জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।
চতুর্থ পর্ব
সামনে মাসুদের ফার্ষ্ট ইয়ার ফাইনাল। তার অনেক পড়া জমে আছে। কিন্তু ইদানীং সে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে পারছে না। শিউলিদের বস্তি থেকে ঘুরে এসে সে অনেকটা ঘোরের মধ্যে সময় কাটাচ্ছে।
মাসুদ তার বোনকে অনেক ভালবাসে। পিচ্চিটার সাথে সে অনেক গল্প করতে পারে। কিন্তু ইদানীং বোনের সাথে কথা বলতে তার ইচ্ছে করে না। পিচ্চিটার আদুরে চেহারাতে সে শিউলিকে দেখতে পায়। শিউলির ভাই হতে না পারার অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
মাসুদ মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখত। অনেক স্বপ্ন। পৃথিবী বদলে দেবার স্বপ্ন। যে পৃথিবীতে আনিসের মত মেধাবী ছাত্রদের মেডিক্যালে পড়ার লালিত স্বপ্নকে কবর দিতে হবে না। 'ভয়ংকর শীতে কাঁপছে একটি ছোট্ট শিশু' বিষয়ক পত্রিকার কোন ছবিতে গা শিউরে উঠবে না।
শিউলিদের ফুল বেঁচতে হবে না। সব শিশুরাই বই ভর্তি ব্যাগ কাধেঁ ঝুলিয়ে হাসিমুখে স্কুলে যাবে। কিন্তু তার কাছে এখন সবকিছু হাস্যকর মনে হচ্ছে। কেননা, এই মুহূর্তে সে একজন শিউলির জন্যই কিছু করতে পারছে না।
এ কথা ভাবতেই তার চোখ জলে টলমল করছে।
মনে হচ্ছে সে এখুনি চিৎকার করে কাঁদবে। মনের কোণে জমে থাকা ক্ষোভ সে কাউকে দেখাতে পারছে না। রুমের বাতিটা নিভিয়ে সে অন্ধকারে শুয়ে আছে। সব কিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিষাদে ভরে উঠছে মন।
অনেক কষ্টকর কথায় ভারী হতে থাকে বুকের গভীরে, সংগোপনে।
আগামী পরশু কলেজে বখতেয়ার স্যারের ক্লাসে একাউন্টিংয়ের টেষ্ট আছে। এখন মোটেও পড়তে ইচ্ছে করছে না। নিজের সাথে বিলাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
১৬.
শুক্রবার:
ছুটির দিনে সে সাধারণত দেরী করেই ঘুম থেকে উঠে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হয়। তার ছোট ভাই-বোন 'ভাইয়া উঠো' বলতে বলতে রীতিমত গলা ফাটিয়ে চলে যায়। তারপর তার মা এসে আরেক দফা ডাকাডাকি করে টেনে হিঁচড়ে তাকে বিছানা থেকে তোলে দেয়। অনেক সময় তাতেও কাজ হয় না। অবশেষে তার হিটলার বাবার হুংকার শুনে একলাফে উঠে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু, একি! আজ সে অনেক তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। তার মার চক্ষু চড়কগাছ। সে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসে পড়ে। সকালে নানরুটি দিয়ে বাসি গরুর মাংস খেতে তার চমৎকার লাগে। এই একটা খাবারের অভ্যাস তার কখনো বদলায় না।
কোন কারণে মাংস না থাকলে তার মার আফসোসের শেষ থাকে না।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে তড়িঘড়ি করে সে রেডি হয়ে যায়। কিছু বলার আগেই মা এসে হাজির।
: কোথায় যাচ্ছিস?
