আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুসুম ও কীটনাশক

র্পব/২ খুব সকালে ছোট দাদি মকবুলকে খুঁজতে বের হয়। বাড়ির উত্তর দিকে মিয়াজানের ভিটায় আলুর জমিতে পানি দিচ্ছিল খইর আর মকবুল। অঘ্রাণের মাঝামাঝি। আদিগন্ত বি¯তৃত প্রান্তরে ধান কাটা এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু এবারে শীতটা এখনই বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে।

আলুর ক্ষেত জুড়ে লকলকে সবুজ পাতা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু এখনই পানি না পেলে আলুর সম্ভবনা শেষ। তাই কান মাথা গামছা দিয়ে ভালো করে বেঁধে ভোর হবার আগেই খ্যলশা গাড়িতে জাঁত নামিয়েছিল দ’ুজন। খইর জাঁতের এক প্রান্ত পা দিয়ে চেপে খ্যলশা গাড়ির পানিতে ডুবিয়ে পানি তুলে নালায় ঢেলে দেয়, মকবুল কোদাল হাতে আলু ক্ষেতের প্রান্তে প্রান্তে জলের ধারা পোঁছে দেয়ার জন্য কোদাল হাতে ছোটাছুটি করে। আলের সীমানায় দাঁড়িয়ে ছোট দাদি মকবুলের নাম ধরে ডাকে।

‘তোর আজই এ্যানা পাকুড়গাছা যাওয়া লাগবি বাবা। ’ মকবুল কোদাল ফেলে এগিয়ে আসে। ‘কি হচে চাচি- এ্যাতো জরুলী কিসক?’ ‘তোর জোনাব চাচার সাইকেল কোনা লিয়া কুসুমক অর নানির অটি এ্যানা থ্যুয়া আয় বাপ। ছোল কোনা কাল রাতত দুই চোখের পাতা এ্যাক করেনি। ’ ‘ছোট ছোল মাওক ছাড়া তাই থ্যাকপা পারেÑ কিন্তুক চাচি দ্যাড় বিঘা জুমিত পানি সিঁচা আজ শ্যাষ করা লাগবি।

চাচা যুদি পুছ করে তে কি কমো হিনি?’ ‘সব কামই তোর চাচাক পুছ ক্যরা করা লাগবি! ক্যা হামার কথার কুনু দাম নাই?’ আসলেই কি তার কথার কোনো মূল্য ছিল এই সংসারে? এ প্রশ্নের উত্তর আর কখনোই জানা যাবেনা। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে গতানুগতিক যে দিনের সূচনা হতো প্রায়ই তার সমাপ্তি হতো গভীর রাতে। বৈদ্যুতিক আলোর অস্তিত্বহীন জ্বোনাকি জ্বলা একটি রাত কতো গভীর হলে একজন নিঃসন্তান মধ্য বয়সী নারীর কর্মব্যস্ত দিনের অবসান হয় তা হয়তো কেউই ভেবে দেখেনি। এমনকি কুসুমও নয়। রান্না বাড়া, সিদ্ধ শুকান, মাটির ঘর দুয়ার লেপা পোঁছাÑ এ সবই ছিল নিত্যদিনের কাজ।

প্রয়োজনের বাইরে নান্দনিক কাজ কর্মের তালিকা আরো দীর্ঘ। আটা কোটা, পিঠা বানানো, কাঁথা সেলাই অথবা রুমালে ফুল তোলার মতো শিল্পকর্ম অনেকটা অবসর যাপনের মতো। আর ভালোবাসার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলেন পালিত পুত্রের ছেলে মেয়ে বিশেষ করে করে কুসুমের জন্যে। যার জন্যে এতো আয়োজন সেই কুসুমই শেষ পর্যন্ত পাকুড়গাছায় যেতে রাজি হয়না। জোনাব আলীর সাইকেলের রডে কাঁথা কাপড় পেঁচিয়ে গদির ব্যবস্থা করেছিল মকবুল।

শুধু সাইকেলে চড়ার আনন্দে তাঁতী পাড়ার ভেতর দিয়ে চন্দ্র সূর্যের দোকান পর্যন্ত একটা চক্কর দিয়ে ফিরে আসে। এরপর একদিন... দুইদিন... তিনদিন... করে পনের দিন নির্বিঘেœই কেটে যায়। পাকুড় গাছা থেকে ভালো মন্দ কোনো খবরই আসেনা। নাতনিকে সঙ্গে করে নিয়ে না আসায় দিয়ানত আলী খন্দকার প্রথমে একটু অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন। নিজের মেয়েকে তিনি কোথায় কোন পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলেন তাতো তার অজানা থাকার কথা নয়।

