রাত ২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে মুমুর্ষ অবস্থায় এসেছেন ব্যবসায়ী কবির হোসেন। ছুরির ফলা তার পেটের উপরের অংশ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে আঘাত করেছে। দুই ইঞ্চি সমপরিমাণ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে হৃৎপিণ্ডে।
প্রতিটি হৃদস্পন্দনের সঙ্গে গল গল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। আর ১০ মিনিট এভাবে চললে মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু অপারেশনের জন্য হৃৎপিণ্ডটি প্রস্তুত করতেই সময় লাগবে প্রায় এক ঘণ্টা। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই জানেন, মানবদেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গ হৃৎপিণ্ড। এর গঠন ও রক্তপ্রবাহের প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল।
এ ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া অপারেশন শুধু অসম্ভবই নয়, এটি একটি অবাস্তব ভাবনা। সব দেখে আশা ছেড়ে দিয়েছেন সবাই। কিন্তু আশা ছাড়লেন না উপস্থিত তরুণ চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম জুয়েল ও তার সঙ্গীরা। শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিলেন। অপারেশন কক্ষে এনেসথেসিস্ট চিকিৎসক রোগীর হার্ট পাম্প বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে আহতের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ডা. জুয়েল শেষ চেষ্টা শুরু করলেন। অ্যানাটমি কিংবা সার্জারির পুঁথিগত বিদ্যা মাথায় না নিয়ে মনের কথা শুনলেন। রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড এক হাতে ধরে অন্য হাতে সেলাই করলেন হৃৎপিণ্ডের দুই ইঞ্চির সেই ক্ষত। মানবদেহের বাইরে তখনো লাফাচ্ছিল তাজা হৃৎপিণ্ডটি। সেলাই করার পর আপাতভাবে বন্ধ হলো রক্তক্ষরণ।
দ্রুত সেলাই করলেন পেটের যে অংশ কেটে হৃৎপিণ্ড বের করেছিলেন সেই অংশটিও। আহতের পরবর্তী উন্নত সেবা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। আহতের জীবন বাঁচাতে এর বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না ডা. আমিনুল ইসলাম ও উপস্থিত অন্য চিকিৎসকদের। কিন্তু এর পরও তারা মোটেও আশাবাদী ছিলেন না। প্রায় নিশ্চিত ছিলেন আহতের জ্ঞান আর ফিরবে না, বাঁচবেন না কবির হোসেন।
ঘটনার পর দিনই ভুলে গেলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রায় সবাই, ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আরও শত রোগী নিয়ে। কিন্তু ভুললেন না ডা. জুয়েল। দুই দিন পর নিজেই গেলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। দেখলেন সেই দিনের মৃত্যুর মুখে পেঁৗছে যাওয়া কবির হোসেন দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছেন। কবিরের স্বজনদের চোখে কৃতজ্ঞতার পানি।
ডা. জুয়েল কথা বললেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে। জানালেন সেই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা। তারা রীতিমতো অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন ডা. জুয়েলের দিকে। জানা গেল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আনার পর তার কোনো অপারেশনের প্রয়োজন হয়নি। শুধু নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল দুই দিন।
আহতের স্বজনদের কৃতজ্ঞতা ও মনের অদ্ভুত আনন্দে মুষলধারার বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় নামলেন তরুণ চিকিৎসক জুয়েল। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিলেন। ১৩ জানুয়ারি ও তার পরের দুই দিনের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এভাবেই বর্ণনা করলেন ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করা অন্য তরুণ চিকিসক ডা. শুভ। বললেন, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে চিকিৎসা করে রোগীকে সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে। এটি ছাড়া আহতকে বাঁচানো কোনোভাবেই সম্ভভ হতো না।
বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই কর্মরত ডা. আমিনুল ইসলাম জুয়েল। যোগাযোগ করা হলে বললেন, সেই রাতে অপারেশন কক্ষে উপস্থিত ডা. তামজীদ, ডা. আহসান, ডা. সাবরীনা ও আমার কাছে সম্ভবত এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় 'মিরাকল'। কারণ এর চেয়ে আশ্চর্যজনক কিছু ঘটা মনে হয় সম্ভব নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।