আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাগুনে বারুদের গন্ধ

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
আবারো ফাগুন। আবারো বাতাসে বারুদের গন্ধ। আবারো রক্ত। আবারো কান্না। বাহান্ন সালেও হয়তো এমনই ছিলো ঢাকার বাতাস।

তখন আমি জন্মাই নি। তাই জানি না কেমন ছিলো সেই ফেব্রুয়ারিটা। তখনো গুলির শব্দে ঢাকার আকাশ কেঁপেছিলো। মেডিকেল কলেজের করিডোর ভেসেছিলো রক্তের বন্যায়। সেই রক্তপাতের কারনেই আজ আমরা বাংলায় কথা বলি, বাংলায় লিখি, বাংলায় হাসি, বাংলায় কাঁদি।

কিন্তু ২০০৯ এর রক্তপাতে কি পাওয়া গেলো? কেবলই মনে হয় হারালাম। তিনদিন ধরে কেবল নিশ্চুপ হয়ে আছি। কেমন যেন একটা ভোঁতা অনুভূতি। না, আমার কেউ মারা যান নি। জলপাই রঙের পোষাক পরা আমার কোন নিকটজন নেই।

তারপরো আমি কষ্ট পাই। কারন তারা আমার দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিলো। তারচেয়েও বড় কথা তারা তো আমার মতই মানুষ। মৃত্যুর পর মানুষ, তার উপর যতই ক্ষোভ থাকুক না কেন, লাশটিকে সম্মান দেখাতে হয়। বিপথগামী বিডিআর সৈন্যরা সেটাও দেখায় নি।

আমারা পাকিস্তানী হানাদারদের নৃসংশ বলি। আমরাই বা কম কিসে। গত কয়দিন ধরে কত আলোচনা। কত টক শো। মিডিয়াগুলো কে কার আগে লাশের ছবি দেখাবে তার প্রতিযোগিতায় মত্ত।

কেউ কেউ বিকৃত লাশের চেহারাটা ঝাপসা করে প্রচার করে। কেউবা সেটা করারও প্রয়োজন বোধ করে না। না করুক, তবুও আমি ঝাপসা চোখে সেগুলো দেখি। প্রতিবার মনে করি এরপরই হয়তো বলবে আর কোন গনকবর পাওয়া যায় নি। বেঁচে যাওয়া বাকি সেনা কর্মকর্তাদের খুঁজে পাওয়া গেছে জীবিত অবস্থায় সেই খবরে আশায় তাকিয়ে থাকি টিভির পর্দায়।

কিন্তু লাভ হয় না। গনকবরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সাথে লাশের সংখ্যা। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিলো আসলেই মনে হয় এটা বিদ্রোহ। বিডিআর রা তাদের দাবির জন্য জিম্মি করেছে সেনা কর্মকর্তাদের।

কিন্তু হত্যা করার ভয়াবহতা দেখে অবাক হয়ে যাই। একসময় অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারাই। এক এক করে বের হয় গনকবর। স্বজনদের কান্না দেখি, দেখি সেনা কর্মকর্তাদের কান্না। কবরের দিকে তাকিয়ে কোন এক সেনা কাঁদছিলো।

কে জানে সে হয়তো ভাবছিলো একদিন তাকেও হয়তো হতে হবে এরকম কোন এক কবরের বাসিন্দা। কারন স্বাধীনতার পর খেকে কত কত বিদ্রোহে আমরা কত কত সেনা কর্তকর্তাকে হারিয়েছি। তাই আজকের সেনা কর্মকর্তাটিকেও হয়তো হতে হবে ভবিষ্যতে কোন এক বিদ্রোহের বলি। কারন, এদেশে যে বিচার হয় না এসবের। আমরা টিভিতে নৃশংসতা দেখে কাঁদি।

আলোচনা সমালোচনা করি। শোক দিবস পালন করি। কালো পোষাক, কালো ব্যাজ পরি। কাল থেকে আবার হয়তো সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবো। কফির মগে চুমুক দিয়ে আলোচনার ঝড় তুলবো টেবিলে।

সরকার–বিরোধিদল একজন আর একজনকে দুষবে। বিচারও হয়তো হবে। একবছরের মধ্যে হয়তো একটা স্মৃতিস্তম্ভও তৈরী হবে। তারপর আমরা ভুলে যাবো। আগামী ফেব্রুয়ারীতে হয়তো কোন একটা দিবস পালন করবো।

টিভিতে রিপোর্ট হবে। তারপর আবারো ভুলে যাবো। কেবল সেই সব মানুষগুলো কখনোই ভুলতে পারবে না, আমাদের কাছে কর্নেল, মেজর কিংবা লেফটেনেন্ট জেনারেলরা যাদের কাছে শ্রেফ একজন বাবা, একজন সন্তান বা একজন স্বামী ছিলো। কেউ বলে ইন্টিলিজেন্সের দোষ, কেউ বলে সরকারের, কেউ বলে ভারতের, কেউ বা বলে যারা দেশের শত্রু তাদের। আমি ভাবি আমি ব্যার্থ।

দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য কেবল চোখের পানি দিয়ে দায়িত্ব সারছি। টিভিটা বন্ধ করে রাখি। ব্লগের লেখা গুলোও এরিয়ে যাই। চোখ বুজে থাকি পাছে খবরের কাগজে চোখ পরে যায়। কানে গুজে রাখি হেডফোন যাতে শুনতে না হয় আর কোন আলোচনা।

আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। লাশগুলো আমাকে যেন খুঁজে না পায়। এই লেখাটা লেখা ছাড়া আর কি করতে পারি আমি। অন্তত আমার লেখা গুলোর দিকে তাকালে হয়তো চোখে পড়বে এই লেখাটা। মাঝে মাঝে মনে পড়বে সেই সব বীরদের কথা।

তাই লিখতে বসা। না হলে হয়তো আমিও কাল থেকে হারিয়ে যাবো ব্লগের মজার মজার সব পোষ্টে। ভুলে যাবো, সবাই যেভাবে যায়। আর একটা কথা,সবাই এখন কাঁদা ছুড়াছুড়ি নিয়ে ব্যাস্ত। সরকারের কথা শুনে মনে হচ্ছে তারা তদন্তের আগেই জানে যে বিরোধী দল এজন্য দায়ী।

বিরোধী দলের কথা শুনে মনে হয়, এতোগুলো মানুষ মারার জন্য সরকারই দায়ী। তারাই ইচ্ছা করে দেরী করেছেন। সরকার পন্থী ব্লগাররা পোষ্ট দিচ্ছেন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আর সরকার বিরোধীরা পোষ্ট দিচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে। সবাই ভাবছে কিভাবে ফায়দা লুটবে। আর, নিহত সৈনিকের পরিবারের সদস্যরা এসব দেখছেন, আর হয়তো ভাবছেন যে হবে না, এবারো সত্যিকারের বিচার হবে না।

তাদের দিকে তাকিয়ে কি আমরা এসব বন্ধ করতে পারি না?
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.