সুজনের বাসায় যাচ্ছি বলে সে বের হয়ে যায়। বন্ধুদের মধ্যে সুজন ছেলেটাকে তার মা'র খুব পছন্দ।
সুজন বাসায় আসলে তার মা অনেক খূশী হয়। ছেলেটাকে পেট ভরে খাওয়ানো যায়। মায়েরা খাওয়াতে পারলে ছেলেদের খুব পছন্দ করে। সুজন ও কখনো খাব না বলে না। মাসুদের সাথে পরিচয়ের আগে সুজন কখনো গরুর মাংস মুখে দেয় নি।
অথচ এখন সে গরুর মাংস'তে ও না বলে না।
একবার রোজার দিনে ইফতারীর সময়ে সুজন ওদের বাসায় আসে। তার মা তো আর জানে না সে হিন্দু। মাসুদ ও কখনো বলে নি। এখন ইফতারীর সময় তার মা সুজনকে যেতে দিবেই না।
ইফতারী করেই যেতে হবে। মাসুদ তখনও কিছু বলে না। অতপর সুজন ও রোজা না রেখে পেটে ইফতারী চালান দেয়। অনেকদিন পরে মাসুদের মা জানতে পারে সুজন হিন্দু। তারপর তো সবার মধ্যে (ভাই-বোন) রীতিমত হাসির রোল পড়ে যায়।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে সে সুজন'ই এখন পর্যন্ত ঈদের দিনের প্রথম অথিতি।
১৭.
আসলে সে সুজনের বাসায় যাবার কথা বলে শিউলিদের বস্তিতে আসে। চাচা তাকে দেখে অবাক । তারপর চাচার সাথে আলাপচারিতা শুরু করে।
আস্তে আস্তে সে শিউলির স্কুলে ভর্তি করার প্রসঙ্গ নিয়ে আসে।
চাচা রাজী হতে চান না। কিন্তু মাসুদ নাছোড়বান্দা। শিউলিকে স্কুলে ভর্তি করিয়েই ছাড়বে এমন প্রতিগ্গা নিয়েই সে এসেছে। শেষপর্যন্ত অনেক বলে কয়ে চাচাকে রাজী করানো হয়। অর্থকড়ির ব্যাপার নিয়ে চাচাকে কোন চিন্তায় পড়তে হবে না বলে সে আশ্বস্থ করে।
চাচাকে রাজী করাতে পেরে তার অনেক ভালো লাগছে। এই ভালো লাগাটাকে ধরে রাখতে হবে।
পরের দিন:
সে কলেজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু কলেজে আর যাওয়া হয় না। সে স্কুল, কলেজে সবসময় নিয়মিত।
এমনকি ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে সে স্কুলে চলে যেত। বলাবাহুল্য তখন অনুপস্থিতির জন্য দিনপ্রতি দুই টাকা করে জরিমানা গুনতে হত। একবার সে স্কুলের বেতন দিতে সফি কেরানির অফিসে যায়। সফি সাহেব ক্লাসের উপস্থিতির খাতা দেখে রীতিমত আফসোসের সুরে বলে 'আরে মিয়া তোমারে তো একদিন ও অনুপস্থিত দেখিনা'।
আরেকবার হরতালের দিন সে কলেজে গিয়ে হাজির।
তাকে দেখে ইউসুফ স্যার বলেছিল, কি ব্যাপার তোমরা হরতালের দিনও আমাদের রেহাই দিবে না?'
যাই হোক, সে শিউলিকে নিয়ে ল্যাবরেটরী স্কুলে যায়। অতপর তাকে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করানো হল। স্কুলে ভর্তি হতে পেরে শিউলি অনেক খুশী হয়। এই প্রথম মাসুদ শিউলির মুখে হাসি দেখেছে। মাসুদের অনেক ভালো লাগছে।
কিন্তু মেয়েটির মুখে এই হাসি কি সে ধরে রাখতে পারবে?
চলবে....
(ব্যস্ততার কারণে দেরীতে পোষ্ট দেওয়ার জন্য লেখক আন্তরিকভাবে দুঃখিত, তবে আশার কথা পরের পর্ব ইতিমধ্যে লেখা হয়েছে বিধায় আর দেরী হবে না। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।