কেউ কেউ একা
বর্তমানে রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদনের কথা ভাবতে পারে না কৃষক। অথচ ষাট দশকের আগে ফসলের ক্ষেতে কোনপ্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হত না। জমির খাদ্য বলতে তখন ছিল শুধু জৈব সার। পোকা-মাকড় দমন করা হত প্রাকৃতিকভাবে। সত্তর দশকের দিকে উচ্চ ফলনশীলজাত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ায় জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আশির দশকে আমাদের দেশে উচ্চফলনশীল ধানের জাত, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার পুরোদস্তর শুরু হয়।
অধিক জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রত্যেকটা দেশকে। জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমি কম হওয়ার কারণে আমাদের অধিক ফলনের কথা ভাবতে হচ্ছে। এই ভাবনা থেকেই কৃষি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন নতুন নতুন ধানের জাত। পাশাপাশি পোকা-মাকড় যাতে ফসলের কোন ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য বাজারে এসেছে কীটনাশক।
আপাতদৃষ্টিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমাদের আদরীয় বস্তু হলেও দিন দিন রাসায়নিক সার জমির উর্বরতা শক্তি কেড়ে নিচ্ছে এবং কীটনাশক ক্ষতি করছে আমাদের পরিবেশের। দেশের অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত। তারা কীটনাশক প্রয়োগের নিয়ম কানুন জানে না। ফলে কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচার প্রচারণার অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধীকৃত আছে।
অনেক বালাইনাশক নিষিদ্ধ হলেও তা বাজারে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮,০০০ মে.ট. কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে অধিক ফলনের জন্য। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের আনুমানিক শতকরা ২৫ ভাগ অর্থাৎ প্রায় ২,০০০ মে.ট. বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিকটবর্তী উন্মুক্ত জলাশয়ে মিশছে। কৃষি জমিতে এত ব্যাপক পরিমাণে
কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জলজ জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণের হুমকি সৃষ্টিসহ পরিবেশের উপর নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। শুধু যে জলজ প্রাণী কীটনাশকের শিকার হচ্ছে তা নয়।
পরিবেশ হচ্ছে হুমকির সন্মুখীন। কৃষকরা শিকার হচ্ছে নানা রকমের দুরারোগ্য ব্যাধিতে। কৃষকরা মুখে মাস্ক না পড়ে দমকা বাতাসের ভেতরে কীটনাশক স্প্রে করে যাচ্ছে ফসলের ক্ষেতে। যার কারণে কীটনাশক তার নাক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। আবার দেখা যাচ্ছে জমিতে কীটনাশক স্প্রে করার নির্দিষ্ট দিন পরে বাজারজাত করা হয়।
কিন্তু কৃষকের অজ্ঞতার কারণে কীটনাশক প্রয়োগের কয়েকদিন পরই তা বাজারজাত করার কারণে সেই বিষক্রিয়ার শিকার হয় ক্রেতা সাধারণ। এর ফলে শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধী ক্যান্সারের মত দুষ্টু ক্ষত।
ফসল ক্ষেতের পোকা-মাকড় প্রাকৃতিকভাবে দমন করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহার করতে হবে জৈব সার। তাতে কৃষকের যেমন অর্থের সাশ্রয় হবে তেমনি পরিবেশ ও মানুষ রক্ষা পাবে ক্ষতিকর কীটনাশকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে।
তারপরও ফসলি জমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১. অর্গানোক্লোরিন জাতীয় কীটনাশক (ডিডিটি, ক্লোরডেন, ডাই-এলড্রিন, হেপ্টাক্লোর, এনড্রিন, এলড্রিন ইত্যাদি) মাছসহ মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিধায় কোন অবস্থাতেই উপরোক্ত কীটনাশকসমূহ ব্যবহার করা উচিত নয়। এ বিষয়ে নজরদারী জোরদার করতে হবে।
২. অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা হলে তা মাছ ও প্রাণীসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করবে। কীটনাশক ব্যবহার জরুরি হলে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৩. নীচু ধরনের জমিতে অর্গানোফসফেট জাতীয় কীটনাশক যেমন- ডায়াজিনন, বাসুডিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
৪. পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক কখনোই ধান জাতীয় ফসলে ব্যবহার করা যাবে না। শুধুমাত্র উঁচু জমির ফসলের (শাক-সবজি, চা, তামাক ইত্যাদি) রোগ-বালাই দমনের জন্য এ জাতীয় কীটনাশকের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৫. বর্ষা মৌসুমে কীটনাশক ব্যবহারে অধিক সচেতন হতে হবে। মেঘলা দিনে বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় কখনোই কীটনাশক প্রয়োগ করা
উচিৎ নয়।
৬. স্প্রে মেশিন, কীটনাশকের পাত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি কোন অবস্থাতেই জলাশয়ে বা পুকুরের পানিতে ধোয়া উচিত নয়।
এ সকল যন্ত্রপাতি ধোয়ার জন্য জলাশয় বা পুকুরের পানি তুলে মাটির উপরে ধুতে হবে।
৭. সমন্বিত রোগ-বালাই দমন পদ্ধতিতে ধানক্ষেত বা ফসলের মাঠে কীট-পতঙ্গ দমন করতে হবে এবং যান্ত্রিক বা স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে কীট-পতঙ্গ দমনের চেষ্টা চালাতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ব্যতিরেকে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা ঠিক না।
৮. ফসলের ক্ষেতের রোগ-বালাই দমনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) কার্যক্রমকে আরো জোরদার করতে হবে।
কীটনাশকের সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবে এ পরিবেশে সুদীর্ঘ সময় বসবাসরত মাছ ও অন্যান্য জলজ জীব ক্রমান্বয়ে তার প্রজনন ও রোগ-বালাই প্রতিরোধের ক্ষমতা হারায়, বৃদ্ধিরহার কমে গিয়ে উৎপাদন হ্রাস পায় এবং মানুষের খাদ্য হিসেবে এর গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
এ সকল কারণে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।