আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেলিব্রিটি সিনড্রোম



কেউ হয়তো মাথা ন্যাড়া করে ফেললেন, যেমন ব্রিটনি স্পিয়ার্স। কেউবা ড্যানিয়েল রেডক্লিফের মত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন প্লেবয় মডেলের সাথে, প্লেবয় হিসেবেই। কেউ হয়তো নিজের একান্ত ভিডিও ছেড়ে দিলেন ইন্টারনেটে। স্টেফানি রাইসের মত কেউ নাইটক্লাবে নেচে অথবা ফেসবুকে ছবি দিয়ে খবরে, পল গ্যাসকোয়েনের মত কেউ আবার গার্লফ্রেন্ডকে পিটিয়ে প্রথম পাতায়। মাইকেল জ্যাকসন আবার নিজের চেহারাটাই বারবার প্লাস্টিক সার্জারি করে খবর হয়েছেন, আবার জিম মরিসনের মত কেউ কেউ মাদকের ঘোরে হারিয়ে গিয়েছেন অকালে।

এমনকি হালের ক্রেজ মাইলি সাইরাসও নিজের এমন ছবি তুলে নেটে ছেড়ে দিয়েছেন, অন্য যে কেউ হলে এফবিআই নিশ্চিতভাবেই চাইল্ড পর্নোগ্রাফির জন্য গ্রেফ্তার আর মামলা করে দিত। না, পাপারাজ্জিদের কথা হচ্ছে না, হচ্ছে সেলিব্রিটিদের কথাই। যেখানে পাপারাজ্জিরা জড়িত নয়, সেখানে নিজেরাই বিচিত্র উদ্ভট সব কাজকর্ম করে খবরে চলে আসেন তারা। ভালভাবে হোক, খারাপভাবে হোক, নিজেকে স্পটলাইটের নিচে রাখা চাই-ই, চাই নিজেকে আলাদা করে রাখা। ঠিক কি কারণে এ ধরণের আচরণ? শুধু হলিউডের সেলিব্রিটিরাই নয়, এমন উদ্ভট কাজকারবার সব দেশের সেলিব্রিটির জন্যই সাধারণ ব্যাপার।

যে লোকটা ক'দিন আগেও ছিল খুব সাধারণ, সেলিব্রিটি হয়েই হঠাৎ করে বদলাতে থাকে তার আচরণ। মনে আছে হয়তো সবার, প্রথম ক্লোজআপ ওয়ানে যারা টপ টেনে ছিল, তাদের অনেকেই যতটা না গানের জন্য খবর হয়েছেন, দুর্ব্যবহার, অনিয়ম, সময়মত কাজ না করা, রাস্তায় লোকজনকে পেটানো, এমনকি একজন গাঁজা খাওয়ার জন্যও খবর হয়েছিলেন। এককালের অতি বিনয়ী আশরাফুল এক সমর্থককে চড় দিয়ে খবর হলেন, এদিকে মাশরাফি আরেক সমর্থককে বলে বসলেন যে তাদের খেলা দেখতে আসতে তো কেউ জোর করেনি, আসে কেন? বললে আসলে শেষ হবে না, কারণ স্ক্যান্ডাল নেই এমন সেলিব্রিটি খুঁজে পাওয়া মোটামুটি অসম্ভব, আর নোংরা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, সেটার জন্য "সান" বা "ডেইলি মিরর" অথবা এই দেশের পত্রিকাগুলোর সিনেমা পাতার সাংবাদিকরা সদা তৎপর। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে অবশ্য, শুধুমাত্র নোংরা ঘাঁটাঘাটি করাই কিভাবে কিছু লোকের পেশা হতে পারে, পরে মনে হয়, দুনিয়াতে শকুনের অভাব নেই, ক'টা বাড়লে আর এমন কি? আসলে যেটা নিয়ে বলতে চাইছিলাম, কেন এমন করে সবাই? এটা কি রোগ? নাকি সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমাদের জিনের মাঝে আমরা এটা বহন করি? ঠিক যেমন অন্ধকারের ভয়, তেমনই কি এই "সেলিব্রিটি সিন্ড্রোম"? হতে পারে, যদিও সেটা নিয়ে আমার কাছে কোন তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে এটা বেশ জানি, নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা প্রমাণ করতে, বিশেষ কিছু একটা হয়ে উঠতে আমাদের চেষ্টার শেষ নেই।

