আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেত: পাখির চোখে দেখা -ছয়

মার্চ ২৩,'১৩ ইং একেবারে প্রথম দিন- এয়ারপোর্ট থেকে নেমে যেদিন লন্ডনে পা রাখলাম, ঐ দিন নিজেকে একেবারে এলিয়েন এলিমেন্ট মনে হচ্ছিল, পর পর ভাব ,মোহময়ী লন্ডনের আর যাই থাক-সে আমার আপন তো নয়। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি, এখানে "এলিয়েন এলিমেন্টে"র সংখ্যাই বেশী, "নিজস্ব প্রোডাক্ট" কম। মানে খাঁটি ব্রিটিশ দের কথা বলছি আর কি। শুনেছি বাইরের দেশ থেকে আসা লোকজনের চেয়ে ওরা নাকি সংখ্যায় কম। আজব ব্যাপার, খোদ ব্রিটেনে ব্রিটিশরা সংখ্যালঘু! লন্ডনের বাইরে অবশ্য অন্যরকম,ওখানে ওরাই বেশী,কিন্তু লন্ডনে -পুরো মনুষ্য খিচুড়ি যাকে বলে।

উপরোক্ত কথার সত্যতা বেশ বোঝা যায়। বাঙালি তো আছেই, পাকিস্তানি, ভারতীয় , নেপালী, ভিয়েতনামী, সুদানী, চীনা , নানা ইউরোপভুক্ত দেশের অধিবাসীতে গিজ গিজ করছে গোটা শহরটা। আমাদের এলাকাটা , হানস্লো-তে মূলত পাক-ভারত লোকজনের আধিক্য, কিন্তু চলতি পথে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসা বাংলা শব্দ শুনে অবাক আনন্দ লাগে না আর- এটা এতই নতুনত্ব হারিয়েছে। আর ক্লাসের কথা- সেখানে এক তৃতীয়াংশই বাঙালি। অনেক জায়গায় শুনেছি, " বিপিপি নাকি চলছেই বাঙালিদের উপরে।

" তা অনেকটা সত্যি। আমাদের এখানে মূলত এশিয়ান লোকজন দিয়ে ভর্তি। সাদা/ কালো শিক্ষার্থী প্রতি ক্লাসের গড়ে ত্রিশ জন বা এমনকি এরও বেশী ছাত্রের অনুপাতে চার-পাঁচজনের বেশী আমি কোন ক্লাসেই পাইনি। যদিও স্টাফ ও লেকচারার মূলত ঐদেশী সাদা বা কালোরা। তিন মাসের প্রথম সেশনে আধডজনের উপর শিক্ষকের ক্লাস করেছি , তার মধ্যে মাত্র একজন ভারতীয়, যদিও তাঁর অত্যন্ত সাবলীল, শুদ্ধ উচ্চারন শুনে মনে হয় তাঁর এদেশেই জন্ম ,বেড়ে উঠেছেও এখনে।

অর্থাৎ কিনা ভারতীয় বংশোদদ্ভূত বৃটিশ। আর একজন মাত্র বাংলাদেশী স্টাফের দেখা পেয়েছি আমাদের ক্যাম্পাসে। বার্তাটা পরিষ্কার , যেমনটা অন্যদের কথা থেকেও বোঝা যায়, আমরা এখানে পড়তে আসি বটে, ডিগ্রি নেবার বেলায় এরা আমাদের স্বাগতও জানায়, কিন্তু ঐটা এইদেশে কাজে লাগানো অতটা সহজ না। চাকরির বেলায় ওরাই অগ্রাধিকার পায়। আমরা যদি সুযোগ পাইও তবুও তা অনেক ভাগ্য ও ঝামেলার ব্যাপার।

