আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেক্যুলারিজম, রবীন্দ্রনাথ ও রাখাল ছেলের দল

আমার বর্ণমালা, আমার অহংকার

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত পণ্ডিত শিবনারায়ণ রায় একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, পঁচিশে বৈশাখের পূজা অনুষ্ঠান আড়ম্বরে এবং সংখ্যাধিক্যে দুর্গাপূজাকেও হার মানাতে বসেছে। দুর্গাপূজার ব্যাপ্তি ও গম্ভীরতাকে এখন ছাড়িয়ে গেছে ‘সর্বজনীন’ রবীন্দ্রোত্সবের ঘটা। এই কারণে রবীন্দ্রপূজার যারা সনদপ্রাপ্ত পুরোহিত (লেখক, অভিনেতা, গাইয়ে কিংবা আবৃত্তিকার) তাদের বাজার সরগরম। যে দেশে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবীর ছড়াছড়ি, সেখানে আরও একজন দেবতার আগমন জনতার ভালো না লাগার কথা নয়। কারণ, দেশের মানুষ দেব-দেবীতেই অভ্যস্ত।

কিন্তু যারা নিরাকার খোদায় বিশ্বাস করে, আল্লাহ ছাড়া কারো আনুগত্য স্বীকার করে না তাদের জন্য দেবতার ধারণাটা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার বৈকি! কিছুদিন হলো বাঙালি মুসলমান সমাজের একাংশ (সংখ্যায় কম হলেও শক্তিমান) যারা সংস্কৃতির দিক দিয়ে সম্ভবত ইসলাম ছেড়ে দিয়েছেন এবং নিজেদের জন্য এক সেক্যুলার ধর্মের প্রবর্তন করেছেন তারা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠছেন। এখন বুঝিবা রবীন্দ্রের চরণামৃত পানে মোক্ষপ্রাপ্তিই তাদের একমাত্র কাম্য। এসব সেক্যুলারবাদী রবীন্দ্র চর্চার নামে যা করেন তা রীতিমত দেবপূজা ও আরাধনার পর্যায়েই পড়ে। বাংলাদেশের একজন মহিলা কবি সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রবণকে একবার ইবাদতের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এ দেশে ঘটা করে রবীন্দ্রোত্সব উদযাপনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ওয়াহিদুল হক সাহেবকে দেখেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি ধুতি পরতেন, গড় হয়ে প্রণাম করতেন।

শুধু তাই নয় মৃত্যুর পর নিজের লাশটি পর্যন্ত বাঙালি মুসলিম সমাজের সংস্কৃতি অনুযায়ী ইসলামী মতে দাফন করার অনুমতি দেননি। রবীন্দ্রনাথের একটি প্রিয় শব্দ ছিল মহাভারত। এই মহাভারত কিন্তু ইউরোপের নেশন স্টেটের আদর্শে গড়ে ওঠেনি। এই মহাভারতের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুত্ব। এটা সত্য রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় ধর্মের নামে ধর্মতন্ত্র, সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসকে আঘাত করেছেন।

জীবনের শেষদিকে এসে তিনি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের ব্যাপারটা বোঝারও চেষ্টা করেছিলেন। কালান্তরের লেখাগুলো তার প্রমাণ। তারপরও হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বের সমীকরণও তিনি একই সঙ্গে করেছেন। তার আত্মপরিচয় প্রবন্ধটিতে সেই জাত্যাভিমানী হিন্দুর পরিচয়ই আমরা দেখতে পাই ঃ আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাতে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে। মোটের উপর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে।

অনেক সময়ই তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে ঈশ্বরের শাসনের সঙ্গেও তুলনা করতেন। এ কোনো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীর কথা হতে পারে না। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। আর ব্রিটিশের লাভ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও খাড়া করে দিতে। কবির এ মনোপরিবর্তনে ব্রিটিশের হাত থাকলেও থাকতে পারে।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন খুব তীব্র হওয়ার কারণে কার্জনের বঙ্গভঙ্গ এক সময় রদ হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার তখন পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এতেও বাঙালি হিন্দুরা ক্ষেপে যায়। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও চায়নি ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় হোক।

তারা মনে করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটা মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় আর মুসলমানের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে তাদের পাতে ভাগ বসাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বকবিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। আজ যেসব রাখাল ছেলেদের রবীন্দ্র বিলাস পেয়ে বসেছে তারা জানে না তাদের দেবতাতুল্য মানুষটি রাখাল ছেলেরা লেখাপড়া শিখে সমাজের উপর তলায় উঠে আসুক এটা কখনোই চাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রায় একই সময় কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু বিশ্বভারতী মুসলমান ছাত্রদের মোটেও আকর্ষণ করেনি।

ঠাকুর পরিবারের অধিকাংশ জমিদারি ছিল পূর্ববঙ্গে। রবীন্দ্রনাথও পূর্ববঙ্গে কাটিয়েছেন বহুদিন। তার পরেও মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে তিনি তার শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে উত্সাহ পাননি। তিনি এটা গিয়ে তৈরি করেন বীরভূমে। প্রথমদিকে শান্তি নিকেতনে মুসলমান ছাত্রদের কোনো প্রবেশাধিকারই ছিল না।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেকের কাছে চাঁদা চেয়েছিলেন। হায়দরাবাদের নিজাম তাকে সে আমলে এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই চাঁদার সূত্রেই কিছু মুসলমান ছাত্র সুযোগ পায় শান্তি নিকেতনে লেখাপড়া করার। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন এদের একজন। মনে রাখা দরকার, বিশ্বভারতী নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গে একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ বিকাশ হওয়ার সুযোগ পায় আর তা এ অঞ্চলের মানুষের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখে।

অর্থাত্ ইতিহাসের নিরিখে দেখতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ নয়, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিলেন তারাই এ অঞ্চলের মানুষের সত্যিকারের জাগরণে বড় ভূমিকা রাখেন। যা আজকের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম ভিত্তি। তারাই পূর্ববঙ্গের মানুষের সত্যিকারের জাতীয় চেতনার উত্স হওয়ার দাবিদার। আজকের প্রজন্ম হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা নওয়াব সলিমুল্লাহর নামই শোনেনি। এদেশের মানুষের প্রতি এই মানুষটির আত্মত্যাগকে বোধ হয় আমরা ভুলতে চাচ্ছি।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.