"ইতিহাস অবিরল শূণ্যের গ্রাস; যদি না মানব এসে তিন ফুট জাগতিক কাহিনীতে হৃদয়ের নীলাভ আকাশ বিছিয়ে অসীম করে রেখে দিয়ে যায়; গ্লানি থেকে আলোকের মহাজিজ্ঞাসায়। "
মূল: সাবা মাহমুদ
অনুবাদ: মোকাররম হোসাইন
কিস্তি: ১ Click This Link
মুসলিম বিশ্বে দাতব্য কর্মসূচি (Muslim World Outreach)
সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সাথে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তদের মতে, বুশ প্রশাসনের ইারাক দখল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচার সহ, মুসলিম বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিরোধিতার মাত্রা আরও তীব্রতর করেছে। বাস্তুবিকই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মরোক্কো, জর্ডান, মিশর এবং তুরস্কের মত বিচিত্র দেশগুলোতে পুনপুন পরিচালিত জনমত জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা আর কখনও এত নিচে নামেনি। প্রবলভাবে এই ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, মুসলিম বিশ্বে ইসলামি প্রতিরোধ (সংস্কারপন্থি বা জঙ্গিবাদী যাই হউক) বিকোশিত হচ্ছে––যদিও ৯/১১ কেন্দ্রিক ঘটনাবলীর পরে বিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দল, জঙ্গি সংগঠন, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংগঠন সমূহ যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব প্রেক্ষাপটে সর্তক হোয়াইট হাউস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (NSC) আনুষ্ঠানিকভাবে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের (আসন্ন আরও অধিক বরাদ্দ সহ) মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ ইন ২০০৩ নামে এক নয়া কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
[১৪] এ প্রকল্পের লক্ষ্য হল “ইসলামকে তার ভেতর থেকে রূপান্তর”। মার্কিন সরকারের বিবেচনায় মুসলিম দেশগুলোতে মধ্যপন্থি (moderate), সহনশীল এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ-জাত বিদ্যমান সংগঠন সমূহ এবং স্রোতাবলী খোঁজে বের করা, চিহ্ণিত করা ও সমর্থন দেয়া। [১৫]
এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থের বেশির ভাগ সিআইএ এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের বদলে USAID (United States Agency for International Development) এর মাধ্যমে ছাড় দেওয়া হয়েছে। [১৬] এই সমূহ অর্থ ব্যয় করা হয় কিছু কর্মসূচির উপর, যেমন: ইসলাম প্রচারকদের প্রশিক্ষণ, ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা যেগুলো “কুখ্যাত মৌলবাদী মাদ্রাসা শিক্ষা”কে প্রতিহত করবে[১৭], সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুলে পাঠ্যসূচি সংস্কার করা, এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা ও অনুষ্ঠান নির্মাণ (যেমন: বেতার ও সেটেলাইট টিভি কেন্দ্র স্থাপন, ইসলামিক টকশো নির্মাণ ও সম্প্রচার, এবং মুসলিম দেশগুলোতে বিদ্যমান গণমাধ্যমের ভেতর ধর্মীয় জনবির্তক সমূহের আবয়ব দেয়া। [১৮] এই বহুস্তরিক প্রকল্পের উদ্দেশ্য একটাই: মৌলবাদী ব্যাখ্যার বিপরীতে রোগ নিবারক ও প্রতিষেদক হিশেবে আজকাল সাধারণভাবে কথিত “মধ্যপন্থি ইসলাম” (moderate Islam)–এর বিকাশ ঘটানো।