কিন্তু এদেশের মানুষজন কেন এসিসিএ পড়তে কম আসে? এরা আসলে সহজ সব বিষয়ে পড়তে বেশী আগ্রহী, জটিল ও কষ্টসাধ্য বিষয়ে এদের আগ্রহ কম। বিপিপির নামের বাহার যত, কাজের বাহার অতটা না। আমার বিষয়ে এটাই সবচেয়ে ভালো জায়গা শুনে যা মনে হয়েছিল , বাস্তবে তার অবস্থা অতটা হাইফাই কিছু না। এই রকম মানের শিক্ষা দেয় এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও ওগুলোর চেয়ে অনেক বেশী ফি দিয়ে মানুষ এখানে কেন ভর্তি হয়েছে? কারন- কাজ করার অনুমতি এখন আর ঢালাও ভাবে দেয়া হয় না, ওট অনেক নিয়ন্ত্রিত এখন। সব কলেজ গুলোতে যে সুবিধা নেই, বিপিপিতে ওটা আছে - ২০ কর্মঘন্টা।

একমাত্র এই কারনে দলে দলে 'বাংলা কলেজ' থেকে অনেকে-সবাই না অবশ্যই, এখানে এসে ভর্তি হয়েছে। এক ভাইয়া মন্তব্য করেছিলেন, "এই যে এখানে এত মানুষ, তার অর্ধেকের বেশীই পড়া নিয়ে সিরিয়াস না, এবং পাস ও করতে পারবে না। স্রেফ বাড়তি কিছুদিন থাকার ব্যবস্থা এটা। যতদিন পারা যায় লেগে থাকবে বিপিপির তকমা নিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিপিপি নিজ থেকে বারবার ফেল করার জন্য এদের বের করে না দেয়। " পরে অনেকের সাথে কথা বলে এর সত্যতা পেয়েছি।

একজন তো এটা কঠিন বলে ছেড়ে দিয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হবার কথা ভাবছেন!তা এসিসিএ প্রোগ্রামের কঠিন ফাঁদে পড়া আমরা প্রত্যেকেই জীবনে একবার হলেও ভাবি কোন কুক্ষনে যে এইটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম! এখন না পারি ছাড়তে আর না পারি রাখতে। তাই যারা টাইম পাসের জন্য এটা পড়তে এসেছেন তাদের অবস্থা যে আমাদের চেয়েও বাজে তা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি! ব্রেকের ফাঁকটা পেলেই আমাদের নানাবয়সী বাঙালির দলে দলে বিভক্ত যে আড্ডাগুলো হয় তার কমন আইটেম হিসেবে সাধারনত উঠে আসে এখানে থাকার ফন্দি ফিকির আবিষ্কার- চাকরি বানিজ্যের নানা রকমের উপায়। সরকারের বজ্র আটুনী ভেদ করে ফস্কা গেরোটা খোঁজার চেষ্টা , বুদ্ধি পরামর্শের আদান প্রদান। এইরকম এক আলাপের মাঝে একবার একজন বললেন মোক্ষম কথাটা, "এত কিছু জানি না, শুধু জানি এখানে থাকতে এসেছি- থাকতে হবে, থাকবো। নিয়ম করে সরকার পাঁচ বছরে বের করার ব্যবস্থা করলেই কি আর না করলেই কি? আমি এখন থেকে যাচ্ছি না, তাই নিয়ম কানুনের আলোচনা করে লাভ নেই।

" বাস্তবিক যারা থাকতে আসে তারা কোন না কোন উপায়ে টিকেই যায়। প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জননী- মনীষীর বাক্য অকাট্য। আমাদের প্রতিষ্ঠানটিতে বাঙালি বাদে আর আর যাদের প্রাধান্য তারা হচ্ছে মূলত ভারতীয়, পাকিস্তানি আর নেপালী। প্রথম দুই জাতির লোকদের ধারনা হচ্ছে , ইনফ্যাক্ট আশা হচ্ছে আমরা সবাই ওদের ভাষা জানি ও ওদের সাথে ওদের ভাষাতেই কথা বলবো, এমনকি এটা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। অনেক অত্যুৎসাহী বঙ্গসন্তান এই অবস্থার জন্য দায়ী।

