আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেত: পাখির চোখে দেখা- এগারো



জানু' ১৫ , ২০১৪ইং


মেট্রো পত্রিকায় "GOOD DEED FEED" নামে একটা ছোট্ট অংশ আছে, প্রতিদিন ছাপা হয়। পড়তে আমার কাছে খুব ভালো লাগে। এটা একধরনের ধন্যবাদ জ্ঞাপন প্রচেষ্টা। চলার পথে আমরা নানা জনের কাছ থেকে অনেক উপকার পাই, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাটুকু ফিরিয়ে জানাবার এ একটা সুন্দর প্রয়াস।

এখানে একদিনের দুটো এরকম ঘটনা শেয়ার করছি।




...........ধন্যবাদ ঐ সদাশয় ভদ্রলোককে- যিনি আমার দাদুর মারা যাবার খবরটি পাওয়ার পরে যখন আমি অঝোর ধারায় কাঁদছিলাম তখন আমার দিকে একটুকরো টিস্যু এগিয়ে দিয়েছিলেন ও আমার হাতটি ধরে রেখেছিলেন গভীর মমতায়।
ঘটনার পর একবছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমি আপনার এই সহৃদয়তার কথা কখনোই ভুলবো না।

ক্লেয়ার, লন্ডন।


এবার দ্বিতীয় ঘটনাটি বলি।

...........ঐ কালো ক্যাবের ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি আমাকে সাউথগেট স্টেশন থেকে তুলে উল্কাগতিতে পৌঁছে দিয়েছিলেন সেন্ট হেলিয়ার হাসপাতালে।

আপনাকে জানাতে চাই যে , সেদিন আমি আমার বাবার মারা যাবার পূর্বেই ঠিক সময়ে পৌঁছে তাঁর সাথে শেষ দেখা করবার সুযোগ পেয়েছিলাম। অশেষ অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে এজন্যে।

কেট, লন্ডন।


পশ্চিমা দুনিয়ার তথা বিলেতের মানুষ সম্পর্কে প্রচলিত দূর্নাম , এরা যান্ত্রিক ও হাসতে জানে না। কিন্তু চলতি পথে আমি অসংখ্যবার দেখেছি, একেবারে অচেনা অজানা মানুষের প্রতি হাসিমুখ ও সহযোগী হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

তবে এদের সামাজিক জীবনের অন্ধকার দিকটাও কম গাঢ় নয়, শুনলে মনে হয় এই লোকগুলোর পক্ষেই কিভাবে এসব করা সম্ভব হয়?


খালার কথা লিখেছিলাম আগের কোন একটা লেখায়, ফস্টার কেয়ারার এজেন্সীতে কাজ করেন। নানা কারনে অযত্নে বড় হতে থাকা শিশুগুলোকে লালন করবার জন্য উপযুক্ত মানুষজনের সান্নিধ্য খুঁজে দেবার পেছনের মানুষ তিনি। এর জন্য তার কাছ থেকে এব্যাপারে অনেক কিছু জেনেছি।


একটা কেসে, দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা অবহেলার কারনে এখন আইসিইউতে , যাকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে একজনের কাছে দেখভালের জন্য। বাবামায়ের অযত্নে ওর এ অবস্থা।

ওদের বড় দুটি ভাই বোনও কিছুদিনের মধ্যেই সম্ভবত ওদের স্বাভাবিক কিন্তু অনপুযুক্ত পালনকারী মাবাবার কাছ থেকে স্থানান্তরিত হবে পিতৃমাতৃকুলের কারো কাছে। এর পেছনের তদারককারী অফিসারটি আমার খালা, ডেলিকেট কেস বলে ক্রিসমাসের ছুটির মাঝেও ভারপ্রাপ্ত লোকটির কাছ থেকে উনার কাছে তাই থেকে থেকে ফোন আসছে। রিস্ক বেশী হওয়ায় লোকটির এই বাড়তি সতর্কতা।



বিলেতে ফস্টার কেয়ার সংক্রান্ত সংস্থাগুলো বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে , তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু একই সাথে খুব চাহিদাযুক্ত ও রমরমা ব্যবসায়িক দিকেও লাভজনক।

এক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর এরকম কাস্টডির পেছনে যুক্ত ছিলেন আমার খালা।

শিশুটি অটিস্টিক। এর রকম বাচ্চা পালন বেশ কষ্টসাধ্য ,এমনকি খোদ মাবাবার পক্ষেও। অথচ যে মহিলাকে এই দায়িত্ব দেয়া হলো, তিনি খালাকে বললেন, এ তো আমার জন্য গুডলাক বয়ে এনেছে।



কারনটা কি?!এ ধরনের শিশু পালন তো বড় সোজা কথা না। আসলে এধরনের বিশেষ যত্ন যাদের লাগে তাদেরকে স্বাভাবিক শিশুর দেখভালকারীর চেয়ে অনেক বেশী পা্উন্ড দেয়া হয়।





এ তো গেল অনাদরকারী বাবামায়ের দিকটা। অনেক শিশু আবার উল্টো বাবামায়ের স্বাভাবিক অবরোধ, শাসন , বাধ্যবাধকতা এড়াতে নিজেরাই এমন সাজানো পরিস্থিতি করে যে ওদেরকে ফস্টার কেয়ারে দিয়ে দেয়া হয়। এতে বাচ্চা খুশি- টাকা ও স্বাধীনতা দুটোই নিজের এখন করায়ত্ব হোল।
শিশুদের ফস্টার মাবাবা শিশুর উপর জোরজবরদস্তি শাসন বিশেষ করতে পারে না। এদেশে এগুলো নিষিদ্ধ।



ফলাফল বখে যাওয়া একদল শিশু। টিন প্রেগন্যান্সির হারও এখানে ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এমনকি এই টিন মমদের নিয়ে এখানে আলাদা টিভি প্রোগ্রাম পর্যন্ত হয়।



অনভিজ্ঞ অনাকাঙ্খী এই সব মা কেমন যত্ন নেয় তাদের বাচ্চাদের?