কাউকে বলে দেখুন, আরে তোমাকে একদম অন্যরকম মনে হয় আমার, খুশি না হয়েই যাবে না। ভেবেও দেখবে না, আসলেই সে কতটা অন্যরকম। আর এই অন্যরকম হতে কতরকম প্রয়াস। কেউ চুল স্ট্রেইট করে ফেললো, কেউ কোঁকড়া করে ফেললো। কেউ পিন হাই হিল পরলো তো কেউ ঢাউস সাইজের বুট।

ও যদি লম্বা জামা দিয়ে ফ্যাশান করে তো আমাকে শরীর না দেখালেই চলছে না। অমুকের কানে ২টা ফুটো, আমাকে তো ৫টা করতেই হবে, পরে ফুটো বন্ধ করার দরকার হলে কি হবে সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। শুধু যে সাজপোশাক দিয়েই নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা সেটা না, আছে নিত্যব্যবহার্য বস্তুতেও। সেলফোন জিনিসটা কথা বলার জন্যই, কাজেই শব্দ আসবে-যাবে ওটুকুই যথেষ্ট হবার কথা, কিন্তু আলাদা দেখাতে হবে না? কাজেই ঢালো টাকা, ধার করে হলেও কেনো লেটেস্ট মডেল। এন-৯৫ থাকলে কিনে দাও পোলাপানকে এন-৯৭, পাশের বাসার সাহেবের কন্যার এন-৯৫ আছে, আমারটা তাহলে আলাদা হবে কিভাবে? আবার সেই জিনিস দেখানোও চাই, কাজেই পকেটে জায়গা থাকলেও সেলফোন খানা ধরে রাখো হাতে আর রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়েও কানে গুঁজে রাখো হেডফোন, তাতে গাড়িচাপা পড়লাম নাকি আমাকে রামছাগলের ছোট পোনার মত দেখালো পরোয়া নেই।

যার গাড়ি আছে তার আবার অন্য সমস্যা, ১০ জনের টয়োটা করোলা থাকলে আমার লাগবে বিএমডব্লিউ, ওর ড্যাডি মার্সিডিজ কিনলে আমার ফেরারি লাগবেই। কাজের মাঝে কাজ হলো, আরো কিছু কালো টাকার এদিক ওদিক, সেই ধাক্কাটা অবশ্যই সামলানো হবে কারখানার শ্রমিকদের বেতন আটকে দিয়ে। লেখালেখির জগতের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাই বরং। এ বাবদে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি হুমায়ুন আহমেদ, যিনি কিনা তালে ঠিক হলেও নিজেকে জাতে মাতাল হিসেবে প্রমাণ করতে উৎসুক। নিভৃতচারী হিসেবে নিজেকে দাবী করেও বুড়ো বয়সে বিয়ে করে সর্বদাই আছেন প্রচারের আলোতে, আর তাতেও বুড়ো ভামের মন ভরেনি, গত বছর দুয়েক হলো বইমেলাতে একদল পাঁঠাকে হলুদ পাণ্ঞ্জাবী পরিয়ে তাদের সাথে মিছিল করে মেলায় হাজির হয়ে নিজেকে আস্ত ভাঁড় প্রমাণ করে হলেও খবরের শীর্ষে থেকে যাচ্ছেন।