একটা ঘটনা বলি এই প্রসঙ্গে। আমার চাচার কাছে এক পাকিস্তানি লোক এসেছে তার নিজের কোন একটা কাজে। সে নিজের মাতৃভাষা উর্দূতে কথা বলছে। চাচা তাকে ইংরেজীতে বললেন,"তিনি ঐ লোকের ভাষা জানেন না, সে যেন ইংরেজীতে কথা চালায় । " লোকটা মহা আশ্চর্য ও কিছুটা যেন ক্ষুদ্ধ হয়েই জিজ্ঞেস করলো , "কেন তুমি উর্দূ জানো না?!" চাচা জবাব দিলেন, "তুমি কি আমার ভাষা বাংলা বলতে পারো?" লোকটি না সূচক জবাব দিলো।

"তাহলে আমিই বা কেন তোমাদের ভাষা জানতে যাবো? আর তা ছাড়া তুমি আমার কাছে এসেছো তোমার নিজের প্রয়োজনে , আমি তো তোমার কাছে আমার প্রয়োজন নিয়ে যাই নি, কেন তোমার সাথে আমি তোমার ভাষায় কথা বলতে বাধ্য থাকবো?" উনার কর্মঅভিজ্ঞতামতে এদের সাথে হিন্দি/ উর্দূতে বাতচিত না চালিয়ে ক্রমাগত ইংরেজীতে কথা বলতে থাকলে এরা আবার নিজ থেকেই ইংরেজীতেই ফেরত আসে। বলে মুচকি হেসে মজা করে বলেছিলেন, "এতে কিছু সুবিধাও আছে কিন্তু- যখন ওরা তোমাকে গালি দেবে কি কোন খারাপ কথা বলবে তোমার সম্পর্কে বা কোন গোপন কথা বলবে তখন তুমি টের পাবে কিন্তু তারা এটা টের পাবে না যে তুমি কিছু টের পেয়েছো!" বলে যোগ করেছিলেন, "অনেক বাঙালি ওদের সাথে খাতির করার জন্য ওদের ভাষায় কথা বলে বটে তাও ওরা কিন্তু সত্যিই এইসব বাঙালিকে ওদের আপন মনে করে না। " আমার মতে একজন ভারতীয় , পাকিস্তানি বা অন্য যেকোন মানুষের সাথে আমদের বন্ধুত্ব হতে পারে, জানাশোনা থাকতে পারে কিন্তু এর জন্য ভাষার ঐকমত্য একেবারেই জরুরি কিছু না। আসলে কোন দেশের লোকজনের জন্যই এটা আবশ্যক না। আমার কিছু পাক-ভারতী খুব ভালো বন্ধু আছে কিন্তু ওদের সাথে আমি তো ইংরেজীতেই কথা বলি।

এমনকি ভারতী বন্ধুটিকেও দেখেছি পাকি বন্ধুটির সাথে ইংরজীতে কথোপকথন চালাতে। এতে যে আমাদের বন্ধুত্ব কিছু কম হয়েছে তা মনে হয় না। ইংরেজী আন্তর্জাতিক ভাষা, এর ব্যবহার সার্বজনীন। কিন্তু শুধু পাক ভারত নয় অন্য কোন ভিনদেশী ভাষা জানা থাকলেই তা আগ বাড়িয়ে ব্যবহার করার দরকার কি যখন ইংরেজীতেই দিব্যি কথা বলার কাজটা চলছে?আমদের মধ্যে কবে ভাষাগত আত্নমর্যাদা বোধ আসবে তা এক আল্লাহই জানেন। পাক ভারতের নাগরিকদের কথা আসলেই -বিশেষ করে বিদেশে , শোনা যায় ওরা বাঙালিদের তুচ্ছ্তাচ্ছিল্য করে- সুযোগ পেলে প্রতারণা , বঞ্চনা, ঠকানো সবই চলে।

