মুনতাজা আল-জাইদিঃ আমি কেন জুতা নিক্ষেপ করেছিলাম?
(Why I threw the shoe)
আমি এখন মুক্ত। কিন্তু আমার স্বদেশ আজও যুদ্ধ বন্দী। ইতিমধ্যে, সেই ঘটনা ও ঘটনা সংগঠনকারী; সেই বীর ও তার বীরত্ব কিংবা সেই প্রতীকি কর্ম নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু আমি সোজা ভাষায় উত্তর দিতে চাই , আমার জনগণ যে অবিচারের শিকার এবং দখলদার বাহিনী যে ভাবে তার বুটের নিচের আমার বাসভূমিকে পদানত করে অপদস্ত করছে, তাই আমাকে 'সেই ঘটনা' ঘটাতে প্ররোচিত করেছে।
সাম্প্রতি বছরগুলোতে ,দশ লক্ষেরও বেশি শহীদ দখলদার বাহিনীর ঘাতক বুলেটের খোরাক হযেছে।
এখন ইরাক পঞ্চাশ লক্ষ অনাথ, দশ লক্ষ বিধবা আর হাজার হাজার বিকলাঙ্গ মানুষের বাসভূমি। লক্ষ- লক্ষ গৃহহীন নর-নারী দেশের ভিতরে বাহিরে অসহায় জীবনযাপন করছে।
আমরা এমন এক দেশে বাস করতাম যেখানে প্রতিদিন একজন আবর অপরাপর তুর্কি-কুর্দি -আসেরিয়ান-সাবিনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিত। শিয়ারা সুন্নীদের সাথে এক কাতারের নামাজ আদায় করতো। মুসলমানরা যীশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালনে খ্রিস্টানদের সাথে সমভাবে সামিল হত।
সবচেয়ে বড় সত্য এই যে, দশক ব্যাপি সেই অর্থনৈতিক অবরোধের কালে আমরা একত্রে পারস্পরিক সহমর্মিতায় ক্ষুধার যন্ত্রণা সাথে লড়াই করেছিলাম।
আমাদের ধৈর্য্য এবং আমাদের একতা সেই নিপীড়ণ কে বিস্মৃত হতে দেয়নি । কিন্তু, আজ অবৈধ্য অনুপ্রবেশকারীরা ভাই থেকে ভাই কে বিছিন্ন করে দিয়েছে , প্রতিবেশীর কাছ থেকে প্রতিবেশীকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
আমি কোন বীর নই। কিন্তু আমি একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি লালন করি এবং তা চর্চা করি।
যখন আমি আমার দেশকে লাঞ্ছিত হতে দেখি , যখন দেখি আমার বাগদাদ নগর ভস্মিভূত হচ্ছে , আমার জনগণ কে হত্যা করা হচ্ছে ; আমি তখন সমভাবে লাঞ্ছিত হই। শত সহস্র নির্মমতার চিত্র প্রতিনিয়ত আমার মাথায় ঘুরে বেড়ায় এবং আমার অন্তরকে প্রত্যাঘাতের জন্য ধাক্কা দেয়। আমাকে প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে ফেরে : আবু-গারিবার ন্যাক্কারজনক কাহিনী; ফালুজা-নাফাজ-হাদিথা-সাদর সিটি-বসরা -দাইয়ালা-মৌসুর সহ আমার লাঞ্ছিত স্বদেশের প্রতিটি ইঞ্চিতে ঘটে যাওয়া বর্বর ধ্বংস যজ্ঞ । আমি আমার দগ্ধ স্বদেশভূমির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি । আমি স্বচক্ষে দেখেছি নির্যাতিত মানুষের বেদনায় নীল মুখ।
আমি নিজ কানে শুনেছি অনাথ শিশুদের আত্মচিৎকার আর সজ্জন হারাদের আহাজারী। আমরা ক্ষমতাহীন কাপুরুষতা জন্র বিবেক আমাকে প্রতি মুহুর্তে দংশন করেছে।