আধুনিক লিটল ম্যাগ পার্টির প্রায় সবাই নিজেকে ভাবেন অনন্য, সেরকম উত্তরাধুনিক সব লেখা আর তার দক্ষিণাধুনিক সব বিশ্লেষণ যেগুলো তারা ছাড়া আর কেউ বোঝেন না এবং একে অপরের পিঠ চুলকে এই না বোঝার দলে তারাই যে বাংলা সাহিত্যে পরবর্তী নোবেলটা নিয়ে আসতে যাচ্ছেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে নেন। শুধু লেখা দিয়ে অনন্য হতে চাইলে সমস্যা ছিল না, কিন্তু আজিজ মার্কেটে গেলে জটাচুলধারী গামছা-তসর-খাদি-ঝোলা-ফ্যাশানের ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবি এবং বুদ্ধিজীবিনীদের দেখলে মাঝে মাঝেই নিজের মানবজন্মের প্রতি উদাসই হয়ে যাই, কিছুই হলোনা এ জীবনে, খানিক ভাব ধরলেও তো গতি হতো। মোটকথা, সেলিব্রিটিদের দোষ দিয়ে বিশেষ লাভ নেই, কে না চায় সেলিব্রিটি হতে? এই ব্লগেই দেখুন না, আমাদের পোস্ট যাতে লোকে পড়ে তার জন্য চেষ্টার কোন কমতি নেই। নাফে এনাম তার হরর পত্রিকার বিজ্ঞাপন দিয়ে, কবিকূল একের পর এক কাব্য প্রসব করে, নূরে আলম তার ভাঁড়ামি দিয়ে, আবার ফিউশন ফাইভ তার চামচামি দিয়ে হলেও নজরে থাকতে চান। যখন সামহোয়্যারে সর্বোচ্চ ব্লগার বলে একটা তালিকা ছিল, আলী নামের এক ব্লগার একের পর এক কপি-পেস্ট করে যেতেন শুধু সেখানে নিজের নামটা দেখানোর জন্য, অন্যের বিরক্তি এলো কিনা সেদিকে খেয়াল না করেই।

রাস্তায় টিভি ক্যামেরাটার সামনে একবার মুখ দেখানোর জন্য আমাদের কি প্রাণপণ প্রচেষ্টা, এমনকি স্টেডিয়ামে গিয়ে আফ্রিদি ম্যারি মি বলে লোকের সামনে আলাদা হতেও এই বঙ্গললনাদেরও আপত্তি নেই। লাল ঝাণ্ডার লোকে আলাদা হতে চায় নিজেকে গরীবের বন্ধু বলে, যদিও সুযোগ পেলে তাদের অনেকেই যে নীল ঝাণ্ডার তলে চলে যাবেন, প্রথম আলোর মতিউর রহমান আর বুয়েটের এককালের বামনেতা আনিসুল হকের চেয়ে জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আর কোথায় পাবেন? "যা কিছু ভালো তার সাথেই প্রথম আলো" স্লোগানধারীরা দেশ বদলের শপথের ভণ্ডামি দিয়ে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করেছে সন্দেহ নেই, আর সেই শপথে নিজেকে বদলে নিতে এই ব্লগেই স্বচ্ছতার স্লোগান তোলা সালাউদ্দিন শুভ্রর মত ব্যক্তিও আলু ব্লগের মডারেটর হয়ে অস্বচ্ছ কায়দায় পোস্টও মুছে যাচ্ছেন। আসলেই সেলিব্রিটি সিন্ড্রোম, ভণ্ডামি করে হলেও জাতে উঠে যদি আলাদা হওয়া যায় একটুখানি! হাজার হাজার বছরের এই অভ্যাস নিয়ে তাহলে আজই এত কথা কেন? কোন কারণ নেই, নাই কাজ তো খই ভাজও হতে পারে, হঠাৎ করেই আসলে মনে হলো। কেন মনে হলো সেটাও বিচিত্র, রোনালদো মাথা ন্যাড়া করলেন, মনিকা ক্লিনটনের সাথে কেলেংকারির খবর ফাঁস করে দু'পয়সা কামিয়ে নিলেন, এলিজাবেথ টেলর আটখানা বিয়ে করলেন, আর এতদিন পরে কেন এই হতভাগা আমজনতার পিছনে পড়লো তবে? আসলে হঠাৎই ভাবনা এলো যে আমরা হয়তো জাতিগতভাবে বাড়াবাড়ি সেলিব্রিটি সিন্ড্রোমে ভুগছি। আমরা খেতে পাই না পাই দামী একটা মোবাইল কিনবো, সরকারি চাকরি করে জনতার সেবার শপথ নিয়ে গুলশানে বাড়ি তুলবো, পাশের বাসার ভাবির থেকে নিজের বৌকে আলাদা করার জন্য তাকে হীরার সেট কিনে দেব।

