লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। মৃত্যুকে ফাঁকি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার জগন্নাথ রায় মারা যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হঠাৎ সিদ্ধান্ত।
পয়সাওয়ালা লোকজনের মাঝেমধ্যে কিছু পাগলামো দেখা দেয়, এটাও হয়তো সেরকম কোন পাগলামোর একটা নমুনা। কিন্তু তাঁর ব্যবস্থা এত সুচারু যে মনে হচ্ছে তিনি সত্যিই মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখাতে চাইছেন।
রাজা, বাদশাহ, জমিদার - এসব মানুষ খুব বেশি করে "প্রাইভেসি" চান বলেই হয়তো তাঁদের কিছুই সাধারণ মানুষের কাছে গোপন থাকে না। গোপন দয়াদাক্ষিণ্য থেকে শুরু করে তাঁদের উদ্দাম জীবনযাত্রার নোংরা খবর, অন্দরমহলের কেলেঙ্কারি, ভালো-খারাপ সবকিছুই কী করে যেন সবাই জেনে ফেলে, বিস্তারিতভাবে ইতিহাসের পাতায় স্থানও পেয়ে যায়, যদি তিনি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে থাকেন।
এই ব্যাপারটি আলাদা, তিনি অত্যন্ত কড়া নিয়ম করে দিয়েছেন যে মৃত্যু ঠেকাতে তিনি যে ব্যবস্থাগুলো নিচ্ছেন, সেগুলো যেন কাকপক্ষীও জানতে না পারে।
যদি তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে কে বাইরে খবর পাচার করছে, তার গর্দান থাকবে না।
ভয় পেয়েই হোক বা যে কারণেই হোক, এখনো পাইক-পেয়াদারা এই খবর বাইরে পাচার করে নি। কিন্তু এই গল্পের আদ্যোপান্ত জানতে হলে তো জগন্নাথ রায়ের বাড়িতে ঢুকতেই হবে, কাজেই চলুন ঘুরে আসা যাক তাঁর সাতমহলা বাড়িটি থেকে।
কে না জানে, এসব বড়মানুষদের অনেক শত্রু থাকে। জমিদারবাবু যে এত সহায়-সম্পত্তি, এত জমিজমা করেছেন, এসব কোত্থেকে এসেছে? এসেছে অন্যদের সম্পদ দখল করে।
অনেক জোর-জবরদস্তি, অনেক রক্তপাত আছে তাঁর আজকের প্রতিপত্তির পেছনে। তিনি তাই অনেক শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন। তাঁর পূর্বপুরুষরাও ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী, তাঁদের সবার অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, কেউ খুন হয়েছেন, কেউ সর্পাঘাতে, কেউ বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে, কেউ বিষপ্রয়োগে, কেউ রহস্যজনকভাবে - এভাবে নিহত হয়েছেন। মোটকথা, তিনি যে বংশের, সেই রায় বংশের কেউই স্বাভাবিক মৃত্যুর সৌভাগ্য লাভ করেন নি। কাজেই জগন্নাথবাবু মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
তিনি শুধু যে অপঘাতে মৃত্যু ঠেকাবেন, তাই নয়, তিনি মৃত্যু বস্তুটিকেই কাছে ঘেঁষতে দেবেন না।
তিনি নিজের মহলের ভেতরে একটা খুব মজবুত ঘর বানিয়েছেন, সেখানে তিনি ছাড়া আর কারো ঢোকার অনুমতি নেই, এমনকি তাঁর স্ত্রী কমললতা দেবীও সে ঘরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। তিনি যখন কাছারিতে বসেন, তখন সবার থেকে দূরে বসেন, কারো কাছে বসলেই তো বিপদের সম্ভাবনা, কার মনে কী আছে কে বলতে পারে?