এই বিস্তৃত আদর্শিক প্রকল্পের সাথে কোল্ড ওয়ারের সময় সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার ভেতর বিরোধী স্রোতগুলোর কর্মকাণ্ডের সহযোগী হতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল তার সাথে সাদৃশ্য আছে––একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম সহ, আর তা হল চলমান এ অভিযানের একটা প্রকাশ্য ধর্মতাত্ত্বিক কর্মসূচি আছে। যেমন পাররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “কোল্ড ওয়ার সহজ ছিল। ওটা ছিল ইশ্বরবিহীন এক ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু এটার (সাম্প্রতিক মার্কিন কর্মকৌশল) আছে ধর্মতাত্বিক উপাদান। আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি-না বলে যে মার্কিন প্রত্যয় আছে তার মূলে এটা কুঠারাঘাত করে।
এই বিতর্ককে প্রভাবিত করার কোন কর্তৃত্ব কি আমাদের আছে?”[১৯] ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতহীণতার এই ধ্রুপদী উদারনৈতিক উদ্বেগ সত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর বা বাইরে কোথাও মুসলমানদের সংশোধন করার এ অভিযান গুরুতর আইনত প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার কোন ইঙ্গিত দেখা যায়নি। সমালোচনার এমন অভাবের একটা কারণ, আমার মতে, সেক্যুলার উদারনীতিবাদী ও আমূল সংস্কারপন্থিদের মধ্যে ইসলামের আসলেই সংস্কার দরকার––এমন একটা ব্যাপক ঐক্যমত আছে, এমনকি নির্বোধ মার্কিন কতৃত্বকে যদি এরূপ আভিযানের ন্যক্কারজনক দিকগুলোর দায় নিতেও হয়। [২০]
মুসলিম ওয়ার্লড আউটরিচ প্রকল্প যে ধরণের মুসলিম সংবেদনশীলতা রূপান্তর করতে চায় তাকে প্রথানুসারী (traditionalist) হিশেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে রেন্ড করপোরেশনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিসার্চ ডিভিশন কতৃক প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিবেদনে। [২১] রেন্ড প্রতিবেদন, Civil Democratic Islam: Partners, Resouyrces, and Stragtegies-এ বলা হয় যে, ইসলামি জঙ্গি দলগুলো (“মৌলবাদী” হিসেবে উল্লেখিত) ৯/১১ থেকেই পাশ্চাত্যের মনোযোগ আকর্ষণ করলেও মার্কিন কৌশলগত স্বার্থ ও “গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ”––এর প্রতি দীর্ঘমেয়াদি হুমকিটা আসে “প্রথাগত ইসলাম” (traditional Islam) থেকে। আর এ ইসলামের অনুসারীরা বিশ্ব জনসংখ্যার এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশ।
[২২] উক্ত প্রতিবেদন অনুসারে, প্রথানুসারীরা বিশ্বাস করে যে কোরান আল্লার কথা এবং তাদের “লক্ষ্য হল গোঁড়া আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং রংক্ষণশীল আচরণগুলো সংরক্ষণ করা। ”[২৩] এ কাজগুলো তারা করে ইসলামি আচারগুলো (rituals) (যেমন, পাঁচবেলা নামাজ, রোজা, পর্দা বা হিজাব, ইত্যাদি) আন্তরিক ভাবে পালন করার মাধ্যমে এবং প্রতিদিনকার বিষয় আশয়গুলোর ব্যাপারে পথনির্দেশ খুঁজে পেতে কোরান, হাদিস ও ফেকাহ শাস্ত্রের দারস্ত হয়ে। উক্ত প্রতিবেদন এটাও স্বীকার করে যে ঐশীবাণী ও আইনত উৎসগুলোর ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে বহুমুখী: অনেকে “ফেকাহ শাস্ত্রের অক্ষরের সাথে লেগে থাকে” এবং অন্যরা ফেকাহ শাস্ত্রে যেসব বিবেচনা আছে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে ও নতুন ভাবে সূত্রবদ্ধ করতে আগ্রহী। যাহোক, এ প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যারা এভাবে পথ-নির্দেশ সন্ধান করে তারা “দু’একটা প্রশ্ন করেই কর্তৃত্বকে গ্রহণেচ্ছু মানসিকতা” প্রদর্শন করে, এ শর্তটা “কার্যকারণীকভাবে পশ্চাতপদতা ও অনুয়ন্নয়নের সাথে যুক্ত, পরিণামে সব ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার প্রজনন ভূমি। ”[২৪]
