চাঁদের দিকে হাত বাড়ালে তার আলো কিছুটা লেগে যায় চিত্তে
হন হন করে চলতে চলতে জমির আইলে হোচট খেয়ে পড়ে গেল শুকুর আলি। ধরে থাকা দা টা দিয়ে ডান হাতের তলা কেটে গেল খানিকটা। পরনের ছেড়া লুঙিটাও ছিড়ে গেল বাম পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটায় বেঁধে। পাশের জমিতে নিড়ানী দিতে থাকা একদল লোক হো হো করে হেসে উঠল। লজ্জ্বাটা আঘাতে লাগল আরো বেশী করে।
কাদা পানিতে ভিজে জুবুজুবু হয়ে পিচ্ছিল আইলটা আকড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আবার উঠে দাড়াল শুকুর আলি । জমির ঘোলা পানিতে হাতের রক্ত ধুইতে ধুইতে আইলের কয়েকটা দূর্বাঘাস দাঁতে চিবিয়ে হাতের কাঁটা জায়গায় লাগাল। মুখে লেগে থাকা ঘাসের অবশিষ্টাংশ চিবুতে চিবুতে আবার চলতে লাগল আইল ধরে।
সূর্যটা প্রায় মাথার উপর । ফাল্গুনেই রোদের মাত্রাটা যেন বৈশাখের মেজাজে।
গায়ের ভেজা গেঞ্জীটা গায়ে শুকিয়ে আবার ঘামে ভেজা শুরু করেছে। দূর্বল শরীরে নাকি ঘাম হয় বেশী। রাতেও খাওয়া হয়নি ভাল। ধার করে আনা আধাকেজি চালের ভাতে ফেন সহ ভাগ করতে হয়েছিল থালায় থালায়। সকালে তো সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়েছে ঘর থেকে।
লুঙ্গির কোচায় চারটি টাকা লুকিয়ে রেখেছিল বিড়িটিরি কিনার জন্য। তাছাড়া যদি আজও কাজ না মেলে দু টাকায় একটা পাউরুটিতো খাওয়া যাবে। আশংকা সত্যি হয়েছে। কাজ হয় নি। এক টাকায় বিড়ি কিনে একটাতে আগুন ধরিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে ফিরছিল বাড়ি।
খিদেয় পেটে চো চো ধরেছে। পা দুটো আর সরতে চাইছে না, মাটির সাথে যেন আটকে যাচ্ছে। মাথাটাও ঘুরছে ,তবু হাঁটছে বাড়ির দিকে।
প্রতিদিনের মতো আজও হাতে একটা দা নিয়ে ৪/৫ কি.মি. পথ হেঁটে শহরে এসেছিল শুকুর আলী। শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ মিনারের সামনের কামলার হাটে অনেকক্ষন বেচা কেনার পন্য হয়ে বসে ছিল সে।
গ্রাহকরা জোয়ান হিষ্ট-পিষ্ট কামলা পছন্দ করে বেচে বেচে নিয়ে যায়। তার মতো ষাটোর্ধ কামলাকে সহজে উে নিতে চায় না। এসময়টায় কাজ কাম তেমন নাই। তাছাড়া বছরে ৬ মাস ঘরের আবাদের ভাত খায় এমনও অনেকেই আসে কামলার দল ভারী করতে। আজ কয়েকদিন প্রায়ই কাজ না পেয়ে ফেরত এসেছে শুকুর আলী।
যে কয়দিন কাজ পায় বাজারে চালের দাম বেড়েছে , নুন তেল তো কিনতে হয়। সুকুর আলী ধারকর্য করে কোন মতে চালাচ্ছে সংসার। তার ওপর ছোট মেয়েটা তিন তিনটা নাতি নাতনি নিয়ে বেড়াতে এসেছে। বেড়ানো ঠিক বলা যায় না । জামাই ঢাকায় রিক্সা চালাতে গিয়ে সিএনজির ধাক্কায় বুকে ব্যাথা পেয়ে বিছানায় পড়েছে।
