আমি উঠে এসেছি সৎকারবিহীন
১.
আমার বন্ধুদের মধ্যে সবার প্রথমে কবি হয়ে উঠেছিল সে; বিশুদ্ধ সব কবিতা লিখতো। এমন নয় এটা সবাই বলত ওর কবিতা পড়ে, বরং আমারই এমন মনে হত। তখন আমাদের বয়েস তের কি বড়জোড় চৌদ্দ, শরতের ছুটিতে বাসায় এসেছি। ওর সাথে বের হলাম শহর ঘুরতে, সময়টা ভালোই কাটল; তখনও স্বল্প পরিচয়। রিকশা করে ফিরছি, অসময়ের বৃষ্টি নামল সেই বিকেলবেলায়।
রিকশার হুড ওঠাতে বারণ করলে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম,
"কি রে, কি হল তোর?"
"একটু ভিজতে ইচ্ছা করছে, এইসময় বৃষ্টি খুব রেয়ার!" বলে কার যেন কবিতা কয়েক লাইন আওড়ে দিল, রিকশাওয়ালার মুচকি হাসি টের পেলাম। এক রিকশায় বসে প্রথম ভেজাটা অন্য কারো জন্য বরাদ্দ ছিল তখনও পর্যন্ত। আমি খানিক অস্বস্তি নিয়েই ভিজতে ভিজতে বাকি রাস্তাটুকু গেলাম। বাসায় ফিরলে কাকভেজা আমাকে দেখে মা চেঁচিয়ে উঠেছিল,
"এই বৃষ্টিতে রিকশা করে আসতে পারিস নাই?"
"রিকশা নিয়েছিলাম মা, সমস্যাটা অন্যখানে..."
"কি?"
"আমার সাথে একটা কবিও উঠেছিল। "
ক্লাস লেকচারগুলো ফাঁকি দিয়ে ছোটছোট অক্ষরে খাতার পেছনে কবিতা লিখতো সে, পরে আবার সেগুলোকে গোটা গোটা অক্ষরে ডায়েরীতে তুলেও রাখত।
আমি দেখতাম আর ওর কাব্যচর্চার বিশুদ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে বদলে গেল সে, পাশ্চাত্যের ভুতে পেছনে কামড়ে দিল যখন। উৎসাহের বিষয়ের কমতি রইল না আর। ভাটা পড়ল ছন্দোবদ্ধ শব্দগুলো লেখার প্রাবল্যে, আমি দেখে গেলাম। একসময় কিছু লিখলে ওর কাছে দেখিয়ে আনতাম, ও ব্যকরণের ভুল ধরিয়ে দিত, শুদ্ধ বানানটা দেখিয়ে দিত।
কিন্তু আমার চিন্তাগুলোয় অযাচিতভাবে আঙুল ডোবাতে চায় নি কখনই।
২.
আমার সে বন্ধুটা কবি হয়ে ওঠার সংবাদে আমি সবচে' অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, সে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল বেশ আগেই। প্রায় দুই বছর যোগাযোগ না থাকবার পর যখন প্রথম কথা হল; আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম,
ভীষণ বদলে গেছে সে!
ফোনালাপের এক পর্যায়ে একদিন জিজ্ঞেস করে বসল,
"কি রে, তুই না মাঝেমধ্যে কবিতা লিখতি। "
"তোর মনে আছে?" আমি ঢোক গিলি।
"অবশ্যই! এখন লিখিস না ক্যানো?"
"ঐগুলা সবাই লেখে, এমন কিছু না...একটু আধটু পড়ি এই যা।
"
"কার কবিতা পড়িস?"