জমিদারবাবু এখন আর স্ত্রীর সাথে রাত্রিবাস করেন না, তিনি ভারী দরজা আর জানালা লাগানো এই ঘরে একা, সম্পূর্ণ একা রাত্রিযাপন করেন। স্ত্রীকে ভরসা হয় না, তাঁর এক পূর্বসূরি নিজের স্ত্রীর হাতেই ঘুমের মধ্যে নিহত হয়েছিলেন।
তারপরও জগন্নাথ রায় নিজের সাথে একটা পিস্তল রাখেন, দেহরক্ষী আছে তাঁর, কিন্তু তাদের ভরসা কী? কত রাজা-বাদশাহ মারা গেছেন নিজ প্রহরীর গুলি খেয়ে, কাজেই নিজের নিরাপত্তার ভার তিনি নিজেই নিয়েছেন।
এ তো গেলো আততায়ীর হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারটা। কিন্তু খাবার? খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যাচেষ্টা অনেক পুরনো একটা কৌশল, খোদ জগন্নাথ রায়ের পিতা দর্পনারায়ণ রায় মারা গেছেন বিষ মেশানো খাবার খেয়ে।
কাজেই তিনি সাথে একটা বেড়াল রাখেন। তাঁর কাছে যেসব খাবার আসে, সেগুলো, এমনকি পানি পর্যন্ত বেড়ালটাকে দিয়ে চাখিয়ে নেন। যদি গড়বড় হয়, তবে আগে বেড়ালটা মরবে।
ঘরে যমদূত ঢোকার কোন রাস্তাই রাখেন নি তিনি। এবার বাকি রইলো কোনটি? অস্বাভাবিক মৃত্যুর পথ রোধ করা গেলেও মানবদেহের এক অমোঘ দুর্বলতা রয়েছে, সেটা হল বার্ধক্য।
আপাতত জরা রোধ করার কোন উপায় তাঁর কাছে নেই, তাই বলে তিনি যে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তা নয়। তিনি একদল হেকিমকে নিয়োগ করেছেন, দিবারাত্রি অষ্টপ্রহর, বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে, তারা গবেষণা করে বের করবে এমন কোন ওষুধ কিংবা উদ্ভিদ, যেটা রোধ করবে বার্ধক্য, অনন্তকাল ধরে রাখবে যৌবন। চীনদেশে নাকি এসব জিনিস নিয়ে ভাল এগিয়েছে গবেষকরা, তাই বিপুল অর্থ ব্যয় করে তিনি চীনের উদ্দেশ্যেও দুজন চরকে পাঠিয়েছেন, তারা পত্রযোগে জানিয়েছে যে চির যৌবনের পানীয় তৈরি হচ্ছে, তারা নিয়ে আসবে, তবে এটি তৈরির প্রক্রিয়া খুব জটিল বলে সময় লাগছে।
জমিদারবাবু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাঁর যৌবন ধরে রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে।
জগন্নাথবাবু আশ্বস্ত হননি, তিনি নগদ জিনিসে বিশ্বাসী, হাতে না আসা পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করবেন না। আজ পর্যন্ত তাঁর কোন বিপদ ঘটেনি, কারণ তিনি কাউকে কখনো বিশ্বাস করেন নি। ঐ দুই ব্যাটা চির যৌবনের পানীয় নিয়ে আসতে আসতে যদি নিজেরাই খেয়ে ফেলে তবেই চিত্তির! তিনি বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন।
যাক গে, যা হাতে আসে নি তা নিয়ে পরে চিন্তা করলেও চলবে।
আপাতত তাঁর কাজ হচ্ছে এখানে নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা।
তিনি আহারে খুব সংযমী, মোটেই বেশি আহার করেন না। মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছেন, এটা নাকি যকৃতের ক্ষতি করে। গুড়ুক গুড়ুক করে হুঁকো টানা বড় প্রিয় ছিল তাঁর, কিন্তু এটাও শরীরের ক্ষতি করে জেনে ছেড়ে দিয়েছেন। কত আজব জায়গা এই পৃথিবী, যা কিছুই ভাল লাগে, তা-ই হয় খুব দামী, নয়তো ক্ষতিকর, নয়তো শাস্ত্রে নিষিদ্ধ, নয়তো চর্বিযুক্ত, নয়তো অন্য কারো স্ত্রী!
