ফেব্রু ১৭ , '১৪ ইং
নভেম্বরের দিক থেকেই শীতবুড়ির আগমন ধ্বনি ইতঃস্তত শোনা যাচ্ছিল । দেখতে দেখতে সে জাঁকিয়ে এসে পড়লো পুরোদমে। চোখের সামনে সবুজ পাতার দল নেই হয়ে গেল বিশাল বিশাল গাছগুলো থেকে। ফুলগুলোর বাহার ম্লান হয়ে এলো। দু'পাশে ভূতপূর্ব সবুজ শ্যামল অহম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে মনে হচ্ছিলো জরাগ্রস্ত অশীতিপর মুখের বলিরেখার আঁকিবুকি মত ডালপালা ছড়িয়ে নিঃস্ব হাহাকার নিয়ে বেঁচে আছে।
তারপর একে একে ক্রিসমাসের উল্লাস, নিউ ইয়ার কোলাহল, চাইনিজ নববর্ষ ধামাকা , এমনকি শেষ হাঙ্গাম ভ্যালেনটাইন পর্যন্ত শেষ হয়েছে । বাকিগুলো সম্পর্কে আগেই ধারনা থাকলেও চীনা নববর্ষের উদযাপনে ব্যাপকতা দেখে সত্যিই আশ্চর্য হয়েছি। আমাদের পহেলা বৈশাখের মত লোকের ঢল নেমেছিল সেন্ট্রালের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে বিশেষ করে চায়না টাউনে। লালচে রহস্যমাখা ঐতিহ্যবাহক লন্ঠনের আলোয় শীতের কুহেলিঘেরা অরূপ ও তুহিন ভাব অন্তত একটি দিনের জন্য এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। রাস্তা দেখলাম লোকে লোকারণ্য।
চীনা হর্স ইয়ার যেমন আশ্চর্য করেছে ভ্যা-ডেটা সেরকমই হতাশ- কেননা দেশে থাকতে যেমন রাস্তা ঘাটে , চত্বরে , ক্যাম্পাসে , মলগুলোতে ভালোবাসার লালপোশাকে জোড়া কপোতের দেখা মেলে খোলামেলা সংস্কৃতির দেশ হলেও শপিং মলের চটক বিজ্ঞাপনের বাইরে লন্ডনে শানশওকত সেরকম চোখে পড়লো না। শুনেছি এখানে লুকোছাপা নেই, তাই ওদের নির্দিষ্ট আমোদের জায়গাগুলোতেই শুধু মাত্র এই দিনের উত্তাপ আমেজটা বোঝা যায়।
সেসব আমার বহিরাগত চোখে ধরা মুশকিল। সব মিলে , শীতের বিদায় নেবার সময়ের সাথে সাথে এদেশের মূল মূল উৎসবগুলোরও সমাপ্তি। এটা আমার কাছে একটা মজার ব্যাপর বলে মনে হল-আমাদের দেশেও ব্যক্তিগত বিয়ে শাদী থেকে শুরু করে জাতীয় বড় বড় সব উদযাপনই দেখি শীতের সময়ই হয়।
এখানেও তাই ।
দেশে নানা পিঠা-পার্বনের মিঠেকড়া শীত কাল আমার খুব প্রিয় ছিল কিন্তু এখানের ড্যুবে নামক তুলোর কম্বল আর হিটারের ওমের আশ্রয়ে শীতের সে মাধুর্য কোথায়? প্রকৃতির এই দান তাই দেহে বড় কড়া হয়ে বাজে। তাও মনে মনে বেশ একটু সঙ্গোপন আশা ছিল এইবার ধবল তুষার বরফের মোড়া প্রকৃতিকে দেখবো। আগে থেকে আগ্রহ তো ছিলই -তাছাড়া হুমায়ুন আহমেদের ভ্রমনবৃত্তান্তে তাঁর জাদুগরি লেখনীতে বরফ পড়ার যে অপরূপ বর্ননা পড়েছি তাতে সে ইচ্ছা আরও তীব্রতর হয়েছে। প্বসঙ্গত বলে রাখি গতবার একটু আধটু বরফপতন দেখছি বটে কিন্তু ও ছিল বাংলাদেশের শিলাবৃষ্টিরও অধম।
মুঠো মুঠো বরফে গোটা শহরখানা পুরো সাদা চাদরে না ঢেকে গেলে কি আর স্নোফল দেখার আশ মেটে?কিন্তু এত আশ থাকলে কি হবে বরফ তো আর পড়ে না!
