হাসিতে মুক্ত ঝরে
সেক্যুলারিজম বলতে আমরা কি বুঝি? সেক্যুলারিজমের বিপদই বা কোথায়? বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম দেশের প্রেক্ষাপটে এ দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারণ এর সাথে জড়িত শুধু বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দূরাবস্থাই নয়, বরং দেশটির কোটি কোটি নারী-পুরুষের ভবিষ্যৎ। জড়িত শুধু পার্থিব সাফল্যই নয়, অনন্ত আখেরাতের কল্যাণও। সেক্যুলারিজমের অভিধানিক অর্থ হলো ইহজাগতিকতা। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতের এর মূল প্রয়োগ হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা বোঝাতে।
অথচ এটি হলো সেক্যুলারিজমের সম্পূর্ণ ভূল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা যা পেশ করা হয়েছে নিছক ইসলামবিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক স্বার্থে। সেক্যুলারারিজম আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ নয়, বরং দেয় এক প্রচণ্ড ধর্মবিরোধী ধারণা। এর বিরোধ ইসলামের মূল আক্বীদা বা বিশ্বাসের সাথে। সেক্যুলারিজমের ইহজাগতিক চেতনা ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল শেকড়ই কেটে দেয়। ভুলিয়ে দেয় জীবনের আসল লক্ষ্যস্থল এবং পাল্টে দেয় চলার সঠিক পথ।
সেক্যুলারিস্টদের চলার পথে মৃত্যুর ওপারে যাওয়ার কোন ধারণাই নেই। তাদের জীবনে আখেরাত বলে কোন স্টেশন নেই। সিরাতুল মোস্তাকিমও নেই। কারণ, এগুলো অ-ইহজাগতিক বা পরকালীন বিষয়। ফলে তাদের জীবনে নেই পরকালের উদ্দেশ্যে কোন প্রস্তুতি।
সেক্যুলারিজমে পরকাল ও পরকালীন জান্নাত-দোজখের ভাবনা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। যা পার্থীব সেক্যুলারিস্টদের কাছে একমাত্র তাই প্রাসঙ্গিক। ফলে তাদের রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি শিক্ষা-দীক্ষা সর্বক্ষেত্রে প্রকাশ পায় প্রকট ইহজাগিতকতা। এমন ইহজাগতিকতায় কুসংস্কার রূপে গণ্য হয় আখেরাতের ভাবনা। প্রাধান্য পায় নিরেট ভোগবাদ।
যেমন খুশি তেমন ভাবে ফুর্তি করাটিই তখন জীবনের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। ফলে বাড়ে মদ্যপান, ব্যাভিচার, সমকামিতা, দুর্নীতি ও নানা পাপাচার। তাই সেক্যুলারিজমের উজ্বল দৃষ্টান্ত হলো পাপে পরিপূর্ণ পাশ্চাত্যের দেশগুলো। পার্থিব চেতনার ফলে ব্যক্তির মনে যেটি প্রবলভাবে জন্ম নেয় সেটি হলো ধর্মে অঙ্গীকারহীনতা। ধর্মে এ অঙ্গীকারহীনতাই রূপ নেয় প্রচণ্ড ধর্ম বিরোধীতায়।
ফলে বাংলাদেশ, মিশর, তুরস্কসহ যেসব মুসলিম দেশে এসব সেক্যুলারিস্টগণ ক্ষমতায় গেছে সেখানেই তারা প্রচণ্ড ভাবে কাজ করেছে ইসলামের বিরুদ্ধে। তখন ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের আসল পরিচয়কে ঢেকে রাখতে। ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস যে নিছক মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সেটি তখন প্রচণ্ডভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তুরস্কে এরা বহু হাজার আলেমকে হত্যা করেছে। নিষিদ্ধ করেছে আরবীতে আযান, মহিলাদের পর্দা, ইসলামচর্চা এবং ইসলামপন্থিদের রাজনীতি।
বাংলাদেশেও এরা সত্তরের দশকে বহু হাজার ইসলামপন্থিকে হত্যা ও বন্দী করেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরআনের আয়াত ও কোরআন চর্চা নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ করেছে ইসলামপন্থিদের রাজনীতি। ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বললেও ধর্মবিরোধীতাকে তারা রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছে। এভাবে ধর্মচর্চাকেও তারা ব্যক্তিজীবনে সুস্থ্যভাবে থাকতে দেয়নি।
