আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের শৈশবে দেখা ক্লাব সংস্কৃতি আর রাজনীতির নোংরা থাবায় তার হারিয়ে যাওয়া !!!

shamseerbd@yahoo.com বাসার সামনে বড় একটা মাঠ কিন্তু সেটাতে আমরা খেলতে পারিনা অবশ্য তিন নাম্বার/ চার নাম্বার বল দিয়ে অত বড় মাঠে খেলাটাও বেমানান। সেটাতে খেলে এলাকার সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুনরা ডীয়ার বল দিয়ে যারা প্রায়ই সবাই কলেজে পড়ে । মাঝে আমরা ডীয়ার বলটা নাড়াচাড়া করে দেখি , একদিন আমরাও অমন বল দিয়ে খেলার মত বড় হব সে ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকি । শৈশব কেটেছিল সাগরঘেরা মেঘনা বিধৌত দ্বীপ সন্দ্বীপে , বড় মাঠটিতে যারা খেলত তারা অধিকাংশই বাবার কলেজের ছাত্র আর তাই তাদের সাথে আমাদের শিশুদলের সখ্যতাও কম নয়, তাদের বিরতিতে পাশের ছোটমাঠে খেলতে থাকা আমরা বড় মাঠে ডীয়ার বলটিতে হালকা লাথি দিয়ে পায়ের শক্তি যাচাই করার চান্স নিতাম। উপজেলা কমপ্লেক্সের মাঠটির পরেই রাস্তা আর তার পাশেই ছোট্ট একটা টিনের ঘর।

এলাকায় সেটা ক্লাব ঘর নামেই পরিচিত । কয়েকটা চেয়ার , ফ্রেমের উপর একটা ক্যারামবোর্ড । অবসরে ঐ বোর্ড থাকে সরগরম। এলাকার তরুন যুব সমাজের আড্ডার জায়গা । যারা আড্ডা দেয় তাদের কে নিয়ে কারো কোন অভিযোগ নেই, সবাই ভদ্রগোছের পোলাপান, লেখাপড়া করে, অবসরে ক্লাবে অথবা মাঠে ।

। ক্লাবের এই ছেলেপেলেগুলো প্রায়ই অন্যান্য পাড়ার ক্লাবের সাথে ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করত । সে এক জমজমাট আয়োজন। বলতে গেলে পুরো গ্রামের সব মানুষ জনের ঐ দিনের আলোচনার টপিক থাকত ঐটা, সাধারনতঃ শুক্রবারেই হত এই আয়োজন। কখনো জয় কখনো পরাজয় এমনই নানান রং এ ভরা সে দিংগুলো।

প্রবাসী কেউ দেশে এলে তার কাছে আব্দার করে জোগাড় করা হত নতুন একটা বল কিংবা একসেট জার্সি, সেটা নিয়ে চলত পরের ম্যাচ আয়োজনের চিন্তা। ৯০ এর দশকে সম্ভবত এই বাংলায় এমন কোন এলাকা পাওয়া যাবেনা যেখানে নানান নামের এমন সব ক্লাবগুলোর অস্তিত্ব ছিলনা। একাদশ , শতদল, স্টার - নানন শব্দ ধারনকরে করা হত সে নামকরন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর মাইকে গানের হল্লাবসিয়ে গ্রাম বাংলায় এই বিশেষ দিন গুলো মূলত ধরে রাখত এই ক্লাবগুলোই । খেলাধুলায় এই বড় ভাইরাই ছিল আমাদের আদর্শ, অমুকের মত খেলতে হবে তমুকের মত শর্ট করতে হবে, ম্যারাডোনা যে অসাধারন এক খেলোয়াড় তাত এই বড় ভাইদের কাছ থেকেই জানা ।

মোহামেডান আর আবাহনীর খেলার দিন এই ভাইরাও হয়ে যেত দুই ভাগ- তা ঐ খেলার সময়ই শুধু। এলাকার যেকোন বিয়ের আয়োজন থেকে শুরু করে মৃতের দাফন এই তরুনদের ছোঁয়া ছিল সবখানেই । এরশাদের পতনের পর সংসদ নির্বাচন। চারদিকে মিছিল মিটিং এর হৈহল্লা। ক্লাবের কিছু সিনিয়র তরুনের হাত ধরে একদিন পুরো ক্লাবটিকেই একটি রাজনৈতিক দলের পোস্টারে ঢেকে দেয়া হল, বিরোধের শুরু এইখান থেকেই।