আয় উপার্জন নাই। টাকা-পয়সা পাঠাতে পারে না । তাই কয়েকদিন বাবার বাড়িতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে খাওয়া থাকার জন্য এসেছে মেয়ে শরিফা। শুকুর আলীর বউ ছামিনা আসার সময় বলছে, কাম চললে ফেরার সময় চাল, শুটকি ও কাচামরিচ নিয়ে যেতে। নাতি-নাতনীর জন্য ৪ টাকার খুরমাও কিনতে বলেছিল ছামিনা ।
আজও কাজ হয় নি । ঘরে একমুট চালও নাই। ছামিনা আগে গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে হাত নেড়ে বাসি ভাত ,পান্তা নিয়ে আসতো । এখন তো তাও পায় না কোথাও । ছামিনার মতো আনেক মানুষ এখন গ্রামে।
কয়জনকে ডাকে গৃহস্থরা। সবই নিশ্চিত না খেয়ে বসে আছে। খিদা ও চিন্তায় শুকুর আলীর মাথা এবার ঝিম ঝিম শুরু করে। পা টলছে। হাটতে পারছেনা ।
চেখের সামনে ভাসতে থাকে অসংখ্য সর্ষে ফুল। ছেড়া গামছাটা মাথায় দিয়ে বসে পড়ে আইলে। ধানের চারাগাছগুলোর ফাঁকে জমে থাকা কিছুটা স্বচ্ছ পানি আজলা ভরে তুলে চোখে মুখে ছিটা দেয়। হঠাৎ মনে পড়ে তার ২ ছেলে জামাল আর কামালের কথা। অনেক বছর হল তারা নিজেদের বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকে।
জামাল রাজমিস্ত্রির কাজ করে আর কামাল রিক্সা চালায়। ২/৩ বছর পর পর ঈদে ভিটে মাটির টানে বেড়াতে আসে বাড়িতে। সপ্তাহ খানিক থাকে। ভিটেটা দুই ভাই রশি টেনে মাপজোক করে খুঁটি দিয়ে চলে যায় । অপেক্ষা করে নির্জন নিস্কন্ঠক ভিটেটির।
তাই তারা ভিটেটির যতটুকু খবর রাখে বাবা-মার ততটুকু খবর রাখে না।
শুকুর আলী আবার হাঁটতে শুরু করে। আরো খানিকটা পথ বাকী। কিন্তু নিজের বাড়ির দিকে না হেঁটে মহাজনের বাড়ির দিকে যায়। অনেকদিন ধরে শুকুর আলীর অপেক্ষায় ছিল মহাজন।
তার পুকুর পাড়ের পাশেই সামান্য এই ১০ শতক মাটির মালিকানা ছিল না মহাজনের। অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিল । আজ শকুর নিজে যাওয়াতে অনেক খুশি হয়েছে মহাজন । তবে ‘সময়টা ভাল না, গৃহস্থের টাকা নাই, জমির দামও ভাল যাচ্ছেনা ’-বলতে বলতে দ্রুত টিপ সই নেয়ার কাজ শেষ করে মহাজন। শুকনা মৌসুম থাকতে ছেড়ে দিতে হবে ভিটেটি।
টিপ সই দিতে দিতে শুকুর আলীর হাতটার সাথে পা দুটোও কাঁপে।
একটা নতুন চটের ব্যাগে চাল ,শুটকি , কাঁচামরিচ ও নাতি-নাতনির জন্য খুরমা নিয়ে বাড়ি ফেরে শুকুর আলী ।
ছামিনা অনেকদিন পর যেন তৃপ্তির হাসিতে স্বামীর দিকে তাকায়। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে শুকুর আলীর ঠোঁটে হাসি আনতে পারেনা । একবার ভিটেটির দিকে একবার আকাশের দিকে তাকায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।