আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেত: পাখির চোখে দেখা- পাঁচ

মার্চ ১৫,'১৩ ইং বিলেতে যারা প্রবাসী তাদের মধ্যে দুটি গ্রুপ আছে- একদল যারা এখানে এসেছে ২০, ৩০, ৪০ বছর আগে ,এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। তারা তো বটেই ,এমনকি তদের ছেলেমেয়েরা - তার পর তাদের নাতিনাতনীর প্রজন্মের জন্ম হয়েছে এখানে, তাদের বেড়ে ওঠা হয়েছে নানা সুযোগ সুবিধায় ভরা, প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ । তারা দামী গাড়ি হাকায় , কারো কারো আছে একাধিক বাড়ি এই খোদ লন্ডনেই , দেশে তো আছেই। আরেক গ্রুপ যারা প্রথমোক্তদের স্বাচ্ছ্ন্দ্য দেখে এখানে এসেছে পরবর্তীতে ধন্য আশা কুহকিনীর মায়ায় পড়ে। কিন্তু এই দেশটি ক্রমাগত বহিরাগতদের জন্য লোভনীয় গন্তব্য হয়ে ওঠার সাথে সাথে সাথে তাদের জীবন প্রথমোক্তদের মত না হয়ে কন্টকময় জীবনে পরিণত হয়েছে।

আমার এই দুই দলেরই দুইজন খুর নিকট আত্নী্য় আছেন যাদের বর্ননা করলে দুই গ্রুপেরই তুলনামূলক ছবিটা পাওয়া যাবে। আমার লন্ডন প্রবাসী খালা প্রথম গ্রুপের আর আমার চাচা যাঁর সাথে আমি থাকি এখন তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় গ্রুপের। খালার কথা বলার আগে আমার চাচার কথায় আসা যাক। মেধাবী ছাত্র তিনি বরাবরই ছিলেন। ভারত থেকে বিবিএ এমবিএ করে এদেশে এসেছেন ।

এখানে পরে আরেকটি এমবিএ করেছেন। তার এই কোন বিদ্যার ছটামাত্রও তাঁর কাজে লাগে নি, সুপারস্টোর টেসকোতে জব করেন , সারা সপ্তাহ ভয়াবহ খাটনি যায়। মেধাবী ও দারুন সুদর্শন মানুষটি তাঁর সারা জীবনটা কাটিয়ে চল্লিশার্ধ বয়সে এসে পিআর পেয়েছেন। এর আগের দশ বছরের কঠোর সংগ্রাম তাঁর কোনরকমে টিকে থাকাটাই শুধু নিশ্চিত করেছে, প্রাচুর্য নয়। এখন তার একমাত্র সুখ স্বপ্ন আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তাঁর ফুটফুটে ছেলে রাফানকে নিয়ে।

একজন বাবার জীবনে লক্ষ্য থাকে সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা , তা তিনি পেরেছেন বটে। ওতেই তাঁর তৃপ্তি। কিন্তু তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর তথা বিলেতপ্রবাসী এক বিশাল সংখ্যক বঙ্গসন্তানের মেধার বিপুল অপচয় আমাকে ব্যাথিত না করে পারে না। দ্বিতীয় জন -আমার খালা -এক বিস্ময়কর নারী। এইখানে পাঠকের ধৈর্যচূতির আশংকা মাথায় রেখেও মূল কথায় যাবার আগে তাঁর সম্পর্কে একটু বলতে চাই।

চেনা জানা গন্ডির ভেতর তাঁর মাঝেই আমি নারীর সম্মান ও স্বাধীনতা ,ইচ্ছাশক্তি ও আত্নবিশ্বাসের একটা রূপ দেখতে পাই। অপ্রাসংগিক হলেও একটা ঘটনা বলি। তখন তিনি বেশ ছোট, পরদিন তাঁর বৃত্তি পরীক্ষা। সারারাত জেগে তাঁর জন্য একটা জামা সেলাই করছেন আমার নানু- মেয়ে পরদিন যাবে পরীক্ষা দিতে ঐ জামা গায়ে দিয়ে। অপরদিকে সারা রাত পড়ার ব্যস্ত আমার খালা ।

