লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সেলিব্রিটি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
রাস্তার ধারে একজন মিঠাইওয়ালা মিঠাই বিক্রি করছে। গোলাপি রং দেয়া মিঠাই।
ছোটকালে কত খেয়েছি। পলিথিনের প্যাকেটে ভরে রাখা আছে ওগুলো, যাতে বাতাসে মিইয়ে না যায়। বাচ্চারা কিনছে, সাথে সাথেই পলিথিন ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। এত বড় একটা জিনিস, অথচ পুরোটা মুখে পুরলে এক মুঠোও হবে না হয়তো। মজাটাই আসল।
এক বাচ্চাকে তার বাবা কিনে দিলেন মিঠাই, ছেলেটা মিঠাই খেতে গিয়ে মুখের চারপাশে লাগিয়ে ফেললো। বিশাল মিঠাইটা তো আর একবারে মুখে পুরে দেয়া যায় না, কিন্তু তাই করতে গিয়ে বাচ্চা ছেলেটির এই অবস্থা।
কিছুদূরে একটা চার চাকার গাড়ি, স্থির। সেটার ওপর বড় বড় করে আনাড়ি হাতে লেখা আছে, "খাইবেন তো চাইবেন। " চটপটির ভ্রাম্যমাণ দোকান।
অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। কে জানে কত করে প্লেট। ধুলো, মাছি, সব পড়ছে চটপটির ওপর। তাতে কিছু এসে যায় না, কারণ এসব না থাকলে চটপটির আসল স্বাদ কখনোই পাওয়া যাবে না। "চটপটি মিক্স" বলে একটা বস্তু আছে, যেটা চুলোয় ছেড়ে দিলে সল্প সময়ে তৈরি হয়ে যায় চটপটি, কিন্তু সেটা রাস্তার চটপটির মতো মোটেই সুস্বাদু হবে না, যত কারিকুরিই করা হোক না কেন।
চটপটি প্রস্তুতির প্রথম শর্ত হচ্ছে তাতে ধুলোবালি পড়তে হবে।
কেউ কেউ অবশ্য চটপটি খাচ্ছে না, খাচ্ছে ফুচকা। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে যে ফুচকা ছাড়া এই পৃথিবীর আর সব কিছুই গৌণ। অনেকে খেতে খেতে "হুম", "উফ" জাতীয় শব্দ করছে। ফুচকার ঝাল বাড়াতে ঘুগনির মধ্যে কুচি কুচি করে কাটা কাঁচামরিচ দেয়া হয়, ঝালটাই স্বাদ।
ঝালের চোটে অনেকের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু তারপরও হাসতে হাসতে ফুচকা খাচ্ছে, বিরাট হাঁ করে মুখে চালান করছে আস্ত ফুচকা। মানুষ বড় বিচিত্র জীব, সে অনেক যন্ত্রণাও হাসতে হাসতে নিতে পারে, কারণ যন্ত্রণাটির সাথে মিশে থাকে আনন্দ।
আরও কিছুদূর এগোলে পড়ে একটা পার্ক। এখান থেকে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। লাল ইট দিয়ে তৈরি করা আছে নিচু দেয়াল।
তাতে বসে আড্ডা দিচ্ছে এক দল তরুণ। থেকে থেকে গলা ফাটিয়ে অট্টহাসি হাসছে। যে কেউ বলবে, এরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। একসাথে এতগুলো সুখী মানুষ পাওয়া সহজ হবার কথা নয়, কিন্তু আমি পেয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছে, এটা নিয়ে আলাপ করা আর কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করার মতো আনন্দময় আর কী আছে?
