all in one
ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে দুই হাজার বছরের অধিককাল ধরে যে আগ্রহ, যে উন্মাদনা তার প্রায় সবটাই যেন কেড়ে নিলেন এলিজাবেথ টেলর। ১৯৬৩ সালে যখন ক্লিওপেট্রা মুক্তি পেল, দর্শক ভেঙে পড়ল সিনেমা হলে। একই দৃশ্যের অবতারণা পৃথিবীজুড়ে। টিকিট না পেয়ে ভাঙচুর হয়েছে ঢাকার সিনেমা হলে, উৎসাহী দর্শক সামাল দিতে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছে।
সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সবাই উচ্চারণ করেছেন, ক্লিওপেট্রার চেয়েও সুন্দর এই এলিজাবেথ টেলর।
মূলত তিনিই কিংবদন্তির মিসররানিকে পুনর্জন্ম দিলেন।
আর রোমের শুটিং স্পটে একালের মার্ক অ্যান্টনি রিচার্ড বার্টন, যাঁর সঙ্গে আগে কখনোই দেখা হয়নি লিজের, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন বার্টন, কেউ কি কখনো তোমাকে বলেছে, তুমি একটি সুন্দর মেয়ে? সেই রোমাঞ্চের শুরু—একালের অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রার। বাকি অংশ রুপালি পর্দায় এবং জীবনের মঞ্চে আগ্রহী পৃথিবীর সবাই দেখেছে।
কিংবদন্তি হয়েই রইলেন তিনি
এলিজাবেথ টেলর (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২-২৩ মার্চ ২০১১) সমাহিত হয়েছেন ২৫ মার্চ এক কাব্যিক পরিবেশে। এলিজাবেথ টেলর দুবার অস্কার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, ১৯৬০ সালে বাটারফিল্ড৮ এবং ১৯৬৬ সালে হু ইজ অ্যাফ্রেইড অব ভার্জিনিয়া ওলফ ছবির জন্য।
এলিজাবেথ টেলর ৭০টির মতো ছবিতে অভিনয়করেছেন। তাঁর অভিনীত বিখ্যাত ছবিগুলোর কয়েকটি ক্লিওপেট্রা (১৯৬৩), ফাদার অব দ্য ব্রাইড (১৯৫০), সাডেনলি লাস্ট সামার (১৯৫৯), ক্যাট অন হট টিন রুফ (১৯৫৮), এ প্লেস ইন দ্য সান (১৯৫১), হু ইজ অ্যাফ্রেইড অব ভার্জিনিয়া ওলফ (১৯৬৬), বাটারফিল্ড৮ (১৯৬০)। প্রথম অভিনয় নয় বছর বয়সে দেয়ার ইজ ওয়ান বর্ন এভরি মিনিট ছবিতে।
শেষকৃত্যে হপকিন্সের কবিতা
২৫ মার্চ নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর সোয়া দুইটায় ইহুদিরীতিতে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান শুরু হলো। এলিজাবেথ টেলরের বন্ধু আইরিশ অভিনেতা কলিন ফ্যারেল হপকিন্সের ‘দ্য লোডন একো অ্যান্ড দ্য গোল্ডেন একো’ আবৃত্তি করে শেষ শ্রদ্ধা জানালেন।
উল্লেখ্য, এলিজাবেথ টেলরের স্বামী রিচার্ড বার্টনের প্রিয় কবি হপকিন্স।
হপকিন্স এই কবিতায় বলেছেন, বয়স ঠেকানোর কোনো উপায় নেই, উপায় নেই মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার।
গত সহস্রাব্দের সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি এলিজাবেথ টেলর, এই সহস্রাব্দের সূচনায় সৌন্দর্যের স্মৃতি রেখে কবির আহ্বানে ফিরে গেলেন অমর্ত্যলোকে।
শেষ রসিকতা
নিজের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে একটু দেরিতেই আসতে চেয়েছিলেন। তা-ই তো হয়েছে।
শত দৈব-দুর্বিপাকের মধ্যেও ভেঙে পড়েননি, অর্থহীন মনে হয়নি নিজের জীবন। ম্যারেলিন মনরোর মতো আত্মহননের পথ বেছে নেননি। শারীরিক কষ্ট একেবারে কাছের দু-একজন মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে বুঝতেও দেননি। ৭৯তম জন্মদিন পালন করলেন হাসপাতালে, টেলিভিশনে এবারের অস্কার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান দেখে।
নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সব ফরমায়েশ তিনিই দিয়েছেন এবং বলেছেন, শেষকৃত্যের জন্য নির্ধারিত সময়ের অন্তত ১৫ মিনিট পর যেন তা শুরু হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার গ্লেনডেইল ফরেস্ট লন মেমোরিয়াল পার্ক সমাধিক্ষেত্রে প্রশান্ত পরিবেশে একটু দেরিতে তিনি সমাহিত হন। সেখানে এলিজাবেথ টেলরের মরণোত্তরকালের প্রতিবেশী মাইকেল জ্যাকসন, হলিউড কিংবদন্তি ক্লার্ক গ্যাবল এবং জিন হার্লোও তাঁর প্রিয় প্রতিবেশী।
এলিজাবেথ টেলরের সুবচন
তাৎক্ষণিক বুদ্ধিদীপ্ত জবাবের জন্য তিনি রীতিমতো বিখ্যাত। এসব জবাব থেকেই এলিজাবেথ টেলরের কয়েকটি নির্বাচিত সুবচন:
আমি অত্যন্ত অঙ্গীকারবদ্ধ একজন স্ত্রী। এতবার বিয়ে করার কারণে আমাকে এই অঙ্গীকার রক্ষা করতেই হয়েছে।
ছবি বানানো ছাড়া আর সবকিছুই আমাকে নার্ভাস করে তোলে।
আমি সাধারণ গৃহবধূ হওয়ার ভান করি না।
আমার রয়েছে নারীর দেহ আর শিশুর আবেগ।
ক্লিওপেট্রার কথা আমার তেমন মনে নেই।
আমার মনে হয় একটা বয়সের পর পুরুষেরা আরও বড় হতে ভয় পায়, কারণ তাদের মনে হয় তাদের যত বয়স বাড়ছে, স্ত্রীদের বয়স তত কমছে।
প্রেসিডেন্ট বুশ এইডস প্রতিরোধে কিছু করছেন বলে আমার মনে হয় না। আসলে তিনি ‘এইডস’ বানান করতে পারেন কি না, তা-ও আমি জানি না।
সাফল্যই হচ্ছে সবচেয়ে বড় গন্ধনাশক—ডিওডরেন্ট। সাফল্য অতীতের সব গন্ধ শুষে নেয়।
যখন কোনো কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়বে, তখনই বুঝবে, কে প্রকৃত বন্ধু।
আট বিয়ে সাত স্বামী
১৯৫০ সালের আগেই খ্যাতি ও সৌন্দর্য লিজকে সেরা কয়েকটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদকন্যায় পরিণত করে। তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ারই কথা। বয়স তখন কেবল ১৮ বছর।
নিকি হিলটন
পৃথিবীজুড়ে হিলটন হোটেলের যে বিশাল সাম্রাজ্য, তারই উত্তরাধিকারী কনরাড হিলটন লিজকে বিয়ে করলেন। নিকি হিলটন নামে পরিচিত কনরাড একালের সেলিব্রিটি প্যারিস হিলটনের বাবার চাচা।
প্লেবয়, জুয়াড়ু ও মদ্যপ নিকি হিলটন গ্ল্যামার-জগৎ থেকে স্ত্রী বেছে নিলেও স্ত্রীকে ওই জগৎ থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছেন। শুরুতে কদিন ভালো কাটলেও লিজ স্বামীর অব্যাহত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। মে ১৯৫০ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৫১—এই ছিল তাঁদের দাম্পত্যকাল।
মাইকেল উইল্ডিং
মাইকেল উইল্ডিং ব্রিটিশ অভিনেতা, বয়স এলিজাবেথ টেলরের ঠিক দুই গুণ। দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে।
এই অভিনেতা তাঁকে কিছুটা ভালোবাসা এবং কিছুটা সাংসারিক স্থিতি দিতে পেরেছেন। মাইকেলের সঙ্গে সংসারজীবনে এলিজাবেথ দুই পুত্রসন্তানের—মাইকেল জুনিয়র ও ক্রিস্টোফার—জননী হন।
মাইকেল টড
ধনাঢ্য প্রযোজক মাইকেল টডের সঙ্গে সম্পর্কটা খুবই আবেগময় ছিল। ১৯৫৮ সালের ২২ মার্চ ব্যক্তিগত প্লেন ক্রাশে মাইকেল টডের মৃত্যু হয়। সে প্লেনে এলিজাবেথ টেলরেরও থাকার কথা ছিল।
কিন্তু অসুস্থতার কারণে মাইকেল তাঁকে নিতে রাজি হননি। এ সময় তিনি বলেছেন, দাম্পত্য জীবনে সবচেয়ে সুখী ছিলেন তাঁর সঙ্গেই।
এডি ফিশার
১৯৫০-এর দশকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের একজন এডি ফিশার। মাইকেল টডের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। নিহত বন্ধুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বন্ধুর সদ্যবিধবা পত্নীকে প্রবোধ দিতে দিতে কদিনের মধ্যে দুজনই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যান।
স্বামীর সমাধির ফুল না শুকাতেই প্রেমে মেতে ওঠায় নিন্দিত হন এলিজাবেথ টেলর। বিয়ের পর এডি ফিশার ঘোষণা করেন, তাঁদের ৪০ বছর ধরে হানিমুন চলবে। অবশ্য বিয়েটা টিকেছিল পাঁচ বছর—মে ১৯৫৯ থেকে মার্চ ১৯৬৪।
রিচার্ড বার্টন
