হিমাদ্রি শেখর ভদ্র
বোরো মওসুম শুরু হতে আর একসপ্তাহ বাকী। আগামী ১৬ অক্টোবর বিশ্বখাদ্য দিবসের দিন থেকে শুরু হবে দেশের অন্যতম ভাটি অঞ্চলের বোরো মওসুম। হাওরপাড়ের কৃষকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক, ফসল রাবাঁধ কৃষিঋণ নিয়ে। হাওরপাড়ের কৃষকেরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চাষাবাদের সকল কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করার কথা জানান বর্তমান সরকারের কাছে। এক ফসল নির্ভর সুনামগঞ্জ তথা সমগ্র ভাটিঅঞ্চল।
সমগ্র ভাটিঅঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ফসল। বোরো ফসল কেটে কৃষকের ঘরে তোলা হলে তাদের সুখ স্বপ্নের চারাগাছটি বেড়ে ওঠে। বোরো মওসুমের শুরুতেই সময় মতো বেড়ীবাঁধ (ফসল রাবাঁধ) তৈরী করা না হলে সীমান্তের ওপাড় থেকে পাহাড়ী ঢল নেমে এলে আগাম বন্যার পানিতে বোরো ফসল তলিয়ে যাবে তাদের। ফসল সাথে তলিয়ে যাবে কৃষকদের সুখ স্বপ্নের ছবিগুলোও হাওরের অথৈ জলে।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ - ২০০৯ অর্থবছরের ১৫ অক্টোবর হতে ১৫ মার্চ পর্যন্ত বোরো চাষাবাদের সময়সীমা।
চলতিঅর্থ বছরে জেলায় বোরো আবাদের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় হাইব্রীড ২৮০০হেক্টর, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ৯০০০হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৪০০০ হেক্টর, মোট ১৫,৮০০হেক্টর; বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় হাইব্রীড ১৮০০হেক্টর, উফশী ৪৬০০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৩৯০০ হেক্টর মোট ১০,৩০০ হেক্টর; তাহিরপুর উপজেলায় হাইব্রীড ২০১০ হেক্টর, উফশী ৫০০০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৫০০০ হেক্টর, মোট ১২,০১০ হেক্টর; জামালগঞ্জ উপজেলায় হাইব্রীড ২৫০০ হেক্টর, উফশী ১০,৫০০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৪০০০ হেক্টর, মোট ১৭,০০০ হেক্টর; শাল্লা উপজেলায় হাইব্রীড ২৮৯০ হেক্টর, উফশী ১৩,৯৩০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ২৬০০ হেক্টর, মোট ১৯,৪১০ হেক্টর; দিরাই উপজেলায় হাইব্রীড ৩৫০০ হেক্টর, উফশী ১৭,৯৮০ হেক্টর স্থানীয়জাতের ৪০০০ হেক্টর, মোট ২৫,৪৮০ হেক্টর; ধর্মপাশা উপজেলায় হাইব্রীড ২১০০ হেক্টর উফশী ২০,৩৫০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৫৮০০ হেক্টর, মোট ২৮,২৫০ হেক্টর; ছাতক উপজেলায় হাইব্রীড ২০০০ হেক্টর, উফশী ৬০০০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৩২০০ হেক্টর, মোট ১১,২০০ হেক্টর; দোয়ারাবাজার উপজেলায় হাইব্রীড ১৮০০ হেক্টর উফশী ৬৫০০ হেক্টর, স্থানীয়জাতের ৩২০০ হেক্টর, মোট ১১,৫০০ হেক্টর; দণি সুনামগঞ্জ উপজেলায় হাইব্রীড ২১০০ হেক্টর, উফশী ৭৫০০ হেক্টর স্থানীয়জাতের ৪০০০ হেক্টর, মোট ১৩,৬০০ হেক্টর; জগন্নাথপুর উপজেলায় হাইব্রীড ২৫০০ হেক্টর, উফশী ৯,২০০ হেক্টর স্থানীয়জাতের ৫৩০০ হেক্টর মোট ১৭,০০০ হেক্টর, জেলার মোট ১১ টি উপজেলায় হাইব্রীড ২৬,০০০ হেক্টর, উফশী ১লাখ ১০হাজার ৫৫০ হেক্টর স্থানীয় জাতের ৪৫ হাজার হেক্টর সর্বমোট ১ লাখ ৮১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ফসল চাষাকাদের ল্যমাত্রা র্নিধারণ করা হয়েছে। এজন্য ৩৬ হাজার ২শত ১৬ মেট্রিক টন সার এর চাহিদা সরকারের নিকট পেশ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৩২ হাজার ৮২ মেট্রিকটন ইউরিয়া সারসহ অন্যান্য সার। ল্যমাত্রা অনুযায়ী আগামীতে ফসল উৎপাদন হলে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে বলে জানা জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর।