এ ধরণের বিচার-বিবেচনা সত্বেও, রেন্ড প্রতিবেদন তার পাঠের সবত্র স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, সমাজ-রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রথানুসারীরা “সাধারণভাবে সহিংসতা ও সন্ত্রাস প্রশ্রয় দেননা”–এমন ধারণা তাদের “মৌলিকভাবে মধ্যপন্থি অবস্থান” নির্দেশ করে এবং তারা “প্রায়শ কার্যকরভাবে আন্তধর্মীয় সংলাপের কথা বলে” এবং তাদের কতেক নেতৃবৃন্দ “সামাজিক অনেক ইস্যুতেই অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অবস্থান” নেয়, যেমন: নারীদের অবস্থা, রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, এবং ইসলামি ফেকাহ’র (juristic corpus) সংস্কার।
[২৫] প্রতিবেদনটাতে এটাও পরিষ্কার যে, প্রথানুসারীরা যদিও রাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাশা করে, ধর্মানুরাগী সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্র ক্ষমতা জব্দ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের লক্ষ হল বিশাল মুসলিম জনগণের সামাজিক প্রথা, মূল্যবোধ, এবং জীবনযাপন তৃণমূল কর্মতৎপরতার মাধ্যমে রূপান্তর করা। প্রতিবেদনটি স্বীকার করে যে এই প্রথানুসারীরাই দাতব্য সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছাপাখানা, মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা এবং তারাই গ্রহণ করে সামাজিক ও উন্নয়ণধর্মী নানা কর্মসূচি। এই প্রতিবেদন যেটা বলতে ব্যর্থ হয়েছে তাহল এই সব সংগঠনগুলোই মুসলিম বিশ্বে সুশিল সমাজের মেরুদন্ডের যোগানদাতা, বিশেষ করে যখন উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো ১৯৭০’র দশক হতেই ক্রমবর্ধমানহারে গৃহীত নব্য-উদার অর্থনৈতিক কর্মপন্থার চাপে সমাজ সেবার কার্যক্রম হতে সরে এসেছে।
এ-রকম নানা প্রবণতা প্রথানুসারীদের মধ্যে পাওয়া সত্বেও, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের উন্নয়নে তাদের সাথে কোন মৈত্রি স্থাপনের সম্ভাবনা রেন্ড করপোরেশন দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দেয়।
রেন্ড প্রতিবেদন এই প্রত্যাখানের দুটি প্রথমিক কারণ হাজির করে: প্রথমত, মুসলিম দেশ ও সম্পদের উপর যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যে জঙ্গি ও মৌলবাদী সমালোচনা আছে তাতে প্রথানুসারীদের সায় আছে; দ্বিতীয়ত, ঐশী বাণীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, যেটা পাশ্চাত্যের এনলাইটেনমেন্ট ব্যঞ্জনার সাথে অসঙ্গত। [২৬] রেন্ড প্রতিবেদন, মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ কর্মসূচির মতই, মৌলবাদী কিংবা জঙ্গিদের প্রতি মনসংযোগ না-করে বরং এই প্রথানুসারীদের প্রতি মন দেয়। রেন্ড প্রতিবেদনের যুক্তি হচ্ছে প্রথানুসারীদের বাস্তবিক অবস্থান (substantive positions) অতটুকু অসহনীয় নয় যতটুকু অসহনীয় তাদের বিশ্বাস, মনোভঙ্গি, এবং চিন্তার ধরণ। [২৭] এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ: (১) কোরানের ঐশ্বরিকতায় তাদের বিশ্বাস এবং কোরানকে একটা ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করতে না পারার ব্যর্থতা; (২) এটা না বোঝার ব্যর্থতা যে মুহাম্মদ তাঁর সময়েরই উৎপন্ন ফল, যার জীবনে আধুনিক অস্তিত্বের সমস্যাগুলো সমাধানে খুব সামন্যই প্রস্তাবনা আছে। এবং (৩) [ইসলামিক] বিচারিক (juristic) ঐতিহ্যকে তার ন্যূনতা ও বিপরীত চরিত্রের জন্য তিরষ্কার করতে অক্ষমতা।
