আমাদের বন্ধুর মাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন শীর্ষক আমার আগের পোস্ট পড়তে Click This Link
আমি ইতোমধ্যে আমার দুটো লেখায় বলেছি যে আমাদের সহপাঠী বন্ধুর মায়ের ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসার খরচ যোগাতে আমরা অর্থ সংগ্রহের কাজ করছি। বইমেলায় নিয়মিত আমরা ব্যানার এবং বাক্স নিয়ে দাঁড়াই। বইমেলায় অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেগুলো আজ আমি আপনাদের সাথে ভাগ করব। বইমেলায় অর্থের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে সবচেয়ে অবাক হয়েছি যে বিষয়টা দেখে সেটি হল অবস্থাপন্ন, মধ্যবয়সী, শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের গণহারে অর্থ সাহায্য প্রদান না করার বিষয়টিতে।
তারা আমাদের ক্যাম্পেইনটিকে ভুয়া ভাবেন নাকি তাদের নিজস্ব কোন মতামত রয়েছে? আমি বিষয়টি ধরতে পারিনি। বইমেলায় আমি গত চারদিনে বহু সুশীল সমাজের প্রতিনিধিকে দেখেছি। অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, জ্বালাময়ী টক শো'র উপস্থাপক, নাট্যব্যক্তিত্ব প্রমুখ। সাধারণ মানুষ ব্যানারের দিকে তাকান কিন্তু তারা ব্যানারের দিকে তাকান পর্যন্ত না। তাদের কয়েকজনের কাছে অনুরোধ করলেও তারা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেন নি কী সমস্যা।
আমি বলছি না যে টাকা দিলেই তারা মহৎ আর না দিলেই খারাপ। তারা হয়ত অন্য অনেক অসহায় মানুষকে সাহায্য করেন সেজন্য এখানে সহায়তা করতে পারেন না কিন্তু তাদের অ্যাটিচিউড আমাকে খুবই অবাক করেছে। পান চিবানো লুঙ্গিপরা স্বল্প আয়ের মানুষকে দেখেছি ৫-১০ টাকা দিতে। প্রত্যক্ষ করেছি তরুণদের অল্প টাকা দিতে পারছেন বলে দুঃখ প্রকাশ করার দৃশ্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং তরুন সমাজের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি দেখেছি।
কেন? কেন তারা অর্থ দিতে আগ্রহী? কী তাদের দর্শন? আর দেখতে শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের কী দর্শন অর্থ সাহায্য না করার পেছনে? উত্তরগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছি।
এবার একটু স্পেসিফিকেলি আসি। আমি দেখেছি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে আমাদের দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে। দেখেছি প্রিয় প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদকে একই ভূমিকায়। বাংলা একাডেমীর সাবেক পরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে দেখেছি পাশ দিয়ে চলে যেতে।
অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে দেখেছি উপরের সুশীল ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে। অভিনেতা মাজনুন মিজানকে দেখেছি একইভাবে । অন্যদিকে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমানকে দেখেছি এগিয়ে এসে ২০০ টাকা দিতে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। একজন কাঁচা-পাকা চুলের ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বললেন, " আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।
আপনাদের ব্যাপারগুলা আমরা বুঝি। বলে খুব দ্রুত ১০০ টাকা বাক্সে ফেললেন। আমি বললাম, "আপনি কোন বিভাগে ছিলেন?" তিনি বললেন,"আমি ইতিহাস বিভাগের ৮৪ সালের ক্যান্ডিডেট। ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আমাদেরকে পড়াতেন। " আমার সাথে হাত মিলিয়ে ভদ্রলোক দ্রুত মিলিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে।
আমার চোখ জ্বলে ভিজে উঠেছিল তখন। সন্ধ্যা বলে সেটি কেউ লক্ষ্য করে নি হয়ত। আমি প্রেরণা পেয়েছিলাম ভাল কাজ করার জন্য। পৃথিবীটাকে আমার অসম্ভব সুন্দর মনে হয়েছিল তখন। বইমেলার দোকানের আলো সন্ধ্যার পরিবেশকে আমার জন্য স্বর্গ বানিয়ে দিয়েছিল, সারাদিনের ক্লান্তি উবে গিয়েছিল।
আমি দেখি বইমেলায় দায়িত্বরত RAB সদস্য তার সহকর্মীকে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে এসে সাহায্য করে যান। আমি এরকম আরও অনেক দৃশ্য দেখি যা আমাকে আরও অনেকদিন বাঁচার অনুপ্রেরণা যোগায়।
এবার অন্যরকম একটা ঘটনা বলি। গতকাল প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসীকে দেখি। আমার আরেক সহপাঠী তার দৃষ্টি আকর্ষন করে।
তিনি চলে যেতে থাকেন। আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করেন, " কী সমস্যা হয়েছে?" আমরা বলি যে আমাদের বন্ধুর মায়ের ব্লাড ক্যান্সার। তখন তিনি বলেন," এই ৫-১০ টাকা দিয়ে দিয়ে কি কোন সমাধান হবে নাকি?" বলে তিনি প্রস্থান করেন।
গত বছরের মাঝামাঝি অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত শিশু মৌরীনের চিকিৎসার খরচ ওঠানোর জন্য আমাদের বন্ধুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। টিএসসিতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল।
সেই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রির একটি বুথে আমি থাকতাম। ওখানে টিকিট কেনার পাশাপাশি অনেকে অর্থ ডোনেট করতেন। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। কলা ভবনের সামনে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছি আমি। আমার টেবিলে দুটি বাক্স।
একটি টিকিট বিক্রির টাকা রাখার জন্য অন্যটি ডোনেট করার টাকা রাখার জন্য। হঠাৎ একটি চলন্ত রিকশা আমার খুব কাছাকাছি চলে আসে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রিকশাওয়ালা তা মুঠিবদ্ধ হাত আমার দিকে এগিয়ে দেন। আমি হাত বাড়িয়ে দিতে সেখানে দু'টি ২ টাকার নোট গুঁজে দেন তিনি। রিকশা নিয়ে চলে যান রিকশাওয়ালা।
আজ অনেকদিন পর আমার মনে পড়ছে না সেদিন আমার চোখ জলে ভরে উঠেছিল কিনা। তখন খটখটে রোদ ছিল। চোখে জল আসলে সকলে দেখে ফেলত হয়ত। মৌরীন বাঁচেনি। কিন্তু মানুষ এগিয়ে এসেছিল।
বইমেলায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে অনেক বিরক্ত করছি আমরা। তাদের চলাচলে বাধা দিচ্ছি। তাদের কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছি। আমরা তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
একদম শেষে একটি কথা বলি।
ড. আতিউর রহমান যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন তখন তার জীবনী খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে দেখেছিলাম যে ছেলেবেলায় তার পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের নিমিত্তে তার শিক্ষক হাটে গিয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতেন। হাটে পণ্য কিনতে ও বিক্রি করতে আসা সাধারণ মানুষ টাকা দিত। সেই টাকায় তার পড়ার খরচ চলত। আতিউর রহমান তাই বলেন যে আজকের আতিউর রহমান দরিদ্র মানুষের সাহায্যের টাকায় বড় হওয়া আতিউর রহমান।
তিনি সেই দরিদ্র সাধারণ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শুনেছিলাম কর্নেল তাহের বলতেন যে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষই এগিয়ে এসেছিলেন। অফিসারদের থেকে সাধারণ সৈনিকরাই বেশি অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে এ কথা বলেছিলেন কিনা জানি না তবে ২০১১ সালে এসে বাস্তবতা অনেকটা সেরকমই মনে হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।