একবার এক বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বাচ্চা দুধের জন্য কাঁদতে কাদঁতে নীল, কিশোরী মা বোঝেও নি ও কিসের জন্য কাঁদছে।

কিছু কিছু ঘটনা জেনেছি যেগুলো মনের উপর স্থায়ী ছাপ রেখে যায়।



আবারও সেই মেট্রোতে ফিরে আসি। লিখেছে, এক মা তার শিশুকে সন্তানকে লবন পানিতে চুবিয়ে শাস্তি দিয়েছে, ফলাফল শিশুটির মৃত্যু।

বাচ্চার অপরাধ -বড় কান্নাকাটি করে বিরক্ত করছিল।

এটুকুতেই শেষ নয়। ছেলে আধমরা অবস্থায় থাকার সময়ও মা-টির কোন বিকার হয়নি।

বাচ্চা চুপ করে গেলে সে তার হাজব্যান্ডকে ফোন করে বলেছিল, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো, আমি ফ্রি আছি, বাচ্চা চুপ করেছে, এখন একান্তে কিছু সময় কাটানো যাবে।


চিন্তা করা যায়!

আরেকটা বলি। ফেসবুকে এক টিনএজ কিশোরী নিজের বাচ্চা বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের মুখে সে দোষারোপ করেছে তার বড়বোন ও মাকে যারা , তার ভাষ্যমতে একাজের জন্য তাকে প্রভাবিত করেছে। কিশোরীর এ দাবি হয়তো সত্য, তা হলেও গোটা ব্যাপারটার ভয়াবহতা কি একটুও কমে?


এইসব শিশু বড় হয় সম্পূর্ণ পারিবারিক মূল্যবোধহীন হয়ে, নিজেরা যেভাবে সন্তানদের অবহেলা করে তাদের উত্তরসূরীরা তাদেরকে ঠিক একই ব্যবহার উপহার দেয়।

এ এক চেইন প্রসেস। এবং এই সার্কেল এখন আর শুধু পশ্চিমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে ভেবে শ্লাখায় ভোগার কারন নেই, এমনকি বাংলাদেশী পরিবারেও এ রোগের জীবানু প্রবেশ করেছে।


খালার একটা কথা আমর খুব মনে লেগেছে, 'তুমি যেমন বীজ বুনবে তেমনই ফল পাবে। ' সব পরিবার এক হয় না, এখানে এমন অনেক পরিবার আছে যারা সন্তানকে অকৃত্রিম অফুরান মমতায় মানুষ করে , ওরাও তার প্রতিদান দেয় ভালোবাসা দিয়ে। হুবহু এশিয়ান পরিবারগুলোর মত বুড়ো বাবামাকে নিজ পরিবারের মধ্যে সাদরে ঘরে রাখে।

ব্যস্ত জীবনের কারনে দূরে থাকলেও বিশেষত খাঁটি বৃটিশ পারিবার গুলোতে মাবাবার কাছে বেড়াতে আসা , খোঁজ খবর নেয়া, শক্ত পারিবারিক বাঁধন এখনও টিকে আছে।



আমার সাথে বিপিপিতে পরিচয় হওয়া ভারতীয় রামিয়া ও পাকিস্তানী ইরাম। দুজনেরই আছে এই বিলাসী জীবনের লাল পাসপোর্ট। এখানেই এই আধুনিক সব সুবিধার জগতে ওদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু বাবামার মাঝে বিবাদ, আলাদা থাকা আরও নানাবিধ কারনে বড় হয়েছে দাদা দাদী, নানা নানীর কোলে কোলে।

আমাকে, একটা হতদরিদ্র দেশে মধ্যবিত্তের টানাটানি থেকে উঠে আসা মেয়েকে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা নিয়ে ওরা বলে, 'ইউ আর দ্য ফার মোর লাকিয়ার দেন আস। '


এদের সব সুবিধা ও ব্যসন , ঝা চকচকে বিলেত ওদের এই অপ্রাপ্তিটুকুকে মুছে ফেলতে পারে নি। পারবেও না কোন দিন।


কথা সত্যি- দেশে থাকতে পদে পদে খিটিমিটি বাঁধে মাবাবার সাথে, শাসনকে মনে হয় বাধা ,অযথা উপদ্রব। জীবনকে উপভোগ করবার পক্ষে যেন নিষেধের পিছুটান।

তাদের আদরকে যত্নকে ত্যাগকে মমতাকে আমরা নেই 'টেকেন ফর গ্রান্টেড' হিসেবে। যা সহজেই পাই তার দাম আমরা সহজে বুঝি না।


বিলেতকে অশেষ ধন্যবাদ -আমাদের সম্পূর্ণ মিলেমিশে থাকা অটুট পরিবার ও সমাজটা যে কত বড় করুনাময়ের দান তা এখানে না আসলে বোঝাই হতো না। পদহীনের দু্ঃখ জুতাহীন লোকে চোখে না দেখা পর্যন্ত জানতে পারে না। খুব খাঁটি কথা, সন্দেহ নেই।





রেজওয়ানা আলী তনিমা
ফেব্রু ১০, ২০১৪ ইং।




অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.