এটা লক্ষণীয় যে বাস্তব-রাজনৈতিক (realpolitik) এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারক পলিসি থিংক ট্যাংক’র যথেষ্ট প্রচেষ্টা দেয়া উচিত প্রথানুসারী ধারার নৈতিক যুক্তিবাদীতায় ধর্মতাত্ত্বিক খুঁত ও ব্যাখ্যাগত ত্রুটি বিশ্লেষণে। যেটা সম্ববত আরও বেশি বিশ্ময়কর যে রেন্ড করপোরেশন মনে করে প্রথানুসারী মুসলিম ব্যক্তিচৈতন্য কেবল অপরিণতই নয় বরং বিপদজ্জনক––এমনকি জঙ্গি বা মৌলবাদী’দের থেকেও বেশি। লক্ষনীয় যে, রেন্ড প্রতিবেদনের রচয়ীতারা ভাবেন, ঐশী গ্রন্থ, আইনগত কর্তৃত্ব, এবং নব্যুয়তী উদাহরণ এসবের প্রতি প্রথানুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সভ্যায়ণ (civilizing) প্রকল্পের পথে একটা বাধা। যেহেতু রেন্ড প্রতিবেদন সমাপ্তি টানে, “আধুনিক গণতন্ত্র আলোকসম্পাত (Enlightenment) মূল্যবোধের উপর দাঁড়ায়: প্রথানুসরণ (traditionalism) এই সব মূল্যবোধগুলোর প্রতিপক্ষ.... প্রথানুসরণ সমালোচনামূলক চিন্তা, সৃষ্টিশীল সমস্যা সমাধান, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সেক্যুলারিজম––এসব আধুনিক গণতান্ত্রিক মনভঙ্গির প্র্রাথমিক শর্ত সমূহের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়ায়। ”[২৮]
এই ধরণের দালিলিক উপস্থাপনায় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গণতন্ত্রের ধারণা ফাঁকা থাকার বাস্তবতা সত্বেও, আলোকসম্পাত’র সিঁড়ি বেয়ে মুসলিম ব্যক্তিচৈতন্যের অগ্রগতির প্রশ্নটা আর পররাষ্ট্র দপ্তরের ১৯৭০’র ও ১৯৮০’র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে উসামা বিন লাদেন ও তার আফগান মুজাহিদীন ব্রান্ডের সাথে দলিল সাবুত প্রমাণিত মৈত্রীবন্ধন তীব্র বৈপরীত্য নির্দেশ করে।
একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার দীর্ঘদিন ধরে বরদাশত করছে মধ্যপ্রাচ্যে সর্ব-আরব সমাজতন্ত্রী ধারার বিপরীতে আপদ-নিবারক হিসেবে সৌদি রাজতন্ত্রের ওহাবী ইসলাম প্রর্বতনা, যা এখন ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। [†] রেন্ড প্রতিবেদনের যুক্তি-তর্ক স্পষ্টতই পূর্বের এই রাজনৈতিক কৌশলের অপর্যাপ্ততা সনাক্ত করে––যে কৌশল আবর্তিত হয় চাতুরিপূর্ণ মৈত্রীগুলোকে (আফগান মুজাহিদীন কিংবা সৌদি ওহাবী যার সাথেই হোক) কেন্দ্র করে এবং আরও বিস্তৃত ও সর্বব্যাপী শাসন পদ্ধতি ও আদর্শিক রূপান্তরের কৌশল রচনার গুরুত্ব অনুধাবন করে। [২৯] “সমালোচনামূলক চিন্তা ও সৃষ্টিশীল সমস্যা সমাধান”-এ পরিভাষার নিচে একটা সন্দেহ থাকে যে তথাকথিত প্রথানুসরণ, যদিও নিজেই নিশ্চল, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মার্কিন নীতি ও কাঙ্খিত লক্ষ্য সমূহের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদ রচনা করার যুক্তি-তর্ক পরিবেশন করে থাকে। এই সমস্যার প্রতি নজর দিতে পররাষ্ট্র দপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অন্তত সাময়িকভাবে, যেটা দরকার তা হল সেক্যুলার ধর্মতত্ত্ব (secular theology)––ক্ষমতার রাজনীতি নয়। এই ভাবাদর্শিক সংস্কারের যুদ্ধটা তাই একটা সেক্যুলার রূপ নিয়েছে, বিশেষ করে যদি আমরা একে ধর্মের বিলোপ অর্থে না-বুঝে ধর্মের পুনর্বিন্যাস অর্থে বুঝি, যাতে করে উদার রাজনৈতিক শাসনের বিশেষ এক মডেলের সাথে ধর্মকে উপযোগী করা যায়।
[৩০] এ অর্থে সেক্যুলারিজম একই সাথে একটা বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ–এ দুয়েরই নির্দেশক।
সনদ ও শরাহ:
১৪.David Kaplan, “Hearts, Minds and Dollars: In an Unseen Front in the War on Terrorism, America Is Spending Millions … to Change the Very Face of Islam,” U.S. News and Workd Report, April 05, 2005, পাওয়া যাবে, Click This Link (০৯ নভেম্বর ২০০৫’এ অভিগমন)। আরও দেখুন White House’s “National Stratehy for Combating Terrorism” (February 2003), যেটা মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ প্রোগাম প্রতিষ্ঠার সূচনা করেছিল। পাওয়া যাবে Click This Link