"হুমম...কবিতা খুব কম পড়া হয়...রাহমান আর কাদরীর কবিতা। "
ও শুনে হেসেছিল। অবশ্য বেশ কিছু কবিতা আমাকে ও ফটোকপি করে পাঠিয়েছিল। বিভিন্ন কবির কবিতা, পুরো বই পাঠানোর সামর্থ্য ছিল না আমাদের কারোরই তখন। আমি এখনও এ বিষয়ে কৃতজ্ঞ আছি, কিন্তু ওর পাঠানো কবিতাগুলো হারিয়ে ফেলেছি বহু আগেই।
আমার বন্ধুদের মাঝে সেই একমাত্র স্বীকৃত কবি ছিল। একটা লিটল ম্যাগ সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিল খুব কমবয়সেই, নাম ছিল "কাঁটাচামচ"। আমাদের তিনজনের জন্য একটা কপি পাঠিয়েছিল। তখনকার কিশোর আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই ম্যাগের কবিতাগুলো পড়ে।
ওর সাথে আর যোগাযোগ নেই তেমন, বছরে দুয়েকবার দেখা হলে কুশলাদি বিনিময় করেই সার।
কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে বলেই শুনেছি, আইনজীবী হবার চেষ্টাটা অব্যাহত আছে তবুও।
৩.
অনেক আগে,
আমার এক দোস্ত হুট করেই একটা কবিতা লিখে ফেলল, সেটা পড়ে তাক লেগে গেল আমাদের সবার। কারণ মাত্র ষোল বছর বয়েসের একজন কিশোরের পক্ষে এমন কিছু লিখতে পারার কথা ছিল না। আমরা চেপে ধরেছিলাম তাকে, যতদুর জানতাম সম্প্রতি একটা মেয়ে ওকে চুমু খেতে রাজি হয়েছিল। খবর শুনে আমরা ঈর্ষান্বিত ছিলাম ভয়ানকরকম, একই সাথে খুশীও ছিলাম।
কিন্তু কবিতাটা অতোখানি লিখতে পারার কথা ছিল না শালার কোনভাবেই...। লাভ হয় নি, সেই চুমু শেষপর্যন্ত কতদুর গড়িয়েছিল সেটা জানা হয় নি আর।
কিন্তু গোল বেঁধে গেল যখন কবিতাটা কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ছেপে দেয়া হল। ম্যাগাজিন সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন আমাদের ট্যারাচোখের মল্লিক স্যার। উনার লেখা কোন বইয়ের এক লাইনের বেশি মর্মোদ্ধার তখনও পর্যন্ত আমরা করতে পারি নাই, এতোটাই জটিল বাংলায় লিখতেন! অথচ ঐ কবিতাটার বিষয়বস্তু বেমালুম স্যারের ট্যারাচোখ এড়িয়ে গেল!!
ম্যাগাজিনটা আছে আমার কাছে, মাঝেমধ্যেই পড়ি এবং ভাবি...
আসলেই কবিতাটা অসাধারণ!
৪.
যার কবিতা আমি দুইচোখে দেখতে পারতাম না, সে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পড়ুয়া ছাত্র ছিল।
প্রেমিকাকে চিঠি লিখে পাঠাতো, সবগুলোই ছিলো কবিতা। জবরদস্তিতে কয়েকটা পড়ালে আমি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম,
"আর একটা পড়তে দিলে তোরে তিনতলার ছাদ থেকে ফালায়ে দিব!"
ও তারপরও লিখে যেত আর আমাকে পড়তে দিত। ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে বেরিয়ে এসে আমরা কয়জন মিলে যখন মিরপুরে একটা বাসা ভাড়া করে একসাথে থাকা শুরু করলাম, ব্যাপারটা আমূল পালটে গেল। প্রতি সপ্তাহান্তে ও ক্যাবে চড়িয়ে প্রেমিকাকে নিয়ে আসত আমাদের ফ্ল্যাটে। ঘন্টাদুয়েকের জন্য মেয়েটাকে নিয়ে ঘরের খিল তুলে দিত।
আর ওর রুমমেট, আমাদের মধ্যে সবচে' নিরীহ ছেলেটা গোমড়ামুখে আমার রুমে এসে বসে থাকত পুরোটা সময়।
বাকিরাও জড়ো হতো আমার রুমে। আমরা সময়টুকু দারুণভাবে কাটিয়ে দিতাম ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ খেলে। কার্ড হাতে নিয়ে উৎকর্ণ বসে থাকতাম আর কল দিতাম,
"টু হার্টস!"
