চারা সংকট এখনো তীব্র। সেচ মৌসুমের শুরুতেই ভয়াবহ লোডশেডিং। শ্রম ও উপকরণের চড়া মূল্য। সব মিলিয়ে নানামুখী সংকটে পড়েছে চলতি মৌসুমের বোরো চাষ। কৃষকরা বলছেন, এবার বোরো চাষের খরচ যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে প্রতিমণ (৪০ কেজি) ধান উৎপাদনে খরচ পড়বে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ।
তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার দাবি, কৃষকের উৎপাদন ব্যয় খুব বেশি বাড়বে না। কারণ সরকার সার, সেচসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতে এ বছর প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ধানের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশই আসে বোরো থেকে। সম্পূর্ণ সেচনির্ভর বোরো চাষের সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমনিতেই ঘন কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় চারা সংকট দেখা দিয়েছে।
এর ওপর বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের দরুন সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর নাব্যতা সংকটের কারণে মাঠ পর্যায়ে কৃষকের হাতে পর্যাপ্ত ডিজেল পেঁৗছাচ্ছে না সঠিক সময়ে। সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র এরই মধ্যে লিটারপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা বেশি আদায় করছে। নানা সংকটে কিছু জমি পতিত থাকতে পারে বলেও তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. এম এ ছালাম বলেন, বীজতলায় চারা বড় হওয়ার সময় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনীয় হলেও এবার আড়াই সপ্তাহ
ধরে ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতসহ সারা দেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ৬ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ সময়ে রোদ না থাকায় বীজতলায় পানি জমে চারা 'ডাম্পিং অফ' ও 'সিডলিং ব্লাইট' রোগে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মরে গেছে অসংখ্য বীজতলাও।
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ড. সদরুল আমিন বলেন, কোল্ড ইনজুরিতে বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং তা বোরো উৎপাদন কমাবে। তাঁর পরামর্শ, আবহাওয়ার প্রতিকূলতা এড়াতে বোরো চাষ আরো ১৫-২০ দিন এগিয়ে আনা যেতে পারে। তিনি বলেন, কৃষি উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় ধানের দাম বাড়েনি।
এবার চারার দামসহ বোরো চাষে খরচ বেড়েছে। এতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. জহুরুল করিম বলেন, চারার অভাবে অনেক স্থানেই ধান রোপণে দেরি হচ্ছে। ফলে উৎপাদন কিছুটা কমতে পারে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সাঈদ বলেন, বোরো চাষের প্রথম দিকে বীজ-চারার কিছুটা সংকট থাকলেও এখন নেই।
কারণ দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দুই লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা হয়েছে।
এদিকে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মাঠ পর্যায়ের একরের পর একর বীজতলা নষ্ট হয়ে হলুদ বিবর্ণ রূপ নিয়েছে। পর্যাপ্ত সময় ও মানসম্মত বীজের অভাবে কৃষকরা দ্বিতীয় বারের মতো বীজতলা তৈরি করতে পারেননি। এখন চারা কিনতে গিয়ে মাথায় হাত পড়েছে। এক বিঘা জমি চাষের জন্য আড়াই হাজার থেকে চার হাজার টাকার চারা কিনতে হচ্ছে।
তবুও মনের মতো রোপণ করা যাচ্ছে না। পাবনার পারখিদিরপুর গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী জানান, এক কুয়া (স্থানীয়ভাবে পরিমাপ) চারার দাম ৩৫০ টাকায় ঠেকেছে। এক বিঘা জমিতে লাগছে অন্তত ১০ কুয়া চারা। তিনি জানান, চাষ দিয়ে এক বিঘা জমি প্রস্তুত করতে গতবার ৬০০ টাকা লাগলেও এবার লাগছে প্রায় এক হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় চারা রোপণে লাগছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।
সেচের জন্য (স্থানবিশেষে) উৎপাদিত ধানের চার ভাগের এক ভাগই নিয়ে যাবে পাম্প মালিকরা। গত বছর দুই-তিন দফা ধান নিড়ানির খরচ প্রায় এক হাজার টাকা থাকলেও এবার তা দেড় হাজার টাকা ছাড়াবে। প্রায় একই হিসাব কাটা ও মাড়াইয়ের ক্ষেত্রেও। এ ছাড়া রয়েছে ভেজাল সারের দৌরাত্দ্য, উচ্চমূল্যের কীটনাশকসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজে মোটা অঙ্কের ব্যয়ের হিসাব।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বিত্তিপাড়া গ্রামের কৃষক আমদ আলী গত বছর ২০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করলেও এবার চারা না পাওয়ায় মাত্র দুই বিঘা জমি রোপণ করেছেন।
বাকি জমিতে তামাক চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলায় ১৬ লাখ ২২ হাজার ৪৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়। কিন্তু তীব্র শীত ও কুয়াশায় ১৮ হাজার হেক্টর বীজতলা নষ্ট হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান। অভিযোগ উঠেছে, বীজতলা নষ্ট হওয়ার প্রকৃত তথ্য কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর আমলে নেয়নি এবং মন্ত্রণালয়কেও জানায়নি। এদিকে বোরো চাষে সেচের শুরুতেই লোডশেডিং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
অধিকাংশ জেলায়ই মাঠ পর্যায়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বগুড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিভাগ সূত্র জানায়, এ জোনে (বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সান্তাহার) সেচকাজে প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ১১০ মেগাওয়াট হলেও পাওয়া যাচ্ছে ৭০ মেগাওয়াট। রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে বিদ্যুৎ চাহিদা প্রতিদিন ৩২০ মেগাওয়াট হলেও গতকাল বুধবার পাওয়া গেছে ১৪৪ মেগাওয়াট।
কৃষি সচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমনের পর এবার বোরোর উৎপাদনও বাম্পার হবে বলে মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদদের কাছ থেকে জেনেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট শৈত্যপ্রবাহ ও কুয়াশায় বোরো বীজতলার কিছু ক্ষতি হয়েছে।
তবে তা ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ চাহিদা মেটাতে কৃষক পর্যায়ে অতিরিক্ত চাষও হয়েছে। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।