তারিখ: ২০ ফেব্রু,'১৩
আমার শেষ দিনগুলোর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল সকালে অফিস গমন, বিকালে কাজ শেষে অফিস বিল্ডিং -এর কোনায় আমাদের অতিপ্রিয় টঙ ঘরটিতে চায়ের আড্ডা , অতঃপর কখনো সদলবলে কখনো বা একা একাই শাহবাগের সমাবেশে বাড়ি ফিরতি পথে একবার ঢুঁ মারা।
বইমেলাটা সাথে থাকায় আমার রীতিমত পোয়াবারো। একেবারে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার যাকে বলে- সমাবেশের রাস্তাতেই খানিকক্ষণ বইয়ের মেলায় বৃথাই ঘুরে বেড়ানো, নতুন বাঁধানো বইয়ের ঘ্রাণে নাগরিক বিষবাষ্পে আক্রান্ত ফুসফুসকে কিছু পরিশুদ্ধ করে নেওয়া, মাঝে সাঝে দুই একটা মনে ধরা বই কিনে, কেনার পরের তৃপ্তির চেয়ে যেগুলো কেনা হল না, অর্থাৎ কেনা গেল না, ঐগুলোর জন্য মনভরা আফসোস নিয়ে মেলা থেকে বের হই। বাস্তবে বইয়ের যে দাম তাতে নিজের গরিবি হালতের কথাই স্মরণ হয় বারবার। অবশ্য কিনে সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছা করবে, বার বার পড়তে ইচ্ছা করবে, দুপুর বেলার অলস দিবানিদ্রার সঙ্গী হবে এরকম বই ও আজকাল বেশী বের হয় না।
এ দায় শুধু লেখকের না, আমার মতে পাঠকেরও, কারণ শেষ বিচারে পাঠকই লেখক সৃষ্টি করে।
সে যাই হোক, আমি যে শাহবাগে যাই, সেকথা জানতে পেয়ে বড় স্যার একদিন আমাকে ধমকে দিলেন,' আচ্ছা , দুই দুইটা হাসপাতালের সামনে বসে মানুষের দূর্ভোগ সৃষ্টি করে এই রকম আন্দোলনের মানে কি?'
আমি একজন সাধারন মানুষ, যুদ্ধপরাধীর বিচার চাই সেকারনেই সমাবেশে গিয়েছিলাম, ঐটার অবস্হান কেন ওখানে সেই ব্যাপারে আমার কোনই হাত নেই, তবুও আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না কেন ঐ আন্দোলন তথা সাধারনত বাংলাদেশে সমস্ত ন্যায়-অন্যায় যে দাবিতেই আন্দোলন হোক না কেন,এই ভাবে রাস্তাঘাট দখল করেই হয়। কেননা , সংসদসহ শান্তিপূর্ণভাবে মত প্রকাশ , দাবি ও অধিকার আদায়ের কোন প্লাটফর্মই দেশে কার্যকর নয়। জনস্বার্থে জনবহুল জায়াগা ছেড়ে শহীদ মিনারে বসে অনশন করে মরে গেলেও কারো কিছু আসবে যাবে না। তবে ব্যস্ত জায়গায় বসে করলে হাতে হাতে ফললাভ।
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমজনতা - একথাটা সবারই জানা।
স্যারের দ্বিতীয় অভিযোগ - যেটা আমি পরে আরও বহু জায়গায় শুনেছি-স্বদেশে কি বিদেশে,
'দেশে দূর্নীতি , খুনজখমসহ নানা সমস্যা আছে, শাহবাগের আন্দোলন কারীরা ঐসব ব্যাপারে কিছু কেন বলে না?' এই অভিযোগ আমার কাছে হাস্যকর ও অদ্ভূত লাগে। কেননা , যারা দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করেন, যেমন ধরা যাক পরিবেশ, তাদের তো কেউ প্রশ্ন করে না- 'ভাই দেশে যে এত সড়ক দূর্ঘটনা হয় আপনারা কেন ঐটা নিয়ে কিছু বলেন না?' কিংবা যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রেও তো কেউ প্রশ্ন তোলে না ,'আপনারা খালি এক ইস্যুতে কথা বলেন, দেশে যে এত দূর্নীতি ঐসব ব্যাপারে আপনারা চুপ কেন?' আসলে প্রতিটি আন্দোলনের নিজস্ব কিছু দাবি দাওয়া থাকে , কেবল শাহবাগের আন্দোলনের ব্যাপারে কেন মানুষ এটা ভুলে যায় জানি না।
দেশের এই উত্তাল অবস্হায় শেষদিকের অফিস গমন , বিশেষত যখন তা আবার একেবারে মতিঝিলে , তখন বলাই বাহুল্য, জান একেবারে হাতে নিয়ে অফিস করতে হয়েছে। ব্যাংকে ক্লায়েন্ট -এর ভিড়ভাট্টা নেই, অলস সময় পার করা মাত্র।
মাঝে মাঝে পল্টন এলাকার পুরো লাইভ অ্যাকশন দৃশ্য দেখা যায় আমাদের সুউচ্চ অফিস ভবন থেকে। নিরাপদ দূরত্বে উপর থেকে পুরো এলাকার কভারেজ, ঠিক যেন আমাদের নেতানেত্রীদের মতই , যারা নিজেরা থাকেন সবসময়ই ধরাছোঁওয়ার বাইরে, রাজপথের শিকার হয় দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত সাধারন মানুষ। এরই মধ্যে একদিন দেখলাম একেবারে বায়তুল মোকাররমের সামনে আন্দোলনকারী আর পুলিশ মুখোমুখি। যেই পুলিশের ধাওয়া, অমনি সবাই সোজা মসজিদের ভেতরে ঢুকে গেল।
.......অবশেষে শেষের দিনটি চলেই এলো, যথাস্থানে শেষ ফর্মালিটি পূরণ করে শেষবারেব মত সেম ব্যাচ বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডায় যোগ দিলাম, মন খারাপের একটা বাষ্প মনকে স্বপ্নপূরণের আনন্দের মাঝেও থেকে থেকে আচ্ছন্ন করে চলল আমাকে।
চিরতরে কোথাও থেকে চলে যাবার সময় অনেকের অনেক শুভকামনা সঙ্গী হয়, এসব কিছু ছাপিয়ে আমার জায়েদ ভাইয়ের কথাটাই কেন যেন মনে পড়ল। উনি বলছিলেন,' জানেন আমি আপনার যাবার কথা শুনে পুরো রাত নির্ঘূম কাটিয়েছি, আমিও একসময় লন্ডনে যেতে চেয়েছিলাম ঠিক আপনি যা বিষয়ে পড়তে যাচ্ছেন ওতেই পড়ার জন্য, যাওয়ার সুযোগও পেয়েছিলাম, ........কিন্তু যাতে পারিনি ,যাওয়া হয়নি, আজ আপনার যাওয়া দেখে সেই অপূর্ণতার ভুলে যাওয়া বেদনা আবার মনে জেগে উঠেছে। মনে হচ্ছে আমিও এভাবে যাতে পারতাম!'
বাস্তবিক , স্বপ্ন সবাই দেখে , পূরণ হয় অল্প কয়েকজনেরই, নিজের যত ক্ষুদ্রই হোক স্বপ্ন তো! -পূরণ হবার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ি্যে স্রষ্টার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।