"থ্রি স্পেডস্..." বলত সেই রুমমেট। হুট করে অস্ফুট কিছু আওয়াজ ভেসে এলে ও থতমত খেয়ে বলে উঠত পরপরই...
"ডাবল!"
৫.
আমার এই বন্ধুটি সম্ভবত সবচেয়ে পাগলাটে ছিল।
কবিতাগুলো লিখতো অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে। কিছু কিছু কবিতা এতোটাই উচ্চাভিলাষী ছিল যে হিতে বিপরীতও হয়ে যেত। একবার ওর ঈশ্বরসংক্রান্ত একটা কবিতা পড়ে নাম রটে গিয়েছিল..."ঈশ্বরের কাতুকুতু"। ভয়ানক অভিমান করে সে পরবর্তীতে আর আমাদের ওর কবিতা পড়তে দিত না। ওর সাথে আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল কারণ আমরা একই ব্যান্ডের সদস্য ছিলাম, আমি ভোকাল আর সে লিড গিটারিষ্ট।
আমরা প্রচন্ড কল্পনাবিলাসী ছিলাম, বিখ্যাত সব এলবাম শুনে আমরা সেইসব বিলাসিতায় ভুগতাম। কিন্তু উনিশে পা দেয়া মাত্রই আমাদের জন্য সবকিছু বদলে গেল। একেকজন একেকদিকে ছিটকে পড়লাম। সে ছিটকে পড়ল সবচাইতে দূরে, সুদুর চীনে। যদিও আমরা ঠাট্টা করে এখনও বলি,
"জ্ঞানার্জনের জন্য সুদুর চীনদেশে গেল আমাদের ......"
ভাল আছে সে, দীর্ঘদিনের প্রেমিকাকে বিয়ে করেছে শেষ পর্যন্ত।
দুজনেই উচ্চশিক্ষা লাভ করছে সেখানে এখন। এখনও যোগাযোগ হয় আমাদের, নেটে কিংবা ফোনে। সেবার কথা হচ্ছিল...
"ইদানীং কি করিস?"
"পড়াশোনা ছাড়া যেকোন কিছু..." বলি আমি।
"আরে ধুর! নতুন কি করিস মুভি দেখা আর গেমিং ছাড়া?"
"মাঝেমধ্যে লিখি। " খানিক দ্বিধা নিয়েই বলেছিলাম।
"কি লিখিস?"
"এই ধর কবিতা..."
শুনে সে খুব ঠান্ডা গলায় বলে,
"শেষ পর্যন্ত তুই কবিতা লিখতেছিস? You know that's not for you."
"হ্যাঁ, আমি জানি। " একবিন্দু মিথ্যে বলি নি।
একটু পরেই হঠাৎ করে বলল,
"চলে আয় এখানে...আমি দেখছি তোর কোথায় এপ্লাই করার সুযোগ থাকে। "
"চায়নাতে যাব?"
"আম আছি না এখানে!"
"কি করব ওখানে যেয়ে আমি?" আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আর ঐ শালা একমুহুর্তও না থেমে বলে দিয়েছিল...
"মিউজিক। "
৬.
আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজকে নিয়ে লিখেছিলাম কবিতা একটা ।
এখন মনে হয় নামটা "কবির স্বাভাবিক মৃত্যু" হলে বরং মানানসই হত। কারণ কবি মরলেও মানুষটাতো বেঁচে থাকে, কিন্তু একটা কবিতা মরে যায় কিভাবে? ভুল গেলে? কিংবা হারিয়ে গেলে?
বাদ দেই এসব কথা, নিজেই বিরক্ত হচ্ছি।
আমার নীল রঙের সিগনেচারটা খুঁজে পাচ্ছিনা ক'দিন হল। যদিও আমার কাবার্ডে গোটা তিনেক B- স্ট্রিং রয়েছে লাইট গজের। কেন জানি আমার গিটারের দুই নম্বর তারটা প্রায়ই ছিঁড়ে যায়।
দেয়ালের কোণায় পড়ে থাকা ফেন্ডারটা
এই সুযোগে ভীষণ অশ্লীলতায় ভেংচি কাটছে আমাকে।
-praxis
22/10/2010
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।