উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় আগের বছরের তুলনায় কমেছে পাসের হার। কমেছে সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়ার সংখ্যা। অনেকে একে ফল বিপর্যয় বলছেন। এর প্রথম কারণ, বার বার পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন করায় শিক্ষার্থীর মনোবলে ভাঙন ধরা। চারবার তারিখ পরিবর্তন করে নেওয়া ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রেই ফেল করেছেন সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী। পাসের হার কমার দ্বিতীয় কারণ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির বিস্তার ঘটানো। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এক পক্ষ অজুহাত তৈরি করছে, অন্য পক্ষ অজুহাতকে কাজে লাগাচ্ছে। আর বার বার পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের সংস্কৃতিও খুব একটা ভালো চোখে দেখছেন না শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বোর্ড সদস্য ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১ এপ্রিল শুরু হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সব তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক বিষয়ে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৮ মে। সে হিসেবেই পরীক্ষার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ১০ লাখ ১২ হাজার শিক্ষার্থী। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, নাস্তিক ইস্যু ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কিছু ইস্যু পরীক্ষার্থীদের এ প্রস্তুতিকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। হরতালে বার বার পিছিয়ে যায় পরীক্ষা। কোনো বিষয়ের পরীক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থী জানতেন না পরে কোন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। কারণ নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হওয়ার নূ্যনতম নিশ্চয়তা নেই। এমনকি আগের রাতে প্রস্তুতির সময়ও নিশ্চিত ছিল না পর দিন পরীক্ষা হবে কি না। ১২ বার পরীক্ষায় সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে। সব বিভাগের মোট ৪১টি পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন হয়। প্রাথমিক পরীক্ষাসূচির একদম শুরুতে থাকা ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার তারিখ চারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার সময় বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা জানিয়েছেন, ইংরেজিতেই ফেল করেছে সর্বাধিক শিক্ষার্থী। হরতালের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণেও আঞ্চলিকভাবে পিছিয়েছে কিছু পরীক্ষার সূচি। অনেক শিক্ষার্থীকে বৃহস্পতি, শুক্র, শনি তিন দিনই পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ছিল না রিভিশন দেওয়ার সময়টিও। এসব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রায় তিন মাস পরীক্ষা দিয়ে শেষ করে শিক্ষার্থীরা। বিপর্যস্ত পরীক্ষাসূচির চাপ ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই এবার প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনটি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। আগের বছর শুধু বাংলা প্রথম পত্র বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হলেও এবার রসায়ন, পৌরনীতি, ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগের কোনো একটি বিষয়ের দুই পত্রে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অথচ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতিতে সবার আগে প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের পূর্ণ আত্দবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল। সবকিছু মিলিয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কমে আসে পাসের হার। কমে আসে আগের বছরের তুলনায় জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা। বিভিন্ন গ্রেডপ্রাপ্তদের মধ্যেও হতাশা আছে, প্রত্যাশিত গ্রেড না পাওয়ার।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মনোবল ভেঙে দেওয়া প্রলম্বিত পরীক্ষাসূচির দায় রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, এরা সেদিকে তাকায় না। এই ফল নিয়েও হয়তো দোষারোপের রাজনীতি হবে। তবে এর দায় সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই। কারণ এক পক্ষ হরতাল দেওয়ার অজুহাত সৃষ্টি করেছে, অন্য পক্ষ সেই সুযোগ গ্রহণ করে একের পর এক হরতাল দিয়েছে। সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির বিস্তৃতি ঘটানো সম্পর্কে তিনি বলেন, বার বার পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো সরকার এলেই শিক্ষাপদ্ধতির ওপর হস্তক্ষেপ করতে চায়। সবচেয়ে সহজ সুযোগ হলো পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন। সে সুযোগটাই গ্রহণ করে তারা। কিন্তু পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনের জন্য কাঠামোগত যে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে তা নেওয়া হয় না। প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই এ পরিবর্তন বিপর্যয় আনতে বাধ্য। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, সাম্প্রতিক সময়ের হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া পাসের হারের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল কি না তা খুঁজে দেখা দরকার। ভিত্তিতে সুস্পষ্ট কোনো পরিবর্তন না করেই বেড়ে যাওয়া পাসের হার নাজুক পরিস্থিতিতে হালকা ঝাঁকুনিতে ভেঙে পড়ার শঙ্কা সব সময়ই থাকে।