মেয়ের শ্বশুর বাড়ির আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা দিক্ষা অথবা সেখানে মেয়ের আদর যতেœর কোনো ত্র“টি হচ্ছে কিনা এসবের চেয়েও তার বড় ভাবনা বোধহয় ছিল বাড়ির পূর্বাপর ইতিহাস নিয়ে। মুন্সী বাড়ির প্রধান পুরুষ আলহাজ্জ আব্দুল বাসেত মুন্সী এক এক করে তিনটি দার পরিগ্রহ করেছিলেন। প্রায় পাঁচ ছ বছরের বিবাহিত জীবনে নিঃসন্তান প্রথমা স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর সন্তান লাভের আশায় দ্বিতীয় বার এবং আরো বছর পাঁচেক পর হাজি সাহেব যখন তৃতীয় বার বিয়ে করেন ততোদিনে সকলেই মোটামুটি নিশ্চিত অক্ষমতার দায় ভার তার স্ত্রীদের কারো নয়। আব্দুর রহমান মুন্সী পালিত পুত্র হলেও সেই একই পরিবারের মানুষ, একই পরিবেশে একই শিক্ষা রুচি ও অভ্যাসের ধারাবাহিকতা যদি তার মধ্যেও কাজ করে তাহলে যে কোনো অজুহাতে... আর ভাবতে পারেন না দিয়ানত আলী। পাশের ঘরে কার যেনো বাচ্চা কেঁদে ওঠে।

অনেকক্ষণ ধরে একটানা কাঁদতেই থাকে। মা’টা বোধহয় অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় প্রথমে বুঝতেই পারেনা কোথায় কার বাচ্চা কাঁদছে। গভীর রাতের নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শিশুর কান্না কুসুমের ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়। ঘরের অন্ধকার কেটে যাবার মতো ধীরে ধীরে মনে পড়ে গতকাল আশুগঞ্জ থেকে ভাশুরের মেয়ে পুতুল এসেছে তার ছেলেকে ডিপিটি পোলিও দেওয়াবার জন্যে।

জামাই আশুগঞ্জে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজারে কাজ করে। খুব উপরের দিকে না হলেও বয়স অনুপাতে তার অবস্থান এমন কিছু খারাপ না । আজকাল রোগ প্রতিষেধক টিকা ইঞ্জেকশান যেকোনো জায়গায় দেয়া যায়। তারপরেও যেকোনো ছোট খাট অসুখ বিসুখে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওরা চলে আসে। বাচ্চার কান্না ক্রমেই বাড়তে থাকে... এবারে বিরক্ত হয় কুসুম।

বিছানা ছেড়ে উঠে আধো অন্ধকারে বাতি না জ্বালিয়ে ডাইনিং স্পেস পার হয়ে বাঁ দিকের বেডরুমের দরজায় টোকা দেয়। নাম ধরেও ডাকে দু’বার। পুতুলের জেগে উঠবার সাড়া পেয়ে কুসুম যখন বিছানায় ফিরে আসে ততোক্ষণে বাচ্চাটাও থেমে গেছে। তিন বেড ড্রইং ডাইনিং গোটা তিনেক ব্যালকনি আর ছাদ মিলিয়ে বেশ বড় সড় বাড়িতেও মাঝেমধ্যেই সাকুল্যে পাঁচজন মানুষের জায়গা হয়না। আজীবন একটা সার্বক্ষণিক অতিথিশালায় নিজের ঘর খুঁজে খুঁজে বেঁচে থাকা।

নিজের বাড়িতে এই উদ্বাস্তু জীবনের সূত্রপাত যে রাজধানীতে আসবার পরে হয়েছে তা নয়। তালসোনের সীমাহীন প্রান্তর পেছনে ফেলে এসে মফস্বল শহরে যখন দেড় খানা ঘরের অপরিচিত এক জগতে নতুন করে প্রবেশ করেছিল, প্রায় তখন থেকেই সংখ্যাতীত অতিথি-অভ্যাগত, আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত জীবন যাপনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে এমন অবস্থাও হয়েছে উপরে নিচে নানা বয়সের ছেলে মেয়েরা একত্রে গাদাগাদি করে শুয়েও সবার স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। আর মেঝেতে বিছানা করে শোয়া বা ঘরে ঘরে অস্থায়ী কাঁথা বালিশ মশারির ব্যবস্থাতো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এখনো নিজস্ব কোনো ঘর নেইÑ ঘরের মধ্যেও ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই।

এমন অবস্থায় সম্পূর্ণ একা থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। তারপরেও কেমন করে যেনো সবার সঙ্গে সবার ভেতরে থেকেও মাঝে মাঝে একা হয়ে যায় কুসুম । রাত ভোর হতে বেশী দেরী নেই। তবুও শেষরাতে হয়তো খানিটা ঘুমানো যেতে পারে ভেবে চাদরে মুখ ঢেকে আবার শুয়ে পড়ে। লেপের ভেতরে মুখ ঢেকে ঘুমাবার পুরোনো অভ্যাসটা এখনো থেকেই গেছে।