যে করেই হোক তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে, আজ থেকে পাঁচশো বছর পর যদি তিনি বেঁচে থাকেন, তবে সেই ভবিষ্যৎ যুগের মানুষেরা তাঁকে দেখে বড় আশ্চর্য হবে।
হয়তো তাঁকে একনজর দেখার জন্য হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এখানে চলে আসবে, তিনি হয়ে উঠবেন মহা বিখ্যাত।
এখন জগন্নাথবাবু চীনদেশ থেকে আগত চির যৌবনের "সালসার" জন্য অপেক্ষা করছেন, আর নিজের দিকে কড়া নজর রাখছেন। চলাফেরার সময় তাঁর একটা হাত পকেটে থাকে, তিনি ধরে থাকেন তাঁর পিস্তলটি, অজানা ঘাতককে ঠেকানোর জন্য। বাড়ি থেকে দরকার ছাড়া বড় একটা বের হন না তিনি।
যা কিছু ক্ষতিকর কিংবা আয়ুর প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তার সবই ছেড়েছেন তিনি, কিন্তু একটি জিনিস ত্যাগ করতে পারেন নি।
সেটা হল সংগীত। তিনি নাচগানের বড় ভক্ত। বনেদী রক্তের মধ্যে মদ্য, নারী এবং নৃত্যগীতের প্রতি আসক্তি অনেক পুরনো, থাকবেই, প্রায় অবধারিত। কাজেই তিনি প্রতি রাতে সুরার পেয়ালা সামনে রেখে (সুরা পান করেন না তিনি, আগেই বলেছি) বাইজীদের নাচ দেখেন, এটা ছাড়তে পারেন নি। ছলাকলা, ঘূর্ণন তোলা, নেশা জাগানো নৃত্য হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু জগন্নাথ বাবু পূর্বপুরুষদের এই ব্যাপারটি এখনো চালু রেখেছেন।
নিয়মিত লখ্নৌ থেকে বাইজী আনা হয়, গভীর রাতে নাচগান চলে। যখন জমিদারবাবু ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন তিনি নিজের বিশেষ সুরক্ষিত কুঠুরিতে গিয়ে ঢোকেন। নাচ-গান ভাল লাগলে তিনি বাইজীকে হাতের আংটি, গলার হার ইত্যাদি খুলে দেন, এমনকি মূল্যবান সোনার মোহরও দিয়ে থাকেন, যেমনটি তাঁর পূর্বপুরুষেরা দিতেন।
সেদিনও নাচের আসর বসেছে, পূর্ণ সুরাপাত্র সামনে নিয়ে তাকিয়া ঠেস দিয়ে তিনি চন্দ্রা বাইজীর নাচ দেখছেন। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি, এই যুবতীর যেমন গড়ন, তেমনি গানের গলা।
যেন ইন্দ্রপুরী থেকে নেমে আসা অপ্সরা।
আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না এই ঘরে, শুধু জমিদারবাবু এবং চন্দ্রা বাইজী। এটাই জগন্নাথ রায়ের নিয়ম, নাচের সময় বাজনা হবে ঠিকই, কিন্তু যারা বাজনা বাজাবে, তারা থাকবে পর্দার আড়ালে, তিনি একা সুন্দরী বাইজীর রূপসুধা উপভোগ করবেন। এই একটি ব্যাপারে তিনি খুব খুঁতখুঁতে, তাঁর আনন্দের ভাগ আর কেউ যাতে নিতে না পারে। প্রহরীরা পর্যন্ত নাচ-গানের সময় এখানে থাকে না, বাইরে অপেক্ষা করে।
ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ নাচল চন্দ্রা বাইজী, থেকে থেকে পায়ে ঘুঙুরের ঝঙ্কার তুলল, ঘরটাকে ভরিয়ে রাখল সুমধুর গানের সুরে। জমিদারবাবু খুব আনন্দ পেয়েছেন, যদিও খুব ক্লান্ত লাগছে তাঁর।
চন্দ্রা যে গানটি গাইছিল, সেটার অর্থ করলে দাঁড়ায়, "আমার রূপের আগুন মৃত্যুর চেয়েও তীব্র, সেটা সহ্য করার ক্ষমতা তোমার আছে কী?"