ফুটপাত ধরে হাঁটছে একজোড়া তরুণ আর তরুণী।
মেয়েটির পরনে রঙিন শাড়ি, ছেলেটির সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী। খুব সম্ভব তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, দেখেই ভাল লাগে। সব নবদম্পতি কিছুদিনের জন্য বোকা হয়ে যায়, তারা সবসময় একে অপরের সাথে লেপটে থাকতে চায়। তাই হাত ধরাধরি করে হাঁটে।
কে কী মনে করলো তাতে কিছু এসে যায় না।
আমি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো, দেরী হয়ে যাচ্ছে। "লোকেশনে" হাজির হতে হবে। মুখ ভার করে গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিলাম।
ড্রাইভারকে বললাম, চল।
গাড়ি এতক্ষণ খুব ধীরে চলছিল, এখন ড্রাইভার আমার আদেশ পেয়ে তীরবেগে গাড়ি ছোটাল।
আমার ইচ্ছে করে মুখ আর গালে মেখে বাচ্চাদের মতো হাওয়াই মিঠাই খেতে। ইচ্ছে করে রাস্তার ধারে নোংরা জায়গায় বসে চটপটি কিংবা ফুচকার প্লেট খালি করতে। সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় ঘুরতে, বেড়াতে, পছন্দের মানুষটির হাত ধরে হাঁটতে।
খোলা জায়গায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে। দরদাম করে, কানকো টিপে ইলিশ মাছ আর কচুরলতি কিনতে। বৃষ্টিতে খালি গায়ে রাস্তায় বের হয়ে ভিজতে, যতক্ষণ না বৃষ্টি থেমে যায়।
কিন্তু সেটার কোন উপায় আমার নেই। আমি একজন সেলিব্রিটি।
আমাকে চলতে হয় লুকিয়ে-চুরিয়ে, কারণ রাস্তায় সাধারণ বেশে বের হলে মানুষ আমাকে ছেঁকে ধরবে, অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য হামলে পড়বে, কেউ কেউ অতিরিক্ত আগ্রহে ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে আমার ওপর হুমড়ি খাবে। তাই আমাকে গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে, কড়া নিরাপত্তা প্রহরার মধ্যে চলাচল করতে হয়।
আজ দশ বছর ধরে এই চলছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাসা আর লোকেশন, লোকেশন আর বাসা। এক বিন্দু বিশ্রামের সময় নেই।
পরিশ্রমের ফল পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি। এখন আমার একাধিক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা, বিমানের বিজনেস ক্লাস ছাড়া চড়ি না। দেশের লোক আমাকে এক নামে চেনে, আমি প্রতিদিন কোন না কোন টক শো'তে ডাক পাই। শিডিউল ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হয়, কারণ আমাকেই সবাই পেতে চায়।
সবাই ভাবে আমি সফল, আমি "সব" পেয়েছি। পেয়েছি অনেক, তা সত্য। কিন্তু অর্থমূল্যে বিচার্য বস্তু দিয়েই সব বোঝা যায় না। সবাই আমার প্রাপ্তি দেখে, আমি কী হারিয়েছি, তা কেউ দেখে না বা বোঝার চেষ্টা করে না। এটাই নিয়ম, সবাই উপরের পালিশটাই দেখবে, ভেতরের ঘুণে খাওয়া কাঠ দেখবে না।
সবাই দেখবে সিনেমার পর্দায় অনেক নায়িকার সাথে প্রেম-ভালোবাসার দৃশ্য, দেখে হাততালি দেবে। কিন্তু কেউ দেখবে না, আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি সুখী হতে পারি নি। আমার স্ত্রীকে সময় দিতে পারি নি বলে সে আমার সন্তানকে নিয়ে চলে গেছে। কেউ এটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করবে না, শুধু মিডিয়ায় এটা নিয়ে খবর হবে, যেটা সবাই হাসতে হাসতে পড়বে এবং পরক্ষনেই ভুলে যাবে।
আমার মনে হয়, আমি যে "ব্যবসাটা" নিজের সাথে করেছি, সেটা মোটেও লাভজনক হয় নি।
আমি টাকা পেয়েছি, নাম, যশ, খ্যাতি, সব পেয়েছি, কিন্তু হারিয়েছি একটা সাধারণ জীবন।
বিভিন্নজনের আহ্বানে আমাকে নানারকম অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতে হয়। সবার সামনে আমার হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকতে হয়। আশা প্রকাশ করতে হয়, সবাই যেন আমার মতো হতে পারে। বিখ্যাত, ধনী, সফল।
কিন্তু সত্যি বলছি, যদি কোন বাচ্চা ছেলে আমার কাছে এসে, পর্দার আড়ালে আমাকে একাকী জিজ্ঞেস করতো, তাহলে আমি তাকে বলতাম, কখনো আমার মতো হতে চেয়ো না।
সবকিছুতে সাধারণ হবার মতো অসাধারণ আর কিছুই হয় না। খামোকাই মানুষ অসাধারণ হবার চেষ্টা করে। কেউ অসাধারণ হতে পারে না, হয়ে যায় "সেলিব্রিটি। "
I hope everybody could get rich and famous and will have everything they ever dreamed of, so they will know that it's not the answer.
--- Jim Carrey
(১৪ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।