প্রায় একই মত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মন্জুরুল ইসলামের। তিনি বলেন, প্রতি বছর পাসের হার বেড়ে যাওয়ার যে প্রচলন হয়েছিল তা খুব ভালো কিছু নয়। এবার একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তববাদী ফল হয়েছে। যোগ্যতাসম্পন্নরাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তির ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য তৈরি হতে পারে। তবে বার বার পরীক্ষার সূচি পরিবর্তনের একটি বিরাট প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনা করে তাদের ক্ষেত্রে তারা একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। তিনিও বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীদের যতটা প্রস্তুত করা প্রয়োজন সেখানে ঘাটতি আছে কি না তা খুঁজতেই হবে।
খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ড. হেমান্ত রোজারিও বলেন, ফল অবনতির অন্যতম কারণ হলো রুটিন পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা করেছিল তা হরতালের কারণে ঠিক রাখতে না পারা। বার বার হরতাল থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ঢিলেমি ভাব তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া পরীক্ষা চলাকালীন হরতালে সহিংসতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা শেষ হওয়া নিয়ে মানসিক চাপ লক্ষ্য করা গেছে যে কারণে ফলাফলে তার প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি সৃজনশীল পদ্ধতির একটি প্রভাব আছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন জামায়াত-বিএনপি জাতীয়ভাবে নয়বার হরতাল পালন করেছে। আঞ্চলিকভাবে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হরতাল ছিল। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। এক বিষয়ের জন্য চারবার প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও হরতালের কারণে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছে। অনেকে ঠিকমতো পরীক্ষার হলেও যেতে পারেনি। এর জন্য ফল খারাপ হয়েছে। বিরোধী দলের অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন শিক্ষামন্ত্রী। একই প্রসঙ্গে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন বলেছেন, পাসের হার কমার প্রধান কারণ বর্তমান সরকারের অদূরদর্শিতা। শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের যেসব কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তা না নেওয়া হয়নি। বরং সন্ত্রাস, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দলীয়করণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে মেধাহীন ও অযোগ্যদের স্থান দেওয়ায় এ ধরনের বিপর্যয় হয়েছে।
শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির বাইরে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তসলিমা বেগম। তিনি বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি সাময়িক প্রভাব রাখলেও শিক্ষার্থীরাই এতে উপকৃত হচ্ছে।
রাস্তার আগুন প্রভাব ফেলেছে শিক্ষার্থীদের মনে : রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বার বার তারিখ পরিবর্তন ও রাস্তার জ্বালাও-পোড়াওয়ের ছবি তাদের মনোবল ও আত্দবিশ্বাস কমিয়ে দিয়েছে। অনেককে বিরক্ত ও হতাশাগ্রস্ত করেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাদিয়া আশরাফ বলেন, পরীক্ষার আগের রাতে পড়তে বসে জ্বালাও-পোড়াও অবস্থা শুনতাম। ভয় হতো পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়ও। একই তারিখ বার বার পরিবর্তনের যন্ত্রণাও ছিল। আসলে এবারের পরীক্ষায় আমার আত্দবিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল, তাই হয়তো এ প্লাস পাইনি। আমি রাজনীতিকে ঘৃণা করি। নটর ডেম কলেজের মীর নাজিমুজ্জামান সানি বললেন, বার বার পরীক্ষা পেছানোর কারণে আমি একসময় মন খারাপ করে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আবার প্রথমবার রসায়নের সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ছিল। একই অভিযোগ রাজউক কলেজের শিক্ষার্থী কাশফিয়া খানেরও। এসএসসিতে এ প্লাস পাওয়া কাশফিয়া এবার পেয়েছেন 'এ'। তিনি বলেন, এত লম্বা সময় ধরে পরীক্ষা হওয়ার কারণে মনোযোগ কমে গিয়ে আমার ফলাফলের এই সর্বনাশ হয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।