নাচ থামালো চন্দ্রা। আপাদমস্তক স্বর্ণাভরনা যুবতী কুর্নিশ করে মাথা নিচু করে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো।
জমিদারবাবু তাঁর জামার পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলেন।
আজ তিনি নাচ দেখে এত খুশি হয়েছেন যে এর আগে কখনো হননি। তাই চন্দ্রাকে এমন একটা জিনিস দেবেন, যেটা ওর জন্য মানানসই হবে।
তিনি বাক্স খুলে বের করলেন বহুমূল্য একটা পাথর। নীলকান্তমণি। চোখের সামনে ধরতেই ঝাড়বাতির আলোতে ঝলমল করে উঠলো।
তিনি ডাকলেন, চন্দ্রা, এদিকে এসো।
চন্দ্রা পায়ে পায়ে এদিকে এগিয়ে এলো। প্রতি পদক্ষেপে তার পায়ের নুপুরের রুনুঝুনু মিষ্টি শব্দ শোনা যাচ্ছে।
হাত পাতো।
চন্দ্রা অতি বিনয়ের সাথে দুই হাত সামনে অগ্রসর করলো।
তিনি বাড়ানো হাতে ছেড়ে দিলেন পাথরটি। এটা তোমার পুরষ্কার। তোমার নাচ দেখে খুব খুশি হয়েছি। তোমার প্রাপ্য এটা।
চন্দ্রা পাথরটি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে।
বাড়ানো হাত টেনে নেয়।
আজ যাও, বিশ্রাম কর। আমিও নিজের ঘরে যাই। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। কাল রাতে আবার তোমার নাচ দেখবো।
চন্দ্রা যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
চন্দ্রার স্পর্ধা দেখে রেগে যান জমিদারবাবু। কী ব্যাপার, চন্দ্রা? দাঁড়িয়ে আছ কেন?
তিনি তাকিয়ে দেখলেন, চন্দ্রা তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল, জগন্নাথবাবুর অন্তর পর্যন্ত কেঁপে গেলো। তিনি সভয়ে পিছিয়ে গেলেন, বসা অবস্থাতেই।
চন্দ্রা কথা বলে উঠলো। মৃত্যুকে এত ভয় কেন, জমিদারবাবু?
জগন্নাথ রায়ের ভয় আরও বেড়ে গেলো। এই মেয়ে কী করে জানলো, তিনি মৃত্যুকে খুব ভয় পান?
সে আবারো বলল, মৃত্যুকে কি কেউ এড়াতে পারে? পারে না।
জগন্নাথবাবু চন্দ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেই মুখে খেলা করছে হাজার রঙের আলো।
পুরো ঘরটাকে অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে, সব আলো যেন চন্দ্রার চাঁদের মতো দীপ্তিময় মুখমণ্ডলে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ... ... তুমি কী করে জানো?
চন্দ্রা জবাব না দিয়ে বলল, আপনার খাবারে বিষ পরীক্ষা করে দেখা, পকেটের পিস্তল, সবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা, সুরক্ষিত কুঠুরিতে রাত্রিযাপন, চির যৌবনের পানীয়, এসবের কিছুই আপনাকে বাঁচাতে পারবে না, জমিদারবাবু। যার সময় হয়ে যায়, সে আর থাকতে পারে না।
জমিদারবাবু কম্পিত কণ্ঠে বললেন, তুমি কি যমদূত?
প্রশ্নটি করা মাত্র চমকে গেলেন তিনি, তাঁর নিজের কানেই যেন প্রশ্নটি বারবার বেজে উঠলো, তুমি কি যমদূত? তুমি কি যমদূত? তুমি কি যমদূত?
চন্দ্রা নামের এই নর্তকী যমদূত? তা কী করে হয়? এই অপূর্ব রূপসী মেয়ে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে এসেছে, এ তো বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।
চন্দ্রা জমিদারবাবুর এ প্রশ্নের জবাবও দিলো না, বরং খিলখিল করে হেসে উঠলো।
জমিদারবাবুর মনে হল, পুরো ঘরটা চন্দ্রার হাসির দমকে দুলছে, ভীষণভাবে দুলছে।
চন্দ্রা হঠাৎ বলে উঠলো, সবাই ভাবে মৃত্যু খুব কুৎসিত, কদাকার। মৃত্যু যে অনিন্দ্য সুন্দর হতে পারে, তা কি জানেন জগন্নাথ রায়?
