আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেক্যুলারিজম এবং মৌলবাদ

‘তুমি যাকে মৃত্যু বল, তুমি যাকে বল শেষ, সমূল পতন

লড়াকু সেক্যুলারিজম বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটিকে স্পন্দমান করে রেখেছে। আমার বলার ধরনে কেউ কেউ হাসতেও পারেন। এটা সত্য, রাজনৈতিক সংস্কৃতি অস্থিতিশীল, কিন্তু এই অস্থিতিশীলতা অধিকাংশ জনসমষ্টিকে হত্যার দিকে প্রলুব্ধ করছে না। যারা প্রলুব্ধ হচ্ছে তারা মৌলবাদী, তারা রাজনৈতিক ও ধর্মজ অর্থে মৌলবাদী। তারা সংখ্যার দিক থেকে বাড়ছে না।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মৌলবাদ শেষ কথা নয়। বাংলাদেশে ব্রিটিশ আমলে, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের (ইসলাম কিংবা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের) কোনো বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অনুপস্থিতির দরুন ধর্মের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল ভঙ্গুর, তাই ধর্ম মানা এবং ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার মধ্যে ফাঁক ছিল। গ্রামাঞ্চলে ধর্মবিষয়ক আইন এনফোর্স করার কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান ছিল না, কোনো মিলিশিয়া ছিল না, ধর্মবিশ্বাসী একটা গ্রুপকে অন্য গ্রুপের বিপরীতে (শিয়া-সুনি্ন-ওয়াহাবি, উচ্চবর্ণের হিন্দু বনাম নমঃশূদ্র) সংহত থাকতে হয়েছে, নয়তো জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। ইবনে খলদুন মরু অঞ্চলের পরিসরে এই প্রক্রিয়া নানাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

স্বল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের পরিসরে ক্ষমতাহীন। এই ক্ষমতাহীনতা ধর্মকে ডেসপটিক হতে দেয়নি। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ডেসপটিক হয়েছে, কিন্তু ধর্ম (যেকোনো ধর্ম) ডেসপটিক হতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র ছিল ডেসপটিক, ধর্মও ছিল ডেসপটিক। ধর্মের ডেসপটিক হওয়ার কারণ ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছিল রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের স্বার্থে।

পূর্ব পাকিস্তানে একই ধর্ম অধস্তন হয়েছে রাষ্ট্রের দিক থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানে ধর্ম উত্থিত মূল্যবোধ এবং পূর্ব পাকিস্তানে একই ধর্ম উত্থিত মূল্যবোধ আলাদা। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজ পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। সে জন্য ধর্মের সূত্র এক রাষ্ট্রের দুই অংশে (এক অংশে ধর্ম হচ্ছে জয়ী এবং অন্য অংশে অধস্তন) এ দাবি করা সম্ভব নয়। কেন রাষ্ট্রের এক অংশে রাষ্ট্র ডেসপটিক এবং অন্য অংশে রাষ্ট্র উৎসারিত করছে প্লুরালিস্টিক সিভিল সোসাইটি? রাষ্ট্র ও ধর্মের পরিসরে এই প্রশ্নটি ইবনে খলদুনের মতো বারবার উত্থাপন করেছেন আর্নেস্ট গেলনার।

পাকিস্তান আমলে সেক্যুলার সরকারের বৈধতার প্রত্যাখ্যান থেকে থেকে ঘটেছে। ডেসপটিক রাষ্ট্র সরকারকে সেক্যুলার হতে দেয়নি। তার দরুন নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রধানতম সমস্যা হচ্ছে রাজনীতি আর স্থানিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কৃষক আন্দোলন থেকে ছয় দফার মাধ্যমে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা রাজনীতিকে অনবরত সেক্যুলার করে তুলেছে।

পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সরকার ও সরকার ব্যাখ্যাত ধর্ম, রাষ্ট্র, সরকার ও ধর্মকে ডেসপটিক করেছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে শাসন করার গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে সরকার সম্পর্কে আস্থাহীনতা, শাসক শ্রেণী সম্পর্কে আস্থাহীনতা, একই সঙ্গে ধর্ম সম্পর্কে আস্থাহীনতা। ইবনে খলদুনের উক্তি মনে পড়ে : রাষ্ট্র থেকে যেমন কিছু পাওয়ার আশা নেই, তেমনি ধর্ম থেকে কিছু পাওয়ার আশা নেই। আমরা জীবন থেকে শিখি, আর আমাদের জীবনবোধের ভিত্তি কৃষক সংস্কৃতি। এভাবে বাঁচা আমাদের মধ্যে তৈরি করে ইতিহাস বোধ, আমাদের করে তোলে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং আমাদের পপুলার স্মৃতিগুলোর কাস্টডিয়ান।

এভাবেই আমরা রূঢ় ও সিনিক্যাল সময় প্রতিরোধ করে জীবন যাপন করি। বাংলাদেশ মধ্যযুগীয় সমাজ নয়, এখানকার মানুষ মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা অনেক আগেই বাতিল করেছে, বাতিল করেছে মন্ত্রতন্ত্র ও ধর্মজ গোঁড়ামি। ধর্ম এখানে পিউরিটানিজম নয়, মানুষ পিউরিটানিজমকে মৌলবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেনি। বরং পিউরিটানিজম হয়ে উঠেছে লিবার্টির অন্য নাম। জীবনের মহাকাব্য অনেক বড়, অনেক মহান, আর জীবনের মহাকাব্যের দিকে আমরা বারবার মুখ ফেরাই।

সিভিল সোসাইটি, পপুলিজমের মধ্যে, সমালোচনামনস্ক ভঙ্গিতে বসবাস করে মুক্ত চিন্তার পথ ধরে, মৌলবাদকে উড়িয়ে দিয়ে। জীবনের জটিল বুননে, রক্ষণশীল ও রেডিক্যাল, সেক্যুলার ও ধর্মজ উপাদানগুলো পরস্পর প্রবিষ্ট, বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিকড় ও ঐতিহ্য হাত ধরাধরি করে আছে। সেক্যুলারিজমের মধ্য দিয়ে আমরা সময়ের চিহ্নগুলো বারবার পাঠ করি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.