শীতে জবুথুবু বরফে মোড়ানো ক্রিসমাসের কাল্পনিক সান্তাবুড়োর ছবি দেখে দেখে কেমন যেন একটা ধারণা ছিল অন্তত ঐসময় বরফ পড়বেই। সে গুড়েবালি। অভিজ্ঞজনেরা মতামত দিলেন , এবার দেরিতে পড়বে- এই ভ্রান্ত আশায় একে একে ডিসেম্বর, জানুয়ারি , ফেব্রুয়ারিতে এসে অবশেষে বুঝলাম এদফায় এ আর নসীবে নেই।
আকাশ থেকে নেমে আসা নরম পেঁজা তুলোর মত তুষার কণা অবলোকন এযাত্রায় আর হলো না আমার। সুতরাং বিলেতের শীতকথন বর্ননে এক বিরাট অনিচ্ছুক অমোচনীয় খুঁত থেকেই গেল।
এদেশের শীতকালীন মজার সব আয়োজনের মাঝে নজর আমার কেড়েছে বিভিন্ন পাবলিক প্লেস, টিউব স্টেশনের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো আইস স্কেটিং-এর বিজ্ঞাপনগুলো। ওগুলোর কথা মনে করে ভাবছিলাম , এবার তো বরফ পড়লোই না -এসবের ব্যবস্থা হবে কিভাবে?
এর উত্তরও পেয়েছি , আপনিও দেখে নিন। সবই কৃত্রিম ব্যবস্থা।
প্রযুক্তির আশীর্বাদে এখন মানুষের অসাধ্য কাজ কমই আছে। শীতবুড়ির খেয়ালপনাকে তুড়ি মেরে নিজের ব্যবস্থা তাই নিজেরাই করে নিয়েছে।
পাতা ঝরে ঝরে এখন যেসব জায়গাগুলো ফুলে রঙে রূপে ভরে থাকতো ঐ সব জায়গায় এখন কেবলই রিক্ততার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে শূন্য গাছগুলো ত্যাগী সন্ন্যাসিনীর সর্বত্যাগী বেশ নিয়েছে। বিরহী গল্পের মত এর রিক্ততারও একরকমের আকর্ষনী শক্তি আছে।
এসময়ের ফুলগুলোও সেই রকম মানানসই সাদামাটা। তাতে গ্রীষ্মের রঙের জৌলুস নেই।
তারপরেও খুঁজে খুঁজে গুপ্তধনের মত লুকানো কিছু রঙবেরঙের মণিমুক্তার সন্ধান পাওয়া গেল ঠিকই।
ওরা আছে একদা বিত্তশালী কিন্তু আড়ম্বরহীন হয়ে পড়া দরিদ্রের একমাত্র অবশিষ্ট অলংকার হয়ে।
অসহনীয় শীতকে মনে মনে গাল দিলেও ফুলের শোভা মনকে পথচলতি শীতের কামড় ভুলিয়ে দেয়।
সময়ে সময়ে আচমকা বিনানোটিশের অতিথি হয়ে আসে বৃষ্টি। যখন তখন যেমন খুশি। এই উপদ্রব সবসময়েই আছে কিন্তু শীতকালের তো কথাই নেই।