রাতারাতি মতবিরোধের জের ধরে পাশেই আরেকটি ঘর উঠল সেটাতে অন্য দলের পোস্টার। দুভাগ হয়ে তরুনরা দুই ঘরে আড্ডা দেয়, ক্যারাম খেলে । শুরু হল ক্লাব ঘরেই ছেলে পেলের সিগারেট টানা যেটা আগে কখনো আমরা দেখিনি। খেলার মাঠে বল নিয়ে ছোটার চেয়ে পোস্টার মিটিং এই সব নিয়েই ব্যস্ত। মাঠটি আমাদের দখলে আমরা তাতেই খুশি।

ঐ মাঠে সেইসব তরুনরা আর ফিরে আসেনি............. ক্লাবঘরের পেছনে আরেকটি ঘর উঠল- শুনতাম সেখানে জুয়া খেলা চলত। এরপর শুরু হল আমার চট্টগ্রাম জীবন - রামপুরার ঈদগাঁ বউবাজার এলাকায় । নানার বাড়িও ঐখানেই। রামপুর ক্রিকেট ক্লাবের নাম ডাক সেখানে কারন তারা কাঠের বলে ক্রিকেট খেলে। ছোট মামার বন্ধুরা এই ক্লাবের সর্বেসর্বা।

কাঠের বলে খেলার মত বয়স তখনও হয়নি বলে আমরা টেনিস বলে খেলি আর ওদের খেলার দর্শক- মনে মনে ভাবনা একদিন আমরাও কাঠের বলে খেলব !!! সিনিয়ররা নানান ব্যস্ততায় বিভিন্ন কাজে জড়িত হওয়ায় এই ক্লাবটি একসময় কার্যক্রমহীন হয়ে গেল। এরপর দেখলাম মামার বন্ধুরা সবাই মিলে নতুন একটা ক্লাব বানাল "রামপুর যুব গোষ্ঠী" নামে । একটা ঘরও হয়ে গেল ক্লাবের। সেখানেও যথারিতী ক্যারামবোর্ডের জন্য একটা জায়গা ছিল, বড়দের ফাঁকে মাঝে মাঝে আমরাও সেটাতে ব্যস্ত হতাম। এখনকার মত তখন প্রতিটি ঘরেই পেপার রাখার খুব একটা চল ছিলনা।

পাড়ার ক্লাব ঘরটায় ছিল পেপার পড়ার মুল জায়গা। এখানে দুতিনটি পেপার রাখা হত। এখানে দেখলাম নতুন একটা উদ্যেগ হাতে নেয়া হয়েছে । এলাকার স্কুলে যায়না এমন সব ছেলে পেলেদের জন্য একটা শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। দরিদ্রঘরের ছেলেপেলেরা অন্তত অক্ষর জ্ঞানটা লাভের একটা সুযোগ পেয়ে গেল তাতে , বিপুল উৎসাহে তারা বেশ উচ্চ স্বরে লেখাপড়া করত।

এই ক্লাব ঘরকে কেন্দ্র করেই পাশেই গড়ে উঠল একটা বই ঘর। যেখানে বিশ টাকা দিয়ে সদস্য হয়ে মাত্র দুই টাকার বিনিময়ে একটি বই তিনদিনের জন্য ভাড়া নেয়া যেত । আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ এর আলোকিত মানুষ গড়ার গল্প তখনও জানতামনা কিন্তু পাড়ার ঐ লাইব্রেরী যেন সে কথারই প্রতিধ্বনি করছিলো । সারাবছর ধরে ফুটবল টুর্নামেন্ট, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এমনকি ইনডোর গেমস- নানা আয়োজনেই ব্যস্ত ছিল ক্লাবটি। মঞ্চ নাটক যে কত সুন্দর হতে পারে তা প্রথম দেখেছিলাম বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে এই ক্লাবের আয়োজিত নাটকে।

ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্ঠরা এলাকায় কোন দূর্নামের ভাগিদার ছিলেননা, আর তাই নাটকের নায়িকার চরিত্রে এলাকার একটি মেয়েকে অভিনয় করতে বলায় তার পরিবারও বাঁধা দেয়নি। আমি নিশ্চিত ঐ একই এই ২০১১ সালে এসে তার মেয়েকে পাড়ার ক্লাবের এই ধরনের কোন কাজে সম্পৃক্ত করতে চাইবেননা। কি চমৎকার ছিল সেই নাটকের মহড়া- আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন এক জিনিস, আমরা ক্লাব ঘরের বন্ধ জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে তা দেখার চেস্টা করতাম আর বড়রা আমাদের ভাগিয়ে দিত................ রাজনৈতিক নানা ক্যাচাল বিশেষ করে কমিশনারের ভাই গংদের সূক্ষচালে এই ক্লাবটি একসময় নির্বিষ হয়ে গেল, তালাও খোলা হতনা অধিকাংশ দিন। মুরুব্বী শ্রেনীর এই ক্লাবটির নিস্পৃহতায় এলাকার খেলাধুলার আয়োজনে বেশ ভাটা পড়ে গেল। ইত্যবৎসরে ক্লাব ঘর না থাকলেও আমরা সমবয়সীরা খেলাধূলা কেন্দ্রীক আরেকটি ক্লাবের জন্ম দিলাম রামপুর রাইজিং স্টার নামে।

আমাদের দেখাদেখি পাশের পাড়ার ছেলেপেলেরাও একটা ক্লাবের নামকরন করল রামপুর ইয়ুথ ক্লাব নামে । দুক্লাবের ক্রিকেট ম্যাচ গুলো ছিল মনে রাখার মত। আজকে আমরা জিতলামতো সাথে সাথে তারা আবার নতুন চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিল, সেটা আমরা গ্রহনও করে নিতাম সাথে সাথে- ক্লাবের মানসন্মান বলে কথা। আমরা হারলে আমরাও একই কাজ করতাম। খেলার বাইরে আর অন্য কোন কার্যক্রম ছিলনা আমাদের, বিভিন্ন এলাকায় হওয়া টুর্নামেন্ট গুলোতে আমরা খেলতে যেতাম ।

এসএসসির পরপর আমাদেরই অনেক বন্ধু রাজনীতিতে জড়িয়ে পরল, কেউ কেউ মামলার আসামিও হয়ে গেল। রাজনীতির কল্যানে মাঠে আর কাউকে পাওয়া যেতনা বিকেলের অবসরে অথচ পরীক্ষা শেষ হবার পর প্রতিটি দিন সকাল বিকেল আমাদের কাটত মাঠে। অবস্হা এমন হল ম্যাচ খেলার মত দলই হতনা................. ঐ খানে এখন আর কোন ক্লাব নেই, শুধু জানি ঝড়ে গেছে জীবনের চলার পথে অনেকেই রাজনীতির পিচ্ছিল পথে পা বাড়িয়ে । ঐ এলাকা থেকে আমরা বাসা বদলে চলে এলাম উত্তর নালাপাড়ায় । এখানেও পেলাম দুটো ক্লাব।

উত্তর নালাপাড়া একাদশ আর প্রত্যাশা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংঘ । খেলাধুলা নিয়েই এদের কাজবার। অধিকাংশ পাড়াত ক্লাবগুলোর নিয়মিত কার্যক্রমের একটা ছিল শীতকালে বনভোজনের আয়োজন, যাতে দেখা যেত পাড়ার অনেকেই সপরিবারেও অংশ নিত। উত্তর নালাপাড়া একাদশের সংগঠকদের একজন ছিল বন্ধু লিংকন। সে একদিন জানাল বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে তারা দেয়ালিকা ছাপাবে, আমি কোন লেখা দেব কিনা।