এই সামান্য বাইজী তাঁকে, প্রবল প্রতাপশালী জমিদার জগন্নাথ রায়কে নাম ধরে ডাকছে! জগন্নাথবাবু আবার কেঁপে উঠলেন। তিনি চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলেন, চন্দ্রার চোখ ধাঁধানো রূপ তাঁর কাছে অতি ভয়ংকর বলে মনে হল। মনে হল এই মেয়ে অপ্সরা নয়, রাক্ষুসী।
চন্দ্রা জমিদারবাবুর দিকে এক পা এগিয়ে এলো। জমিদারবাবু দুর্বল কণ্ঠে তাঁর প্রহরীদের ডাকার চেষ্টা করলেন, কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুলো না। তিনি লুটিয়ে পড়লেন নরম গদিতে। তিনি ভাবছিলেন, চাঁদ সওদাগর তার পুত্র লখিন্দরের জন্য লৌহপ্রকোষ্ঠ বানিয়েছিল। কিন্তু সর্পদংশনে ছেলের ঠিকই মৃত্যু হয়েছিলো।
আজ জগন্নাথ রায় এত সতর্কতার মধ্যেও কি অসহায়ের মতো মারা যাচ্ছেন।
চন্দ্রা আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। সে হাসি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো জমিদারবাবুর সাতমহলা বাড়ির প্রতিটি কোণে।
***
হুকুম ছাড়া প্রহরীদের নাচঘরে ঢোকা নিষেধ, তাই তারা অপেক্ষা করলো সকাল পর্যন্ত। কিন্তু জমিদারবাবু বেরুচ্ছেন না বলে তারা একসময় ঢুকে পড়লো।
ঢুকে তারা দেখল, দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার জগন্নাথ রায় তাঁর নরম গদিতে পড়ে আছেন, দেহে প্রাণ নেই। দু'চোখ খোলা, তাতে স্পষ্ট ভয়ের চিহ্ন।
আর চন্দ্রা বাইজী? সে যেন ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে।
জমিদারবাবুর জায়গা দখল করলো তাঁর ছেলে ভূপাল রায়, সে-ও পিতার মতো অত্যাচারী হল, প্রজাদের আক্ষেপ আর শেষ হল না। তবে সে তার পিতার মতো এত সতর্ক হয়ে চলে না, ঘুমোয় স্ত্রীর সাথেই।
মদ্যমাংসে তার কোন অরুচি নেই, চরিত্র অতি কুটিল, পকেটে একটা পিস্তল রাখে শুধু। চলতে ফিরতে ঘোড়ার পিঠে বসে থেকেই গরীব প্রজাদের ওপর চাবুক চালায় সে।
জগন্নাথ রায়ের সেই সুরক্ষিত কুঠুরিটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, আর নাচঘর ভেঙে ফেলে নতুন করে বানানো হয়েছে, এবারের মার্বেল পাথরগুলো আরও দামী। ধীরে ধীরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে ভূপাল। এখন সে সুরাপান করতে করতে নাচগান দেখে, মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে।
পিতার অস্বাভাবিক এবং হঠাৎ মৃত্যুতে সন্দেহ হয়েছিলো ভূপাল রায়ের, সে পুরো লখ্নৌ চষে ফেলেও চন্দ্রা নামের কোন বাইজীর সন্ধান পায় নি। তার বাবার মৃত্যুর রাতে ঠিক কী ঘটেছিলো, ব্যাপারটা তাই অস্পষ্টই রয়ে গেছে।
ভূপাল রায়ের স্ত্রী সরোজিনী খুব ভীতু স্বভাবের মেয়ে, সে প্রায় প্রতি রাতেই স্বামীকে জাগিয়ে তুলে বলে, সে একটা মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ আর ঘুঙুর পরা পায়ের চলার শব্দ পাচ্ছে।
ভূপাল স্ত্রীকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। স্বীকার করে না, সে নিজেও সেই শব্দ শুনতে পায়।
আর চিরযৌবনের পানীয় আনতে যাওয়া দুই চর? তারা পথিমধ্যেই জাহাজডুবি হয়ে মারা গেছে। কেউ জানতেও পারেনি, তাদের কাছে সেই পানীয় আসলেই ছিল কীনা।
ভূপাল রায় অনন্তকাল বাঁচতে চায় না। যতদিন বাঁচতে চায়, শুধু সবকিছু ভোগ করতে চায়। অন্তত এদিক থেকে হয়তো তাকে তার পিতার চেয়ে খানিকটা বুদ্ধিমান বলা চলে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।