১৫. Kaplan, “Hearts, Minds and Dollars.”
১৬. ৯/১১ পরবর্তী তিন বছরে, USAID কতৃক ব্যয় তিন গুন বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে––যার অর্ধেকেরও বেশি মুসলিম বিশ্বে পরিচালিত প্রকল্প সমূহে ব্যয় করা হয়েছে (Kaplan, “Heartts, Minds, and Dollars”)।
১৭. সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি শুরু হয়েছিল পাকিস্তানে USAID’র অধীনে পাকিস্তান শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে যৌথ সহযোগীতায়, একটা মডেল মাদ্রাসা প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে সম্ভবত অর্ন্তভূক্ত হয়েছিল এক হাজারেরও বেশি স্কুল।
একই ধরণের প্রোগ্রাম হর্ণ অব আফ্রিকায় চালু করা হয়েছিল আরও পরিমিত মাত্রায় (Kaplan, “Hearts, Minds, and Dollars”)।
১৮. ৯/১১ পরবর্তী সময়ে মার্কিন সরকার Radio Sawa এবং Al-Hurra নামে স্যাটেলাইট টিভি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে এবং ইসলামের উদারনৈতিক ব্যাখ্যা বলতে তারা যা বুঝে তা উচ্চকিত করতে। অধিকন্তু, পররাষ্ট্র দপ্তর আল-জাজিরা এবং আল-আরাবিয়া’র মত বিদ্যমান টিভি নেটওয়ার্ক গুলোর অনুষ্ঠানসূচিকেও (বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসূচি) প্রভাবিত করতে চেয়েছে প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। দেখুন Smantha Shapiro, “The War inside the Arab News Room,” New York Times Magazine, জানুয়ারি ২, ২০০৫। Steven Weisman’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাপক মার্কিন চাপে কাতার সরকার আল-জাজিরা টিভি স্টেশনের জন্য আর্থিক ভর্তূকি ক্রমহৃাস করার এবং একে বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে।
“Under Pressure, Qatar May Sell Jazeera Station,” New York Times, জানুয়ারি ৩০, ২০০৫।
১৯. Kaplan, “Hearts, Minds, and Dollars”।
২০. এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের মধ্যে কেবল মার্কিনীরাই নয়, বরং অনেক সেক্যুলার মুসলমানও আছে যারা সমকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্য সহ একটি অপরিহার্য পাপ (necessary evil) হিসেবে বিবেচনা করেন। এই অপরিহার্য পাপ তাদেরকে নিজ দেশে ইসলামের (Islamism) পশ্চাদপদ শক্তি সমূহের সাথে সংগ্রামে সাহায্য করবে। যেমন একজন পাকিস্তানী সেক্যুলার কর্মী উল্লেখিতভাবে আমাকে বলেন, “আমেরিকানরা এখন মৌল্লাদেরকে পেদানী দিচ্ছে (beating the shit out of mullahs)।
দেখে ভালই লাগছে যদিও এটা তাদের আরও আগে করা উচিত ছিল। অবশেষে উসামা তাদের একটা শিক্ষা দিয়েছে: তাদের [আমেরিকানদের] এইসব উণ্মাদ মৌলবাদীদের (crazy fundies) [আফগান মোজাহিদীন] কখনও সাহায্য করা উচিত হয়নি। এখন তাদের চেতনা এসেছে। তারা বন্দুক ও টাকাকরি দিয়ে যে সাহায্য আমাদের করবে, আমরা নিশ্চয় তা ব্যাবহার করব। ” (আহমেদ ওমর থেকে লেখকের নেয়া এক সাক্ষাতকার থেকে উৎকলিত, করাচি, পাকিস্তান, ডিসেম্বর, ২০, ২০০৪)।
২১. রেন্ড করপোরেশন (Rand Corporation) একটা নামকরা রক্ষণশীল থিংক ট্যাংক। এর বোর্ড মেম্বার ও ডিরেক্টরদের মধ্যে আছেন ডোনাল্ড রামসফেল্ড, ডিক চেনি এবং কন্ডোলিজা রাইসদের মত ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর কালে রেন্ড করপোরেশন প্রথমত প্রতিষ্টিত হয়েছিল Douglas Aircraft Company’র সাথে U.S. Air Force’র চুক্তির অধীনে। কিন্তু এরপর এটা একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, লাতিন আমেরিক, মধ্য এশিয়া, এবং পূর্ব ইউরোপ–এসব অঞ্চলে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি যে দিক মোড় নিয়েছে সেটা নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