যখন আমি আমার পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে দৈন্দিন নির্মম ধ্বংস যজ্ঞের কাহিনীর উপর রিপোর্ট সম্পন্ন করেছি কিংবা কোন ইরাকীর বিধ্বস্ত গৃহের ধ্বংসাবশেষ পরিস্কার করেছি অথবা আমার পোশাকে ল্যেপ্টে থাকা রক্তরের দাগ ধুয়ে ফেলবার চেষ্ট করেছি; প্রতিবারই আমার অন্তরে এক যন্ত্রনা অনুভব করেছি এবং মনে মনে আমার নির্যাতিত জনগণের প্রতি প্রতিজ্ঞা করেছি , প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা।
সুযোগ এসে গেল এবং আমি তা গ্রহণ করলাম।
আমার এই সুযোগের গ্রহন নিবেদিত : প্রতি ফোঁটা নিরপরাধ রক্ত বিন্দুর প্রতি যা দখলদারদের কর্তৃক বা তাদের কারণে ঝরেছে; এটা নিবেদিত সন্তানহারা প্রতিটি মায়ের আত্মচিৎকারের প্রতি; প্রতিটি অনাথ শিশুর নীবর কান্না প্রতি, প্রতিটি ধর্ষিতা বোনের যন্ত্রণার প্রতি, অনাথের প্রতি বিন্দু অশ্রুর প্রতি।
যারা আমার কৃতকর্মের সমালোচনা করেন, তাদের প্রতি আমি বলতে চাই,'' আপনারা কি জানেন আমি যে 'জুতা' নিক্ষেপ করেছিলাম তা কত বিধ্বস্ত বাড়িতে প্রবেশ করেছে? এটা কত সহস্র বার নিরাপরাধ নিপিড়ীত মানুষের বুক থেকে ঝরে পরা রক্ত মারিয়ে গিযেছে? '' যখন সকল মূল্যবোধ এই ভাবে লঙ্ঘিত তখন মনে হয় 'সেই জুতা'ই হতে পারে একমাত্র যোগ্য জবাব।
আমি যখন' জর্জ বুশ' নামক কালপিট টার মুখে জুতা নিক্ষেপ করেছি, তখন আমি তার সকল মিথ্যচার আর আমার দেশে তার দখলদারীত্ব কে প্রত্যাখান করতে চেয়েছি। প্রত্যাখান করেছি আমার জনগণের উপর তার হত্যাযজ্ঞ। এটা আমার মাতৃভূমির সম্পদ লুন্ঠন , সকল অবকাঠামো ধ্বংস আর দেশের সন্তানদের নির্মম ভাবে মৃত্যুকূপে নিক্ষেপে তার ভুমিকার প্রতি আমার প্রতিবাদ।
এক জন সাংবাদিক হিসাবে আমি যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে সাংবাদিকতার পেশাদারীত্বের প্রচলিত দর্শণ কে বিব্রতকর অবস্থার সন্মুখীন করে থাকি , তবে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার কৃত কাজের মধ্য দিয়ে আমি একজন নাগরিকের 'জাগ্রত অনুভুতি কে প্রকাশ করতে চেয়েছি , যে প্রতি দিন অবলোকণ করছে কিভাবে তার পবিত্র স্বদেশভূমি ধ্বংসের স্তুপে পরিণত হচ্ছে। নির্মম দখলদারীতের মাঝে পেশাগত নৈতিকতার প্র্রশ্ন দেশ্রপ্রেমিকের কন্ঠ স্বরের চেয়ে কখনও জোড়াল হতে পারে না। এবং যে ক্ষেত্র স্বদেশ প্রেম বলিষ্ঠতার দাবী রাখে , সে ক্ষেত্র পেশাগত দায় বোধ তার পরিপূরক হওয়া উচিৎ।
ইতিহাসে আমার নাম স্থান করে নিবে কিংবা আমি বস্তুগত ভাবে লাভোবান হব এই রূপ কোন প্রত্যাশা থেকে এ ঘটনা ঘটাই নি। আমি শুধু মাত্র আমাদের দেশে পক্ষে দাড়াতে চেযেছি।
*************************************************
আমি কেন মুনতাজা আল-জাইদির কলাম অনুবাদের প্রয়োজন অনুভব করলাম?