সত্যি বলতে কি এর আগে কোনদিনও আমি কিছু লিখি নাই। গল্প কবিতা যেকোন কিছু হলেই চলবে। এলাকার ছেলেপেলের সাথে আমার তখনও তেমন সখ্যতা হয়ে উঠে নাই, ভাবলাম দেয়ালিকায় একটা লেখা দিলে এটা তৈরি হতে পারে, আর কবিতা লেখাটায় সবচেয়ে সোজা মনে হল !!!!! কিভাবে কিভাবে যেন আট লাইনের একটা কবিতাও লিখে ফেললাম !!!! আমার প্রথম লেখা -মান যায় হউক প্রথম বলে কথা, আর ঐ ক্লাবটি এমন উদ্যেগ না নিলে হয়ত কখনোই আমার লেখালেখি করা নাও হতে পারত। ডায়েরির শেষ পাতায় লিখেছিলাম ঐ কবিতা , কারন এরপর আর কখনো লেখা হবে কিনা ভাবিনি। পরে আরো অল্পবিস্তর যখন লেখার ট্রাই করেছি তখন ডায়েরির শেষ থেকে প্রথম দিকে লিখে গেছি !!!!! আমার লেখালেখির শুরুর পেছনে ঐ ক্লাবটির এই উদ্যেগটাকে সবসময় স্মরন করি আমি।

ঐ দুটো ক্লাবও আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে - কারন সেই একটায়, রাজনীতি, পাড়াতেই চিটাগং সিটি কলেজ আর ইসলামিয়া কলেজ -চট্টগ্রামের নোংরা ছাত্ররাজনীতির সূতিকাগার বলা চলে এই কলেজ দুটোকে, এর ছায়া অচিরেই মারিয়ে দিয়েছিল ঐ ক্লাব দুটোকে- সেই সাথে মাদকের করাল গ্রাসত আছেই । একটা সময় ক্লাবগুলো হয়ে উঠেছিল পাড়াত মাস্তানি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম, দলবেঁধে ছেলেপেলে এই করে বেড়াত । এরপর সিলেট জীবনে নাম সর্বস্ব অনেক ক্লাব দেখেছি বিভিন্ন আবাসিক এলাকা কেন্দ্রিক, কিন্তু তাদের তেমন কোন কার্যক্রম কখনো চোখে পরেনি। ছাত্ররাজনীতি তখন একটা রমরমা ব্যবসা- এটা অন্যতম একটা কারন হতে পারে হয়ত। ইদানিং খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই ক্লাব সংস্কৃতিটি আমাদের সমাজ থেকে একেবারঐ অপসৃয়মান, কদাচিৎ এই ধরনের নাম চোখে পড়ে কিংবা তাদের কার্যক্রমের নাম শোনা যায় অথচ একসময় এই ক্লাবগুলোই ছিল আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

এই ক্লাবগুলোর জায়গা অনেকাংশেই দখল করে নিয়েছে বড়দুটো রাজনৈতিক দলের নানা অঙ্গসংগঠন। ঢাকা শহরে নালা নর্দমার উপরে এমন সাইনবোর্ডসর্বস্ব হাজারো টংঘর। আর গ্রামের দিকে গেলে চোখে পড়বে জিয়া স্মৃতি সংসদ, রাসেল ক্রীড়া চক্র, মুজিব স্মৃতি সংসদ- বিভাজনের রেখা সুস্পস্ট ভাবেই টেনে দেয়া হয়েছে ঐতিহ্যকে পদানত করে - এ এক কঠিন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে রাজনীতির নামে ধান্দাবাজির বীজ- পাড়াত প্রভাব বিস্তার আর চাঁদার বখরার ভাগ বাটোয়ারর বাইরে সমাজ উন্নয়নমূলক কোন কিছুতেই নেই এদের উপস্হিতি। পাড়ায় পাড়ায় যেসব ছিছকে সন্ত্রাসীর জন্ম- তার আশ্রয় আর প্রশ্রয়দাতা হচ্ছে এই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা সংগঠনগুলো।

ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী একটা সংস্কৃতি- রাজনৈতিক নোংরা হস্তক্ষেপই যার জন্য মূল দায়ী। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.