অতি সম্প্রতি Rand Corporation রাজ্য ও রাষ্ট্র’র জেলখানা গুলো বেসরকারীকরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা’র মত অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতেও তৎপর হয়ে উঠেছে।
২২. শেরিল বেনার্ড, Civil Democratic Islam। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, এই রেন্ড প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল মুসলিম ওয়ার্ল্ড আউটরিচ প্রকল্পটি যে বছর হাতে নেয়া হয়েছিল সেই একই বছর। আর উক্ত প্রকল্প ফেব্রুয়ারি ২০০৩’এ ছাড় পাওয়া সন্ত্রাসবাদের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রণিত জাতীয় কৌশলপত্রের ফল হিসেবে ব্যাপকভাবে ভাবা হয়।
২৩. Benard, Civil Demoratic Islam, পৃষ্ঠা: ৪।
traditionalist প্রত্যয়টি রেন্ড করপোরেশনের আবিষ্কার নয়। মৌলবাদী ইসলাম এবং প্রথানুসারী (traditionalist) ইসলাম––এ বিভাজন ইসলামের জ্ঞানচর্চার ধারায় একটি বিষয় হিসেবে হাজির আছে এবং প্রায়শ ইষলামি তৎপরতার রাজনৈতিক ও নিরবতাবাদী (quietist) আঙ্গিকগুলোকে চিহ্ণিত করে। আমার নিজের মত হচ্ছে এরকম সহজ বিভাজন রাজনৈতিক ইসলামের ধারণাকে অনিয়মিত (anomally) হিসেবে প্রদর্শনকরী বিশ্লেষণধর্মী অনুমানকে একটা সমস্যা আকারে উপস্থাপন করার যথেষ্ঠ ক্ষমতা রাখেনা। অধিকন্তু, এ-বিভাজন যে জটিল উপায়ে ইসলামি আন্দোলনগুলো তাদের নীতিগত ও নৈতিক (ethical and moral) তৎপরতার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে পরিবর্তন করে দিয়েছে তাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। এ বিষয়ে দেখুন, আমার বই Politics of Piety: The Islamic Revival and the Feminist Subject (Princeton, N.J.: Princeton Press 2005)।
২৪. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ৩২, ৩৪।
২৫. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ৪-৬, ২৯, ৩০।
২৬. প্রতিবেদনটার যুক্তি হল: “এমন কিছু জটিল ইস্যু আছে যেগুলোতে প্রথানুসারীরা মৌলবাদীদের খুবই নিকটতর, অন্য যেকোন গোষ্ঠীর চেয়ে। এই বিষয়গুলো হল শরীয়া বাস্তবায়ণ, পাশ্চাত্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, জেন্ডার সর্ম্পক ও নারীর মর্যাদা, এবং আদর্শ রাজনৈতিক শৃঙ্খলা.... এমনকি সংস্কারপন্থি প্রথানুসারীরাও, সামাজিক ও জীবনযাপনের প্রশ্নে যাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর্ন্তজাতিক আধুনিকতার সাথে অনেক সাযুজ্যমান, প্রায়ঃশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে পাশ্চাত্যের চেয়ে মৌলবাদীদের অনেক কাছাকাছি” (Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ৩০)। এটা দেখা দরকার যে, প্রথানুসারীরারা মৌলবাদী ও জঙ্গিদের কছাকাছি––প্রতিবেদনটার এ উপসংহার কোন পর্যবেক্ষণকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের (empirical evidence) উপর স্থাপিত নয়।
প্রতিবেদনটার রচয়িতা স্বীকার করেন: “যদিও কেবল সুষম গবেষণাই পারে ইসলামি সংগঠনসমূহ ও চরমপন্থি আন্দোলনসমূহের মধ্যে সুনির্দিষ্ট যোগাযোগ উন্মোচন করতে, প্রথানুসারী মঞ্চ ও মৌলবাদী পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সর্ম্পক প্রায়শ খুঁজে পাওয়া যায়, এমনকি ভাসাভাসা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই” (Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ৩২)।