পরদিন ঐ জামা গায় সত্যিই তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। বৃত্তিও পেয়েছিলেন যথাসময়ে। এই মেধাবী মেয়েটির ঐ যুগে যা হয় অতি অল্প বয়সে -কত আর হবে- ১৪/১৫ বিয়ে হয়ে গেল, তারপর প্রবাস জীবন - স্বামী -ছেলেদের নিয়ে ব্যস্ত সময়। পড়াশোনার প্রশ্নই আর ওঠে না। ছেলেদের স্কুলে দিতে আনতে হয় ,বারবার যাওয়া আসায় সময় ,শ্রম ও অর্থ নষ্ট, আমার খালুর ড্রাইভিং পরীক্ষায় বসার ব্যাপারে গরীমসি দেখে তিনি নিজেই শেখা শুরু করলেন।

এদেশে এখনকার মত না হলেও তখনও লাইসেন্স পাওয়া যথেষ্ট কঠিন ছিল, একবারে পাস করা অতীব কঠিন কার্য। মাত্র কয়েকটা লেসন নিয়েছেন, পরীক্ষার সময় সামনে ঘনিয়ে এসেছে। সেবার তিনি দিতে অনিচ্ছুক, যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই বলে। ইন্সট্রক্টর বললেন দাও ,পারবে। সত্যিই পেরেছিলেন তিনি।

ছোট ছোট ঘটনা। কিন্তু তার মধ্যে এক অবিচল আত্নবিশ্বাস ছিল, এটা আশেপাশের মানুষকে ও তাঁর উপর ভরসা করতে বিশ্বাস জোগাত। চলনে বলনে এই "তখনকার" অল্পশিক্ষিত যেমন আজকের সুশিক্ষিতা হয়ে ওঠা নারীটির মাঝে একতিলও কম বেশী পার্থক্য নেই। তাঁর আগের বাড়িটির কাছের লাইব্রেরীটা বেশ বড় ছিল, প্রচুর মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য -এমনকি পিএইচডি লেভেলের পড়ার জন্যও ওখানে যায়। ওখানে যাতায়াত ছিল তাঁর, অন্যদের দেখে নিজের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করার দূর্দম ইচ্ছা চাগিয়ে উঠল।

পঁয়তাল্লিশ বছরে ফের পড়া শুরু করলেন তিনি। সারা দিনমান সাংসারিক দায়িত্ব পালন , রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিজের বই খুলে বসা। ভারি কষ্টের সে দিনগুলো গেছে। শেষমেষ ছোটছেলের সাথে একসাথে কনভোকেশনে যোগ দেয়ার বিরল ভাগ্য তাঁর হয়েছে, সেসময়ে তোলা বাঁধানো ছবিটা তার অসাধারন ইচ্ছাশক্তির প্রমানই দেয়। তারপর সরকারী চাকরীতে দীর্ঘদিন যথেষ্ট উচ্চপদে আসীন ,অতঃপর যখন অবসর , তখনও বাড়িতে বসে থাকতে নারাজ তিনি- যোগ দিলেন বেসরকারী একটা সংস্হায় ।

এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সেও মাইলকে মাইল গাড়ি চালিয়ে লন্ডনের বাইরে চলে যান অফিসের কাজে। আমকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে যাওয়ার জন্য -রাত বারোটার কাছাকাছি সময়ও ক্লান্তিহীন ভাবে বহু মাইল ঘুরে এসেছেন। এতক্ষন যা ছিল তা ব্যক্তিগত কথা, পাঠকের ধৌর্যচূতি ঘটে থাকলে বিনীত ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আমি আসলে যা বলতে চাই তা হলো , বহু কষ্ট করে হলেও এই অবস্হানে আসা আমার খালা বিলেতের প্রতিষ্ঠিত সেই শ্রেনীর একজন ,যাদের বর্তমান বিলাসী বিভবে ভরা জীবন সাধারন বঙ্গসন্তানকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে যুগে যুগে বিলেতমুখী করেছে। প্রবাসী হবার সত্যকার সুবিধা এই শ্রেনীর মানুষজন পেয়েছে, কিন্তু এদের সংখ্যাটা মোট অভিবাসী সংখ্যার তুলনায় অনেক কম।

খালার সাথে একবার একটা সোফার দোকানে গেলাম- তার নতুন কেনা সোফাটা বোধহয় প্লেসমেন্টের সময়ই একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ওটা কিনতে হবে। সোফার দাম তিনশ পাউন্ডের উপরে আর যে পার্টসটা কিনতে হবে তার দামও একশত পাউন্ডের উপরে। যোগ করলে মোটমাট যা পাওযা যাবে তাতে আমার ওখানে একমাসের থাকা খাওয়া সহ সব খরচ চলে যায়। এটা ধনিক বিলেতপ্রবাসী বাঙালির আর্থিক অবস্হার একটা ধারনা তো অবশ্যই দেয়। এই গ্রুপের বাইরে আর একটা দল, তারাও অনেক আগেই এখানে এসেছে , কিন্তু বছর বছর বেনিফিটের লোভে কিছু সন্তান জন্ম দেয়,আর ভাতার টাকায় চলে।

এরা নাকি কখনো পার্মানেন্ট কোন জব দেখায় না, ভাতা পাওয়ার সুবিধার্থে। বলতে গেলে কর্মহীন বসে খাবার এই সংস্কৃতি বর্তমানের সার্বিক ক্রমঃসংকুচিত সুযোগ সুবিধার জন্য অনেক খানি দায়ী। এখনে জব পাওয়া বেশ কঠিন এখনও পর্যন্ত। মন্দার সময় থেকেই চলছে এই অবস্হা , এখন ইইউ ভুক্ত দরিদ্র দেশের নাগরিকেররা দলে দলে এখানে এসে পরিস্হিতি আরো জটিল করে তুলেছে কাজের হাহাকার লেগেই আছে। সামাজিক আর্থিক উভয়বিদ সমস্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।

সরকার সমানুপাতিক হারে মানুষজনের পক্ষে এদেশে আসাও কঠিন করে তুলছে। এখনে আসার আগে আমার এক শ্রদ্ধেয় স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম,তাঁর এককালে এদেশে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহন সূত্রে কিছু সময় থাকার অভিজ্ঞতা ছিল- তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন -আরে ওখনে জব পাওয়া কোন বড় ব্যাপার নয় , সকালে গেলে বিকালেই পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে এসে দেখেছি-এখন সেই দিন আর নেই , চাকরি এখন সোনার হরিন, রেফারেন্স বা অভিজ্ঞতা থাকলে ভিন্ন কথা, মিলেই যায়। না হলে বড়ই সমস্যার কথা। তবুও এই দেশে আসার জন্য , থাকার জন্য মানুষের আকাংখার শেষ নেই।

সর্বস্ব বিক্রি করে হলেও আসা চাই-ই। নিজের দেশ মনের এক কোনের গহীনে চিরস্হায়ী সকরুন আহবান হয়ে টানে , কিন্তু বাহির ছুটে চলে অনিশ্চিত ঝঞ্জাবিধুর "স্বপ্নরাজ্যের" পানে। সবকথার সার কথা শত সমস্যাতেও এই দেশে মানুষ আসছে ,আসবেই- অস্হিরতায় পরিপূর্ণ স্বদেশের মায়া ত্যাগ করে আরো অনেক দিন পর্যন্ত কে জানে কতদিন এই ধারাই বজায় থাকবে......। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.