ঢাকায় আজকাল আর তেমন শীত পড়েনা বলে কোনো কোনো বছর লেপ বের করার প্রয়োজনই হয়না। এখন পৌষের শুরুতে দিব্যি একটা চাদর বা কাঁথাতেই চলে যাচ্ছে। শীত পড়লে লেপের তলায় শুয়েও দেখেছে কুসুম। উষ্ণতা আগের মতোই আছে শুধু বুনো ফুলের সেই অচেনা সৌরভ আর কখনোই খুঁজে পায়না। ‘কাতার সোজা করে দাঁড়ান... ভাইসব কাতার সোজা করে দাঁড়ান... মরহুমের নামাজে জানাজা এখনি শুরু হবে...’ জানাজার নামাজের জন্যে কি আজান দিতে হয়! কাছাকাছি কোনো মসজিদ নেই তবু ভোরের আজান ঠিকই ভেসে আসছে।

একজন মৃত মানুষÑ নারী অথবা পুরুষ কিম্বা শিশুর পারলৌকিক মুক্তির জন্য কাতার সোজা করে দাঁড়ানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ কেউই জানেনা। ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা গ্রামের অপরিসর কবরস্তানের অসমান জমিতে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো খুব সহজ সাধ্য ব্যাপার নয়। তারপরেও একজন মধ্যবয়সী লোক নামাজ শুরু হয়ে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। লোকটিকে গ্রামের কেউ বলে মনে হয়না। পরিবেশের মধ্যে বেমানান লোকটি বুনো ঝোপঝাড় আর কাঁটা গুল্মে ভরা উঁচু নীচু জায়গার মাটি সমান করে জানাজায় সমবেত লোকদের সোজা হয়ে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

মেয়েদের কবরস্তানে প্রবেশের নিয়ম নেই তাই কুসুম লোকটির চেহারা ভালো করে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলেও এতোদিন মনে থাকার কথা নয়। সত্যি সত্যিই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন কুসুমের মা জাহানারা খাতুন। খবরটা এসে পৌঁছবার পর পাকুড় গাছায় যাবার মতো কেউই বাড়িতে ছিলনা। বাবা আব্দুর রহমান মুন্সী কি একটা কাজে বগুড়ায় গিয়েছিলেন দিন তিনেক আগে।

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দু’চার দিন জেলা সদরে তার রাত কাটাতে হতো। মাঝে মাঝে পুরো সপ্তাহ অথবা একটানা দশদিনও থাকতে হতো। কাজেই বাবা কবে ফিরবেন সে ব্যাপারে সঠিক কেউই জানতোনা। এদিকে খবর পাবার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছিল কুসুম। অনেকদিন ধৈর্য্য ধরে থাকতে থাকতে মায়ের কথা যখন প্রায় ভুলতে বসেছিল, সেই সময় তার নিজের ছোট্ট একটা ভাই পাবার মতো অকল্পনীয় সংবাদে আনন্দ বিস্ময়ে অভিভূত কুসুমের আর অতিরিক্ত দেরী সহ্য হচ্ছিলোনা।

কখন ছোট ভাইটাকে দেখতে যাওয়া হবে জানতে চেয়ে ছোট দাদিকেও সে অস্থির করে ফেলেছিল। পাকুড়গাছা থেকে খবরটা নিয়ে এসেছিল কুসুমের বড় মামার শালা সাইফুল। সাইকেলটা তালোড়া স্টেশনের কাছে পরিচিত কোনো দোকানে রেখে সেই দিনই সাড়ে বারোটার ট্রেনে তার রাজশাহী চলে যাবার কথা। তা না হলে ওর সাথেও কুসুমকে পাঠানো যেতো। ছোট দাদি আবারো পাড়ায় খুঁজতে বেরিয়েছিলেন।

আকালু মকবুল অথবা জোনাব আলীÑ যাকে পাওয়া যায়। আকালু ভোর থাকতেই ধানের গাড়ি নিয়ে ধাপের হাটে রওনা হয়ে গেছে। মকবুলকে পাওয়া গেল কিন্তু জোনাব আলী বা তার সাইকেলÑ কাউকেই পাওয়া গেলনা। সে সকালেই কলেজে চলে গেছে। অগত্যা একদল হাটুরের সাথে মকবুল আর কুসুম বেশ বেলা করেই পাকুড় গাছায় রওনা দিয়েছিল।

উৎসাহের আতিশয্যে প্রথমে হাঁটতে শুরু করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতিয়ে পড়েছিল কুসুম। পরীর মতো একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিতে কারোরই আপত্তি ছিলনা। কিছুটা পথ পায়ে হাঁটার পর নানা কিসিমের মালপত্র বোঝাই পথ চলতি গরুর গাড়িতে দুপচাঁচিয়া পর্যšত ভালোই যাওয়া গেল। বাকি রাস্তার বেশীর ভাগ মকবুলের কাঁধে চেপে কুসুম যখন পাকুড় গাছায় এসে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা হতে দেরী নেই। পরবর্তী পর্ব: আগামী শুক্রবার ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।