যার বাজার মূল্য প্রায় কয়েশ কোটি টাকা। নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যমুল্যের গ্যাড়াকলে কৃষকরা এমনিতেই অসহায় দিনাতিপাত করছেন। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মানুষ প্রতিবছর আশ্বিন-কার্তিক মাসের শুরুতে তীব্র অভাবে দিনরাত্রি অতিবাহিত করে থাকেন। হাওরের পানিতে নেই মাছ, ঘরে নেই একমুঠো চাল, জমিতে নেই ফসল, দিনভর কাজের সন্ধানে ঘুরেও কাজ মিলে না তাদের। যদিও স্বল্প মুজুরির বিনিময়ে কাজ মেলে তা দিয়ে কিনতে পারে না কেজি খানেক চাল।
সামান্য অসুখ-বিসুখে মিলেনা তাদের ওষুধপত্র। হাওর পাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলো কার্তিক মাস পর্যন্ত থাকে জল বেষ্টিত। তারপর ধীর গতিতে হাওরের পানি নেমে যাওয়ার পর শুরু জালা (বীজবপনের কাল) ফেলার সময়। এসময় তারা ছোট ছোট হেমথ (একধরনের হস্ত চালিত সেচযন্ত্র) দিয়ে পানিসেচ দিয়ে বীজ ফেলানোর কাজ শুরু করে থাকে। এর পূর্বে বীজ ধানের জালা আঙ্কুরিত করার জন্য পুকুরের পানিতে বীজ ধানের বস্তা একদিন পানিতে ফেলে রেখে বীজের অংকুর উদগম (জার্র্র্র্মিনেশন) ঘটানো হয়।
দুর্বিষহ দিন যাপন করছে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষেরা। ভৌগলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন, জনপদের ছয়টি উপজেলায় ছোট বড় সব মিলিয়ে ১২৮ হাওর রয়েছে। হাওর তীরবর্তী রয়েছে শতাধিক গ্রাম। ছোট ছোট দীপের মতো বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো নিশ্চল ঠায় কোনক্রমে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সব গ্রামের একই অবস্থা।
বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে কোনমতে জীবন বাঁচালেও শুকনো মৌসুমে তারা দুচোখে অমানিষার অন্ধকার দেখেন। কাজের অভাবে দুর্বিষহ ও কঠিন দিন পার করছে সবাই। কৃষিকাজ ছাড়া বিকল্প কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় নূন্যতম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। তাদের সবার মুখে এককথা দ্রব্যমূল্যের দাম যে হারে বাড়ছে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি নেই? কৃষি উপকরণসহ যাবতীয় পণ্যের দাম এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের গোলা বোরো ধানে ভরপুর কিন্তু প্রান্তিক কৃষকের চালের থলে এফোঁড় অফোঁড় হয়ে গেছে।
ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে হাওরপারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। দ্রব্যমূল্যের এ উর্ধ্বগতি প্রান্তিকচাষী ও নিু আয়ের মানুষের মধ্যেও হতাশার সৃষ্টি করেছে। বাজারে গিয়ে লবণ কিনতে পান্তাভাত ফুরিয়ে যাচ্ছে তাদের। চলতি বছর বোরো ফসলের ভালো ফলন হলেও তাতে শুধূ মাঝারি ও বড় বড় ধনাঢ্য কৃষকদেরই পোয়াবারো অবস্থা। দরিদ্র বর্গাচাষীদের অতিকষ্টে পাওয়া জমানো ধান দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে জ্বালানী তেল, ভোজ্য তেল আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে।
হাওরপাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্বচ্ছল কৃষক ও বর্গাচাষীগণ জানান, সরকার কৃষকদের চাহিদা মতে আগাম পদপে নিলে আগামীতেও বোরো ফসলের বাম্পার উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে, তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বোরো মওসুমের শুরুতেই হাওরপাড়ের কৃষকরা সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক ও সময় মতো ফসল রাবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার আঙ্গারুলি গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক (৬০) বলেন, আর কয়দিন পরেই জালা ফালানি লাগবো। বীজধানের লাইগ্যা টাউনও গিয়া লাইন ধইরা খাড়াইয়া থাকন লাগে।
তাহিরপুর উপজেলার টাকাটুকিয়া গ্রামের সাধন মিয়া (৪৫) বলেন, আমরার সার পাইতে খুব কষ্ট অয়।
ডিলারে যে সার আনে ইতা দিয়া পুষায় না।
ধরমপাশা উপজেলার ইব্রাহিম মিয়া (৬০) বলেন, তে লাগানির সময় কৃষি ব্যাংক থাইক্যা ৫ হাজার টেকা ঋণের লাইগ্যা ১ মাস ঘুরন লাগে। ই সময় তে রোয়ার সময় পার হই যায়। এইবার যাতে এইতা না অয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।