কল্পলোকের রোমান্টিক জুটি রিচার্ড বার্টন ও এলিজাবেথ টেলর। হলিউডের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত জোড়; তাঁদের সম্পর্ক মিথ হয়ে আছে।
দুজনের প্রথম দেখা ১৯৬০ সালে রোমে ক্লিওপেট্রা ছবির সেটে। দুজনই তখন বিবাহিত। ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এলিজাবেথ বলেছেন, রোমে প্রথম দেখার পর থেকেই আমরা পরস্পরকে উন্মত্তের মতো ভালোবাসি।
রিচার্ড বার্টন তাঁর জন্য এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে নাশপাতিসদৃশ হীরক কেনে, এই হীরকের নাম হলো টেলর-বার্টন হীরা। রিচার্ড বললেন, ‘তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও, মৃত্যু ছাড়া আমার সামনে কোনো পথ খোলা নেই।
এলিজাবেথ বললেন, ‘আমার আর রিচার্ডের মধ্যে যদি তালাক হয়ে যায়, কসম, আমি আর কখনো বিয়ে করব না। ’
মার্চ ১৯৬৪ থেকে জুন ১৯৭৪—এক দশকেরও বেশি সময় দুজনের এই আলোচিত বিয়েটি টিকেছিল। বার্টন-টেলর দম্পতির একটি কন্যাসন্তান—মারিয়া বার্টন।
পুনরায় রিচার্ড বার্টন
রিচার্ডের সঙ্গে বিবাহিত জীবন অক্ষুণ্ন রেখেই এলিজাবেথ ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত আর্দেশির জাহেদির প্রেমে পড়ে যান। রাষ্ট্রদূত একবার তাঁকে তেহরানে নিয়ে আসেন।
ইরানের বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভি রাষ্ট্রদূতকে এই হলিউড সেলিব্রেটির কাছ থেকে সরিয়ে আনতে সমর্থ হন। এলিজাবেথ ফিরে যান রিচার্ডের কাছে। এদিকে দুজনই মারাত্মক অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। নিজেদের মধ্যে সহিংস ঝগড়াও শুরু হয়ে যায়। ১৯৭৪-এ তাঁদের তালাকনামা সম্পাদিত হয়।
১৬ মাস পর তালাক হয়ে যাওয়া এই বিখ্যাত জোড় আবার পরস্পরের সান্নিধ্যে আসেন এবং আফ্রিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় বিয়ে করেন।
এই ঝোড়ো ভালোবাসায় আবার ভাটা পড়ে। এক বছরের মধ্যে দুজনের সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটে যে তালাক ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না।
এভাবেই পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্বামী রিচার্ড বার্টনের সঙ্গে এলিজাবেথ টেলরের দাম্পত্য সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় দফা দাম্পত্যকাল অক্টোবর ১৯৭৫ থেকে আগস্ট ১৯৭৬।
জন ওয়ার্নার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক জন ওয়ার্নার রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ; ভার্জিনিয়া থেকে পাঁচবার সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ‘সেক্রেটারি অব দ্য নেভি’র দায়িত্ব পালনকালে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক মহলে এলিজাবেথ টেলরের সঙ্গে দেখা হয়। এই দেখা ক্রমেই নিবিড় হয়ে আসে। ১৯৮২ সালে তাঁদের মধ্যে তালাক হয়ে যায়। তবে তাঁদের দাম্পত্যের মেয়াদকাল কম নয়, ডিসেম্বর ১৯৭৬ থেকে নভেম্বর ১৯৮২।
ল্যারি ফর্টেনস্কি
বেটি ফোর্ড ক্লিনিকে চিকিৎসার সময় তাঁর চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট পেশায় নির্মাণ শ্রমিক ল্যারি ফর্টেনস্কির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। তারপর ভালোবাসা ও বিয়ে। এলিজাবেথ টেলর বললেন, ‘এটাই শেষ। ’ তাঁদের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও অমিলও কম ছিল না। পরে এই বিয়েটাকে তিনি বললেন ‘দুর্ভাগ্যজনক’ এবং তালাকের মামলা করলেন।
তাঁদের দাম্পত্য সময়কাল অক্টোবর ১৯৯১ থেকে অক্টোবর ১৯৯৬।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।