ছোটলোকের বাচ্চার সাথে বাংলা মিডিয়ামে পড়াবো? অসম্ভব, আমার একটা ইজ্জত আছে না? মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতনের ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে মান-সম্মান কোথায় থাকে? দামী গাড়ি একটা থাকলে ৩টা কিনতে হবে, পুরনোটা পাল্টে নতুন নিতে হবে, সেলফোনের নবতম মডেলটা ছেলেকে দিতেই হবে, গার্লফ্রেন্ডও পুরনো মডেলের হয়ে গেলে নতুন মডেল বেছে নিতে হবে। ঝকঝকে গাড়ির পাশে চকচকে বান্ধবী না থাকলে ডিজুস জেনারেশনের ভাব কোথায়, লোকের মনে রাখতে হবে না আমার কথা? বাংলা ভাষাটা পুরনো হয়ে গেছে, এভাবে বললে কেউ আজকাল পাত্তা দেয় নাকি? র কে ড়, শ কে স, মূর্খ কিছু ডিজে আরজে'র সাথে তাল মিলিয়ে জগাখিচুড়ি বাংলিশ আর হাঁটুকাটা পেটকাটা রঙচঙে জিন্সের সাথে সেটওয়েট চুল, বগলে ক্যাপ্রি আর গ্লোসি লিপের হাইহিল গার্ল, ক্লাউন লাগুক আর যাই লাগুক, আমি কিন্তু আলাদা, বন্ধুমহলের সেলিব্রিটি। সেলিব্রিটি হবার নেশাতে ছাড় দিচ্ছি না আমাদের সন্তানদেরও, ভাবী জানেন বাচ্চাটাকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিলাম, এত পড়ার চাপ, বিকেলের আগে সময়ই পায় না, তাই সন্ধ্যার পরে গান শিখবে, আসছে বার ক্ষুদে গানরাজে কম্পিট করবে। দেখলেন না, ঐ যে, পাশের বাসার বাচ্চা, ওতো গতবার সেমিফাইনালে গেছিলো, আমার মেয়ে দেখবেন ফাইনালে যাবেই। ওহ, আমার ছেলেকে তো ক্রিকেট কোচিংয়ে দিলাম, একটু বড় হোক, সাকিব আর মাশরাফির চেয়েও বড় অলরাউন্ডার হবে।

তা হচ্ছে বটে, স্কুল-টিচার-গান-নাচ-অভিনয়-আবৃত্তি, সবকিছুতেই সেলিব্রিটি হতে হবে, কাজেই দরকারে বলি দাও শিশুর শৈশব কৈশোর, সেলিব্রিটি নিজে হতে না পারি, সেলিব্রিটির বাপ-মাও ছোটখাটো স্টার বটে। নতুন জেনারেশান ছুটছে, রাম্পে নয়তো বিলবোর্ডে মুখখানা তুলতে হবে, মুখ না তুলে শরীর তুললেও সমস্যা নেই, টিভি ক্যামেরা পেয়ে গেলে তো আরো ভাল। বুদ্ধিজীবিরা ছুটছেন টক শো'তে সেলিব্রিটি হতে, নেতারা ছুটছেন সংসদে সেলিব্রিটি হতে, আর নিদেন কিছু না পারি, অন্তত নিজের সানগ্লাস পরা টাইট টিশার্টে অথবা হট ছবিতে বুক দেখিয়ে ফেসবুক সেলিব্রিটি হতেই বা দোষ কি? নাহ, মানুষের ব্যক্তি অহমের বিরুদ্ধে এই লেখা নয়, কিন্তু গোটা জাতিটাই যখন সমষ্টির অহম ভুলে জাতিগত গর্ব ভুলে একে অন্যের পশ্চাতে, এমনকি কখনো নিজের পশ্চাতেই বাঁশ ঢুকিয়ে সেলিব্রিটি হবার নেশায় দৌড় শুরু করে, তখন কি একটুও ভাবার নেই? নাকি এটাও কোন অলস মনের সেলিব্রিটি হবার দুঃখ ভোলার আক্রোশের প্যাচাল? জবাবটা মনে হয়, এই অর্বাচীনের কীবোর্ডে দেয়ার চেয়ে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভাল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.