২৭. উদাহরণ সরূপ, রেন্ড প্রতিবেদন ঐসব প্রথাগত মুসলিমদের সমালোচনা করে, যারা (শরীয়া কতৃক অনুমোদিত) বহু বিবাহের বিরোধিতা করা সত্বেও বহু বিবাহের বিরোধিতা করতে গিয়ে তাঁরা প্রাসঙ্গিক কোরাণের আয়াত ও ফেক্বাহ ভাষ্যের শরণাপন্ন হন। পরিলক্ষিত হয় যে, রেন্ড প্রতিবেদন এসব মুসলিমদের এই অবস্থানকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করে––যে অবস্থানের বুনিয়াদ বাস্তবিক (substantive) নয় বরং পদ্ধতিগত (procedural)। প্রতিবেদনটির মত হল, মুসলমানদের সনাতন (canonical) উৎসগুলো সরাসরি প্রত্যাখান করা উচিত কারণ এই উৎসগুলো এ যুগের প্রশ্ন ও সমস্যার কোন সমাধান দেয়না (Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ১৬-১৭)।
২৮. Benard, Civil Democratic Islam, পৃষ্ঠা: ৩৩।
২৯. আফগান মুজাহিদীনদের (উসামা-বিন-লাদেন যার বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন) প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এবং সৌদি-ওহাবী ইসলামের সাথে তার মৈত্রী এখন সর্ব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে, পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র ও প্রকাশনা সমেত। দেখুন, উদাহরণ সরূপ, Angel Rabasa, Cheryl Benard, Peter Chlak, C. Christine Fair, Theodore Karasik, Rollie Lal, Ian Lesser, and David Thaler, The Muslim World after 9/11 (Pittsburgh: Rand Corporation, 2004)। এই প্রতিবেদনটা United States Air Force কতৃক সম্পাদিত হয়েছিল।
†. যদিও লেখকের মতে ওহাবী ইসলাম ব্যাপকভাবে প্রত্যাখাত হয়েছে। ব্যাপারটা আসলে সে-রকম বলে মনে হয়না।
মধ্যপ্রাচ্যতো বটেই, মিশর, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে ওহাবী ইসলামের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আহলে হাদীস গোষ্ঠী ওহাবী ইসলামেরই অন্যরূপ। ভারত উপমহাদেশে (কওমী মাদ্রাসা কেন্দ্রিক) দেওবন্দীদের উপরও আছে ওহাবী ইসলামের প্রভাব। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার যে ভারতবর্ষে দেওবন্দীদের উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস সৌদি-ওহাবীদের থেকে সর্ম্পূণ আলাদা হলেও চাট্টগ্রাম অঞ্চলে ভুলবশত তাদেরকে ওহাবী বলে ডাকা হয়। জামাতী ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আবুল-আলা-মওদুদী তাঁর ইসলাম চিন্তায় ইসলামের শিয়া ও সুন্নি ধারার সাথে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সমন্নয় সাধন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অধুনা বাংলাদেশের জামাতী ইসলাম ওহাবী ইসলামের দিকে মোড় নিয়েছে।
এজন্য সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।
৩০. কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদ করে বলবেন, শাসনরীতির আদর্শ হিসেবে উদারনীতিবাদ ও সাম্রাজ্য পরস্পর বিপরীত। সাম্রাজ্যের রাজনীতির সাথে উদারনীতিবাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের উপর এটা একটা ভুল উপলব্ধি। এই বিষয়ে দেখুন, Uday Singh Mehta, Liberalism and Empire: A Study in Nineteenth-Century British Liberal Thought (Chicago: University of Chicago Press, 1999)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।