বিশেষ করে কনকনে ঠান্ডা বাতাস হাড়মাংসকে আরো কাঁপিয়ে দেয়। শীতের বিলেত যেন কোন খামখেয়ালী কিশোরী, যার মেজাজমর্জি আপন হিসেবে চলে। কখন কি কারনে মুখ ভার করে বসবে তার ঠিক নেই। কালেভদ্রে প্রাণখোলা খিলখিল হাসির মত সোনালী রোদ নীল আকাশের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখনও তার মান পুরো ভেঙেছে বলে নিশ্চিন্ত হয়ে বসা যায় না, কেননা ঈশান কোনে তখনও দেখি ঠিকই জমে বয়েছে কালো ধূসর একটুকরো মেঘের আভাস।
টিপটিপে বৃষ্টি এখানের মানুষের সয়ে গেছে, দিব্যি খোলা মাথায় বা একটা হুডি টেনে চলছে আপন আপন কাজে, কেই বা ছাতায় মাথায় । এমনকি অঝোরধারা বৃষ্টিতেও বঙ্গদেশের মত দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালাতে দেখা যায় না। পায়ের গতি হয়ত একটু দ্রত হয়ে ওঠে -এই যা। অনেকের তো দেখি ঐ অবস্থাতেও ভ্রুক্ষেপহীন পথচলা। এখানে বৃষ্টির কারণে স্কুল কামাই দেয়া ফাঁকিবাজ বালকের পক্ষে সম্ভব নয়।
সব কাজ চলছে নির্বিঘ্নে। তবে মাঝখানে বিলেতের স্বরণাতীত কালের বন্যাটা এদের বেশ ভুগিয়েছে। আমার এক শিক্ষক কাজে আসতে পারেননি পানিবন্দী হয়ে পড়ার কারণে। শুনে বেশ আজব লেগেছে আমার -এখানেও বন্যার কারনে মানুষ গৃহবন্দী হয়! প্রকৃতির হেয়ালীর শেষ নেই। অত্যাধুনিক বিজ্ঞান হাতের মুঠোয় থাকলেও শেষমেষ মানুষ তার কাছে কতটাই না অসহায়!
এর মাঝেই কখনো আসে প্রবল ঝড় বাদল- মুষলঝারে পানি ঝরছে তো ঝরছেই।
অবিকল পিছনে রেখে আসা আমার বাংলাদেশের মত। আমার মনের ভুলই হবে বোঝহয় -ঈষৎ খোলা জানালার পাশে দাঁড়ালে তখন হঠাৎ হঠাৎ সেই পরিচিত দেশজ সোঁদা সোঁদা গন্ধটা পর্যন্ত পাই । ইচ্ছামূলক আবাহন বা উইশফুল থিংকিং কি ? নাকি এই আপাদ পাথুরে আজন্ম অপরিচিত মাটির মাঝে সত্যিই চির চেনা চির আপন কিছুর অস্তিত্ব আছে ? যেমন আছে থর্নবুরি পার্কের ভেতর ঘোর শীতে একটা অবাক রৌদ্রজ্ঝ্বল ততোধিক অবাক অকস্মাৎ আশ্চর্য আবিষ্কার বাংলার শরতের মত এই কাশফুলগুলোর ভেতর?
নাকি এই গন্ধ আমাকে আসলে মনে করিয়ে দিতে চায় যে গোটা ধরিত্রীই মানুষের মা-সম?- জাতি ভূগোল রাজনীতির কাঁটাতারের বেড়া কৃত্রিম , মানবসৃষ্ট। নিজের নিজের স্বার্থের বাইরে এর আর কোন অস্তিত্ব নেই। এসবের বহু উপরে গিয়ে সব কুটনীতি ছাড়িয়ে এই সবটুকু মাটির পৃথিবী আমাদের সবার, সব মানুষের।
রেজওয়ানা আলী তনিমা
মার্চ ০৫, '১৪ ইং।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।