গত ১৭ সেপ্টেম্ব ২০০৯ সদ্য কারামুক্ত ইরাকের অকুতোভয় সাংবদিক মুনতাজা আল-জাইদির Why I threw the shoe শীর্ষক কলাম টি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক guardian.co.uk এ প্রকাশিত হয়, আমি লেখা টির ভাবানুবাদ করে পাঠকের নিকট পেশ করলাম।
যে মানুষটি বদলতে মুনতাজা আল-জাইদির এই কলামটি আমার নজরে আসেন , তিনি হচ্ছেন Victor Agosto.
প্রাসঙ্গিক ভাবেই Victor Agosto সম্পর্ক কে কিছু কথা বলা জরুরী । তিনি দখলদার মার্কিন বাহিনীর আই টি স্পেশিয়ালিস্ট হিসাবে ইরাকে নভেম্বর ২০০৭ পর্যন্ত ১৩ মাস কর্মরত ছিলেন এবং তাঁকে ২০০৯ সালে আবার আফগান রণাঙ্গণে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করেন ,"There is no way I will deploy to Afghanistan. The occupation is immoral and unjust. It does not make the American people any safer. It has the opposite effect." (..................)
''I will not obey any orders I deem to be immoral or illegal."
Victor Agosto এখন আমেরিকার যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং তিনি একটি ফেইসবুক গ্রুপ পরিচালনা করেন ; যেখান আমি মুনতাজা আল-জাইদির Why I threw the shoe শীর্ষক কলাম টি পড়বার সুযোগ পেয়েছি।
মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক।
মুনতাজা আল-জাইদির তাঁর আলোচ্য কলামে পেশাগত নৈতিকতা আর স্বদেশের প্রতি দায়িত্ব বোধের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক কে সামনে নিযে এসেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুনতাজা আল-জাইদির দেশপ্রেমমুলক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে আমরা যারা নানা পেশায় নিষ্ঠার সাথে কর্তব্যরত তারা অনেক সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে পেশাগত নৈতিকতার রক্ষা নামে দেশ ও জাতির প্রতি দায় বোধ কিংবা মানবিক বিচার শক্তি কে জলাঞ্জলি দিয়ে বসি।
আজ ইরাকের মত বাংলাদেশের প্রতিও সাম্রাজ্যবাদের নখর থাবা বন্ধুবেশে অগ্রসর । আমাদের দেশোর রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস সেক্টরের কর্মরতরা অনেকেই আমাদের দেশের সম্পদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ দৃষ্টি সম্পর্কে সম্পূণ রূপে অবগত ( আমজনতার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে)। কিন্তু পেশাগত নৈতিকতার ( Professional Commitment ) রক্ষার প্রশ্নে, তারা জাতিয় বিপর্যয় কালেও নিরব কিংবা পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদের লুন্ঠন প্রক্রিয়া কে সহায়তা করে যাচ্ছেন ।
তাদের প্রতি আমি মুনতাজা আল-জাইদির Why I threw the shoe শীর্ষক কলাম শেষাংশ থেকে আবার উদ্বৃত করতে চাই ,
''The professionalism mourned by some under the auspices of the occupation should not have a voice louder than the voice of patriotism. And if patriotism needs to speak out, then professionalism should be allied with it.''
তাই আসুন আমরা সবাই Victor Agosto মত দৃঢ় কন্ঠে বলি,
''I will not obey any orders I deem to be immoral or illegal."
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।