নিজের স্বল্পপ্রবাসজীবন থেকে এব্যাপারে বলার মত কিছু এখনও জমা হয়নি। কিন্তু একথা সত্য যে, ওরা যে এরকম করতে পারে তার কারন ওদের স্বজাত্যবোধ ও একতা এবং এর বিপরীতে বাঙালির চরম ঐক্যহীনতা। নিজেদের মধ্যে শত কামড়া কামড়ি থাকলেও নিজের দেশের মানুষের প্রয়োজনে ওরা সামগ্রিক আর বাঙালি নিজের নাক কেটে হলেও নিজ লোকের যাত্রা ভঙ্গ করতে ওস্তাদ। দুটা বাঙালি এক হলেই আর কিছু না হোক দুটা দল গঠিত হয়ে যায়। পরিচয় গোপন রেখে বলি -কারন আলোচ্য পরিবারগুলো আমার খুব পরিচিত ।

উপর নিচ মিলিয়ে তিন রুমে তিনটি পরিবার,একটি পরে ব্যক্তিগত সমস্যার কারনে অন্যজায়গায় সরে যায়। তার একজনের মুখে শোনা- অন্যদুটি পরিবারের একটির এক সদস্য অন্যটির একজনের সাথে কথা বলে না,অথচ একই ছাদের নিচে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে চলেছে। কদাচিত -যেকোন কারনেই হোক এদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে একই দাওয়াত-এ উপস্থিত দেখেছি কিন্তু কথা একে অপরের সাথে বলেছে এমন একটা ঘটনাও আমি মনে করতে পারলাম না। এই অবস্থা তো আমাদের মজ্জাগত- বিভেদের সংস্কৃতিজাত। আবার ফিরে আসি আমাদের পাক-প্রতিবেশীদের কথায়।

আমরা বাঙালিরা ওদের দেখতে পারি না, তাই নিউটনের অনিবার্য তৃতীয় সূত্রমতে ,ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ওরাও আমদের দেখতে পারে না। কিন্তু মানুষকে সরলীকরণের বিপদ আছে। যেমন ধরুন আমার অনুজপ্রতিম ফাহিমের কথাটাই। বিদেশ বিভূঁইয়ে কে জানে কি বিপদে সে পড়েছিল -একবার জরুরী ভিত্তিতে তার কয়েক হাজার পাউন্ডের দরকার, অথচ ঐমুহূর্তে পাওয়ার উপায় নেই। এককথায় পরিচিত পাকি-ম্যানেজার ঐটাকা বিনাপ্রশ্নে তাকে ধার দিয়েছিল।

একবার জিঞ্জেস পর্যন্ত করেনি কি খাতে ওটা খরচ হবে! স্বজাতির জন্য বাঙালি এই ঔদার্য কদাচিত দেখতে পারে। এগুলো হয়তো বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম। যখন পুরানো হিসেব চুকানোর প্রশ্নে এখন আবার আমরা জেগে উঠতে শিখেছি তখন পারস্পরিক বিদ্বেষের যুগ যুগের ইতিহাস ঝেড়ে সামনে আগাতে হলে, আগাতে হবেও বটে- আমাদেরও এ-বং ওদেরও। তবে এর আগে পাকিস্তানিদের যেমন তাদের কড়াক্রান্তি শোধ করতে হবে, ওদের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকান্ডের দায় নিতে হবে তেমনই আমাদের নিজেদেরও স্বদেশের জন্য সত্যিকারের সুবিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। "ওসব বহু পুরানো যুগের ব্যাপার, তখন তো আমরা এমনকি জন্মাইওনি, অতীত ভুলে গিয়ে সামনে আগানো উচিত, এখন আমরা ভাই ভাই"-এসব কথা অবান্তর ও মেনে নেওয়া অসম্ভব।

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ভিত্তির জোরেই ইমারত মজবুত হয়, উপরে মালমশলা ঢেলে লাভ নেই , যদি তার নিচটা হয় দুর্বল। আর একটি জাতির ভিত্তি হচ্ছে তার ইতিহাস। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.