আমি শুধু ঐ পথের পথিক ছিলাম
মেঘগুলো উড়ে উড়ে চলে গেল পশ্চিমে। হ্যা পশ্চিমে, আম গাছটার মাথার উপর দিয়ে ভেসে ভেসে ওপাশে অনুদের ছাদে ভেঙ্গে পড়ল বোধহয়। প্রায়ই এমন হয়, আমি চেয়ারে আধোশোয়া হয়ে দেখি, মেঘগুলো অনুদের বাড়িতে চলে যায়। অনু আমাদের ক্লাশে পড়ে না তবে আমরা ওকে মাঝে মাঝে খেলায় নেই। ও সেদিন আমাকে কতগুলো লজেন্স দিয়েছিল, আমিও ওকে আমাদের গাছের পেয়ারা দেব বলে ঠিক করেছি।
কিন্তু পেয়ারা এখনো বড় হয়নি, বড় হলেই দেব। পেয়ারা গাছটা খুব সুন্দর হয়েছে, সাদা সাদা ফুলে ভরে গেছে। কিন্তু ফুলগুলো সব নিচে পড়ে যায়। আমি প্রতিদিন সকালে উঠে পেয়ারা ফুলের পাপড়ি কুড়াই, তারপর সেগুলো দিয়ে মালা গাঁথি। আজকেও গেঁথে ছিলাম কিন্তু মালাটা এখন নষ্ট হয়ে গেছে, আমার সাদা ফ্রকের কোলের উপর ধবধবে সাদা পাপড়ি গুলো কেমন কালো কালো হয়ে চুপসে পড়ে আছে।
যাই একটু লাবুদের বাসা থেকে ঘুরে আসি। ওর সাথে কাল কাট্টি নিয়েছিলাম, এখন ভাব নিতে হবে, নাহলে বিকেলে খেলা যাবে না।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুট দিলাম লাবুদের বাড়িতে। ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির সামনেই। রাস্তাটা পাড় হলে জামরুল গাছটার পেছনেই ওদের বাড়ি।
এই গাছটায় অবশ্য প্রচুর বিছা হয়, দেখলেই ভয় হয়, কিন্তু ফলগুল একদম লাল টুকটুকে, আর কি মিষ্টি! লাবু আমাকে সব সময় ওদের গাছের জামরুল খেতে দেয়। যতবারই ওর আব্বু পেড়ে দেয় ও আমার জন্য আলাদা করে রেখে দেয়। আমি ঠিক করে রেখেছি, বড় কাক্কু যে আঙুর গাছটা লাগিয়েছে, তাতে আঙুর ধরলে আমি প্রথমেই ওকে দিয়ে আসব। আমি আমাদের গেট থেকে বের হয়ে রাস্তা পাড় হলাম, কিন্তু একি! জামরুল গাছটা গেল কই? একদিনে এত বড় গাছটা হাওয়া হয়ে গেল কিভাবে? গাছটা কি মরে গেল! তাহলে তো লাবু আর আমাকে জামরুল খাওয়াতে পারবে না। মনটা একটু খারাপ হল, কিন্তু আশ্চর্য হলাম ওদের বাড়িটা দেখে।
সেই ছোট্ট উঠান সহ সুন্দর ছিমছাম দুটি ঘরের বদলে এখন সেখানে দু’তল ভবন বিশিষ্ট বাড়ি। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি, তবে এ বাড়ি যে লাবুদের সেই ছোট্ট সংসার নয় তা বুঝতে পারছি। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে আমি ভেতরের ঢোকার চিন্তা বাদ দিলাম। এর চেয়ে বরং বাধনদের বাসা থেকে ঘুরে আসা যাক।
বাধন্দের বাসা লাবুদের বাসার পাশেই।
ওদের বাড়িটা অবশ্য আমার বেশি ভাল লাগে না, খালি ঘর আর ঘর, কোন গাছপালা নেই। আমার একটুও আপন আপন লাগে না যেমনটা লাবুদের বাসাটাকে লাগে। তবে বাধনও আমার ভাল বান্ধবী। আমরা সব সময় এক সাথে খেলি। ওর আম্মুও আমাকে আদর করে।
ওর বাসার সামনে পৌঁছে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কোথায় সেই ছোট্ট নীল গেট! সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গ্রীলের তৈরী গেট। গেট পর্যন্ত পৌঁছতেই সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়, তাও আবার চারতালা বাড়ি। কি ভয়ংকর! ওদের বাসাটা এমন হল কিভাবে? কেউ একজন সেই দানবীয় গ্রীলের গেট পাড় হয়ে এদিকে আসছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম- বাধনরা কি এখানে থাকে?
সে বলল- ‘মনির-বাধন’রা?
আমি বললাম- হ্যা, মনির ভাই কোন রুমে থাকে? (কারন, মনির ভাই এর রুমেই আমি আর বাধন সব সময় লুডু খেলি)।
সে বলল- মনির তো এহন অর বউ এর লগে থাকে। বাসাবো।
একথা বলে সে চলে গেল। আমি হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পরনে সেই সাদা ফ্রক, হাতে পেয়ারা ফুলের মালা, আমি বসে ছিলাম আমাদের বাড়ির উঠানে সেই চেয়ারটায়, পেয়ারা গাছটার নিচে, আম গাছটাও তো পশ্চিমেই ছিল, আর মেহেদী গাছ, জাম গাছ......হ্যা সবই তো জায়গা মতই ছিল।
তবে লাবুদের বাড়ি, বাধনদের বাড়ি এমন বদলে গেল কি করে? আর মনির ভাই, সে বিয়ে করল কবে? লাবু আর বাধনই বা গেল কই? ওরা কি সবাই বড় হয়ে গেল আমাকে রেখে! এখন আমি একা একা কি করি?
প্রচন্ড হাহাকার আর কষ্টবোধ নিয়ে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। কোথায় সেই সাদা ফ্রক আর পেয়ারা ফুলের মালা! আমি শুয়ে আছি আমার নরম বিছানায়, পরনে রাতের পোষাক। কিছুটা সময় ব্যয় করলাম বাস্তবে ফিরে আসতে। তারপর বিছানা ছেড়ে আমার জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এখনও হয়ত মেঘেরা উড়ে উড়ে পশ্চিমে যায়, কিন্ত আমি আর দেখতে পাই না।
কারন আমার জানালা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে বাদামী রঙ এর একটি সুউচ্চ দালান।
পুনশ্চঃ ক্রমাগত ভাড়া বাড়ার দরুন অনুরা ও বাসা ছেড়েছে অনেক দিন আগে। বর্তমানে ওর সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ নেই। বাধন এখন বিবাহিতা, বর্তমানে অন্তঃসত্তা, খুব শীঘ্রই সে একটি কন্যা সন্তনের মা হবে। লাবুদের দোতালা বাড়িটা করার সময় জামরুল গাহটা কেটে ফেলা হয়েছে বলে লাবু আর এখন আমাকে জামরুল খাওয়াতে পারে না, তবে সে এখন একজন সুদক্ষ রাধুনী, যে কোন নতুন আইটেম রান্না করা হলেই তার বাসায় আমার দাওয়াত পরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।