অথচ মুসলমানের জীবনে সর্বসময় যে চেতনাটি কাজ করে সেটি হলো ইহকাল ও পরকাল - এ উভয় কালের কল্যাণচিন্তা। থাকে আল্লাহ-সচেতনতা। তার অটল বিশ্বাস, এ জীবনে অন্ত বা মৃত্যু বলে কিছূ নেই, আছে স্থানান্তর। আরবী ভাষায় এ স্থানান্তরকেই বলা হয় ইন্তেকাল। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাই এ জীবন শেষ হয় না, অনন্ত-অসীম এক পরকালীন জীবনে প্রবেশ করে মাত্র।
পরকালীন জীবনের সফলতাই হলো আসল ও স্থায়ী সফলতা। সেখানে যেমন আছে জান্নাতের অন্তহীন সুখ ও তেমনি আছে জাহান্নামের অবর্ননীয় আযাব। এ দুটি ভিন্ন লক্ষ্য বা স্টেশনকে সামনে রেখে ইহকালীন জীবনেও রয়েছে দু'টি ভিন্ন পথ। একটি দোযখের, অপরটি জান্নাতের। জান্নাতের সে পথটিই হলো পবিত্র কোরআনে বর্ণিত সিরাতুল মোস্তাকিম।
ফলে মোমেনের ধর্মকর্মই শুধু নয়, তার রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ সবকিছু চলে এ সিরাতুল মোস্তাকিম বেয়ে।
সেক্যুলারিস্টদের জীবনের মূল সমস্যা হলো, তাদের জীবনে সিরাতুল মোস্তাকিম নেই। তাদের যাত্রাপথ নির্ধারিত হয় অনন্ত অসীমকালের কল্যাণচিন্তাকে বাদ দিয়েই। তাই তার জীবনের গতিপথটিও ভিন্ন। ফলে মুসলমান থেকে সেক্যুলারিস্টদের ভিন্নতা শুধু চিন্তা-চেতনা, দর্শন বা ধর্ম-কর্মেই নয়, বিপুল ভিন্নতা হলো শিক্ষা, সংস্কৃতি, খাদ্য-পানীয়, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ জীবনের প্রতিটি কর্ম ও আচরণে।
সেক্যুলারিজমের জন্ম পাশ্চাত্যে। ধর্মের নামে মধ্যযুগীয় খৃষ্টানচার্চ ও চার্চকেন্দ্রীক ধর্মযাজকগণ যে সীমাহীন শোষন, নির্যাতন ও স্বৈরাচারি আচরন করতো সেটিই পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে বিদ্রোহী করে। জন্ম থেকেই তাই এটি রিয়াকশনারি বা প্রতিক্রিয়াশীল। প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার ফলেই এটির অনুসারিরা গিয়ে পড়েছে আরেক মেরুতে। এবং সেটি ধর্মহীনতার।
চার্চের অত্যাচারের কারণে সে সময় স্বাধীন ভাবে বিজ্ঞানচর্চাও অসম্ভব ছিল। ধর্মযাজকগণ বহু বিজ্ঞানীকে হত্যাও করা হয়েছিল। কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের একটি বিরাট অংশ চার্চ নিয়ে নিত। তখন বিপুল সংখ্যক বড় বড় চার্চ নির্মিত হতো কিন্ত মেহনতি কৃষক গরীবই থেকে যেত। শিক্ষা, যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রনও ছিল চার্চের হাতে।
তারা ধর্মের নামে ধর্মের মূল শিক্ষাকেই জনগণ থেকে আড়াল করতো। শোষন ও নির্যাতনমূলক এ নীতির কারণে সমাজের অগ্রগতি সে সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয় সাধারণ মানুষ। সে বিদ্রোহে পরাজিত হয় চার্চ এবং বিলুপ্ত হয় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা। কিন্তু সেক্যুলারিস্টদের সীমাবদ্ধতা হলো, ধর্ম নিয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতা সেটি নিতান্তই পাশ্চাত্যের চার্চ ও তাদের খৃষ্টান ধর্ম নিয়ে।
অথচ সে অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা থেকেই তারা উপসংহার টেনেছে সকল ধর্মের বিরু্দ্ধে। এবং সেটিকে প্রয়োগ করেছে ইসলামের বিরুদ্ধেও। ইসলাম যে খৃষ্টান ধর্ম নয়, জীবন ও জগত, শিক্ষা ও বিজ্ঞান নিয়ে ইসলামের যে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধারণা রয়েছে সেটি তাদের জানার সুযোগই হয়নি। কোন এক বিশেষ বৃক্ষের ফল খেয়ে কি অন্য বৃক্ষ নিয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া যায়? কিন্তু তারা সেটিই করেছে। ইসলামের বিরুদ্ধে এটিই হলো তাদের বড় অপরাধ।
