে পারিনি যে আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে। আজ অবধি আমি কোল্ড কফিই খেয়ে যাচ্ছি; রিকের ভুল ভাঙ্গাতে পারিনি। জানি সবাই ভুরু কুঁচকাবে, ব্যাঙ্গ করতেও ছাড়বে না; কিন্তু আমি যে পারিনা। কি করবো? রিকের টি শার্টটাও মনে আছে আমার। গাঢ় নেভি ব্লু রঙের, মাঝে লেখা, If you think it’s gonna rain, it will rain”।

আমি মনে প্রাণে চাইলেও রিক চায়নি। তাই যখন আমাকে রিক মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে পৌঁছে দিলো রিক্সায়, আকাশ মেঘলা থাকার পরেও এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো না মেঘ। রিকের সব কিছু আমার জানা, হাতে হাত রাখার পরেও একটা মানুষ কি করে লক্ষ যোজন দূরে থাকতে পারে কেউ বলতে পারো? ৫টা ২০ বেজে গেছে। রিক পাক্কা ৫০ মিনিট লেট। মোবাইল এতক্ষণ কেন বন্ধ? আমার একটু ভয় ভয় করতে থাকে।

আজকালকার যে অবস্থা রাস্তা ঘাটের। রিক আবার চালায় বাইক। মিথ্যে বলবো না, আমার রিককে বাইকের উপর দেখতে ভীষন ভালো লাগে, কি অদ্ভুত ভাবেই না রিক হেলমেটের কাভার সরিয়ে আমার দিকে তাকায়। নিজেই টের পাই আমার রক্ত চলাচল বেড়ে যাচ্ছে—নাহ, যতই অস্বীকার করি না কেন, আসলে আমি রিকের প্রেমে পড়েছি। প্রেম না, প্রেম শব্দে কিছুটা অশ্লীলতা আছে।

ভালোবাসা, রিকের জন্য আমার এক সাগর ভালোবাসা। ডানে এখনো চশমা পড়া ছেলেটা নেটবুকে টাইপ করে যাচ্ছে, পাশে এক মগ কফি। ক্যাফে ম্যাংগোর সব মগ আমার চেনা; ছেলেটা আজ ল্যাতে নিয়েছে। একটু অবাক হলাম, কারন সাধারনত ছেলেটা ক্যাপাচিনো খায়। ছেলেটাও গত ৭/৮ মাস ধরে রেগুলার।

আমি আর রিক আসি প্রতি শনি, রবি আর বুধবার। সাধারনত শুক্রবার আমরা অন্য কোথাও ডিনার করি। প্রতিদিন ছেলেটাকে দেখি। অফিস শেষ করেই মনে হয় চলে আসে, কাজ করতে করতে কফি খায়। কখনো কোন বন্ধুকেও দেখিনি।

রিক এত দেরী করে, প্রায়ই মনে হয় ওকে জেলাস করার জন্য এই ছেলের সাথে গল্প শুরু করি। এসব অদ্ভুত কথা মনে আসার জন্য নিজেই হাসি। ছেলেটা রিকের মত লম্বা না হলেও বেশ লম্বা। হ্যান্ডসাম বলা যায় না, কিন্তু মায়াকাড়া চেহারা। চশমাটার জন্য একটু গম্ভীর ভাব আছে।

মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয়, ছেলেটা কে? “নুশা, অর্ডার দাওনি কিছু?” চমকে তাকাই আমি। রিক কখন ঢুকলো? এমন ভাবে প্রশ্নটা করলো যেন কিছুই হয়নি। হঠাৎ করে রাগ লাগে আমার, অসম্ভব রাগ। “রিক, তো্মার আসার কথা কয়টায়? মোবাইলের সমস্যা কি?” “ওহ, মোবাইল?” কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে হাত নাড়ে রিক। “মোবাইলটা সাজিয়ার কাছে রেখেছিলাম ক্লাসের সময়।

আর নিতে মনে নাই”। মাথার ভিতর কিছু হয়ে যায় আমার। সাজিয়া? রিকের মোবাইলে আমার অসংখ্য মেসেজ, কেন মোবাইল সাজিয়ার কাছে থাকবে? “ভালো। আর দেরী কেন হলো? সাজিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিলে নাকি?” রিক তার বিখ্যাত দুষ্টুমি দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ আমাকে দেখে। দমকা হাওয়ার মত হেসে ওঠে।

“ও মাই গড! নুশা! আর ইউ জেলাস? ওয়াও, ইউ আর সো সো জেলাস”। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয় আমার। অনেক কষ্টে মনোভাব লুকিয়ে বলি, “জেলাস হবো কেন? আমি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড? কাউকে ৫০ মিনিট অপেক্ষা করানো যে কোন ভদ্রতার মাঝে পড়ে না সেটা তোমার বোঝা উচিত”। “ওরে খাইছে রে”। রিক হাসতেই থাকে।

“এই ভালো স্টুডেন্টদের সাথে থাকাই সমস্যা, বুঝলা না? খালি জ্ঞান ঝাড়াঝাড়ি। আর মেডিকেলের ছাত্রী মানে তো……” কথা শেষ করতে পারে না রিক হাসির জন্য। “থাকতে কে বলেছে?” উঠে দাঁড়াই আমি। রাগে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি আমি। অদ্ভুত কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

চশমা পড়া ছেলেটার সামনে গিয়ে নেটবুকটা কেড়ে নিয়ে আছাড় দিই? কাউকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। “আরে বাবা, সরি সরি। বললেই যেতে দেবো নাকি?” “ঠেকাবে কি করে?” বলেই হাঁটা দেই। রিক আমার হাত ধরে ফেলে। অদ্ভুত কন্ঠে বলে, “হারাই হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে।

পলক না পড়িতে হারাইয়া ফেলি চকিতে। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?” আমি চোখ বন্ধ করি। মনে মনে ভাবি, রিক যদি আমাকে না আটকাতো, তাহলেও কি আমি যেতে পারতাম? এই উদ্ধত অস্থির কিন্তু ছেলেমানুষী কান্ডকারখানা করা রিক কে আমি কতটা ভালোবাসি? রিকের কথাঃ ছন্নছাড়া জীবনে নিশাত -- রিয়েল ডেমোন নীরবের কথাঃ কাগজের খেলাঘর -- নীরব০০৯ প্রচ্ছদঃ বোকা ছেলে কফিশপ- দ্বিতীয় পর্ব  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।