বাংলাদেশেসহ সকল মুসলিম দেশে তারা একই রূপ অসত্য ধারণা ছড়াচ্ছে। তাছাড়া পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীদের এ বিদ্রোহ শুধু চার্চের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ বিদ্রোহ পরিাচলিত হয়েছে স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধেও। ফলে সেক্যুলারিস্টদের সচারাচরই পরিণত হয় নাস্তিকে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) পর্যন্ত যে অসংখ্য নবী রাসূল পৃথিবীর বুকে এলেন এবং আল্লাহসচেতন এক ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিচর্যা দিলেন তারা অবস্থান নিল তার বিরুদ্ধেও।
প্রযুক্তি ও শিল্পে পাশ্চাত্যের বিপুল উন্নয়নের পর তারা নিশ্চিতভাবে ভাবতে শুরু করে, এ বিপ্লবের কারণ তাদের অনুসৃত সেক্যুলারিজম। অথচ এমন ধারণা যে সম্পূর্ণ অসত্য সে প্রমাণ প্রচুর।
শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবিকতায় মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিজয় এনেছিল ইসলাম। তখন অবিশ্বাস্য ভাবে সমৃদ্ধি পেয়েছিল মানবতা। এবং নির্মিত হয়েছিল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সভ্যতা।
ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা নামায-রোযার পূর্বে জ্ঞানার্জনকে ফরয করেছে। শিক্ষাই যে মানব-উন্নয়নের মূল সেটি এভাবেই সেদিন স্বীকৃতি পেয়েছিল। এমন একটি ধারণা প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কারণেই ধর্মীয় নেতারা সেদিন মাদ্রাসায় বসে শুধু কোরআন-হাদিস চর্চা করেননি। বরং অমুসলমানদের লেখা বই পড়েছেন এবং সেগুলি আরবীতে তরজমাও করেছেন। যারা ভেড়া চড়াতেন তারা পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিতে।
মানবতা এতই গুরুত্ব পেয়েছিল যে খলিফারা ভৃত্যকে উঠের পিঠে চড়িয়ে নিজে পায়ে হেঁটে চলেছে। রাতে না ঘুমিয়ে আটার বস্তা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে গরীবের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সমগ্র মানব ইতিহাসে একটি দিনের জন্যও কি এমন নজির সৃষ্টি হয়েছে? অতি অল্প সময়ে তারা বিপ্লব এনেছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে। ইউরোপের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান পৌঁছেছে তো তাদের হাত দিয়েই। অপর দিকে মানুষের সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক ক্ষতিটি করেছে পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিস্টগণ।
খৃষ্টানচার্চ ও চার্চকেন্দ্রীক ধর্মযাজকগণ যেমন নির্যাতনমূলক শাসন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল তেমনি সেক্যুলারিস্টগণও জন্ম দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের ন্যায় মানবতাবিরোধী জঘণ্য মতবাদের। এগুলি নিতান্তই তাদের নিজস্ব আবিস্কার। তাদের হাতেই জন্ম নেয় বিশ্বের দূর্বল আদিবাসী নির্মূলের এক অভিনব প্রক্রিয়া। আমেরিকার রেডইন্ডিয়ান, নিউজিল্যান্ডের মাউরী ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ন্যায় বহু জনগোষ্ঠীকে তারা প্রায় নির্মূল করে ছেড়েছে। গবাদী পশুর ন্যায় হাটে তুলেছে আফ্রিকানদের।
ধর্মপ্রাণ মানুষ যেখানে চালিত হয় পরকালীন লাভ-লোকসানের চেতনায়, সেখানে সেক্যুলারিস্টগণ তাড়িত হয় ভোগের তাড়নায়। ভোগের লক্ষে তারা চায় অধিক সম্পদ। ফলে লুন্ঠনে নামে বিশ্ব জুড়ে। লুন্ঠনের এমন উগ্র মানসিকতায় তুচ্ছ মনে হয় অন্য দেশ ও অন্য জাতির মানুষের জীবন। এমন একটি চেতনার কারণেই তাদের পক্ষে সম্ভাব হয়েছিল দুই-দুইটি বিশ্ব যুদ্ধ বাধিয়ে প্রায় আট কোটি মানুষের হত্যা।
সম্ভব হয়েছিল অগণিত মানুষের মাথার উপর দুই-দুইটি আনবিক বোমা নিক্ষেপ। এরাই এখন হিংস্র পশুর ন্যায় দল বেঁধে নেমেছে ইরাক, আফগানিস্তানে। ধর্মশূন্য হলে মানুষ যে কতটা মানবতাশূন্য পশুতে পরিণত হয় এগুলি হলো তারই নমুনা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।