শিউলি আক্তার এখন আর নিজেকে ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী’ বলতে চান না। তাঁর ভাষায়, ‘একসময় আমার অবস্থা খারাপ ছিল। বুদ্ধি কম ছিল। কথা বলতে পারতাম না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম।
কিন্তু এখন আমি চাকরি করি। নিজেই বাবা-মাকে দেখি। ’
শিউলি বর্তমানে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিকদের সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান সুইড-বাংলাদেশে নৃত্যশিক্ষা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর বেড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানেই।
সুইড-বাংলাদেশের সভাপতি জওয়াহেরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিউলিকে দেখে এখন আর চট করে বোঝার উপায় নেই যে সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।
ছোট থেকে সুইড-বাংলাদেশের গেন্ডারিয়া শাখায় শিউলিকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। এখন এই মেয়েটি শুধু নিজেরই নয়, বাবা-মাকেও দেখছে। ’
লিকলিকে অপুষ্ট শরীর শিউলির। কথা কিছুটা গুছিয়ে বলতে পারলেও খানিকটা আটকে আটকে যায়। কথার মধ্যে অসংলগ্নতারও ছাপ।
লিকলিকে শরীরের শিউলি প্রতিবন্ধীদের জন্য আয়োজিত বিশেষ অলিম্পিকে ‘বউছি’ ও ব্যাডমিন্টন খেলায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জপদক এনেছেন। বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
খেলাধুলার পাশাপাশি সুইড-বাংলাদেশে কাজ করে জুলাই মাস থেকে শিউলি দুই হাজার ৪০০ টাকা বেতন পাচ্ছেন। এর আগে বেতন পেতেন আরও কম। বাবা-মাকে দেখাশোনা করছেন তিনি।
সম্প্রতি শিউলির সঙ্গে কথা বলার জন্য হাজির হই ইস্কাটনে সুইডের কার্যালয়ে। অকপটে জানালেন তাঁর জীবনের কাহিনি।
শিউলিরা তিন ভাই, দুই বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ভাই আলাদা থাকেন।
একটা ঘরের মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে ছোট ভাই বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকেন। এ ঘরের অন্য পাশে শিউলি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। বাবা-মায়ের ওষুধ কেনা, যত্ন করা সব তাঁকেই করতে হয়।
শিউলির বাবা রিকশা চালাতেন। আট মাস আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পান।
ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় সেই ব্যথা এখনো ভালো হয়নি। অবস্থা আস্তে আস্তে আরও খারাপ হচ্ছে। ফলে কাজও বন্ধ। মা ঘরের কাজ করেন।
নগরের গেন্ডারিয়ায় ঘরভাড়া দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা।
বড় ভাই ঘরভাড়ার আড়াই হাজার টাকা দেন। বাকি টাকা দেন শিউলি। খাওয়ার খরচের বেলায়ও ছোট ভাই এক দিন আর শিউলি এক দিন বাজার করেন। সকালে হালকা-পাতলা কোনো নাশতা খান। দুপুর ও রাতে ভাতের সঙ্গে ছোট মাছ, শাকসবজি বেশি থাকে।
শিউলির হাতে টাকা থাকলে এবং মন চাইলে মাংস কেনেন। তবে শিউলি যেহেতু খেলাধুলা করেন, তাই তাঁর কোচ বেশি করে খেতে বলেছেন। কিন্তু বিভিন্ন চিন্তায় শিউলি ভালো করে খেতে পারেন না। রাতে তাঁর ঘুমও হয় না।
শিউলি এত কী চিন্তা করেন তা জানতে চাইলে বলেন, ‘এখন বাবা-মা আছে।
তাঁরা না থাকলে আমার কী হইব এই চিন্তা করি। সুইড-বাংলাদেশের স্যারদের মুখ কেমনে উজ্জ্বল করতে পারি তা-ও চিন্তা করি। ’
২৫ বছরে পা দিতে যাচ্ছেন শিউলি। এবার ঈদে শিউলি ৩০০ টাকা দিয়ে মাকে একটি শাড়ি কিনে দিয়েছেন। বাবাকে কিনে দিয়েছেন একটি লুঙ্গি।
নিজের জন্য পছন্দমতো একটি জামাও কিনেছেন।
শিউলির জন্মের ইতিহাসটা শুনে শুনে মনে রেখেছেন। মা যে তাঁকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন, তা তিনি জানেন। ছয় মাসে জন্ম তাঁর। জন্ম হওয়ার পর সাত দিন চোখ খোলেননি তিনি।
ধাই আর মা ছাড়া কেউ তাঁকে দেখত না। এ কথাগুলো বলতে গিয়ে শিউলির দুই চোখ চিকচিক করে কান্নায়।
সুইড-বাংলাদেশ শিউলির জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছে বলেই তাঁর বিশ্বাস। তাই চাওয়া-পাওয়াটা এ প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই। সরকারের কাছে কিছু চাওয়ার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি সুইড-বাংলাদেশের ছোট ছোট বাচ্চার জন্য একটি খেলার মাঠ, প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম চাইলেন।
খেলার মাঠটি যেন স্টেডিয়ামের মতো সুন্দর হয়, তা-ও জানিয়ে দিলেন।
নিজের জন্য কিছু চান কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি চাইলেই সরকার দিব নাকি। আমি যদি আমার জন্য একটা ঘর চাই তা কি কেউ দিব। আমি জানি, দিব না। তাই কিছু চাই না।
’
দিল্লিতে একটি প্রতিযোগিতায় সুন্দর গান গাওয়ার জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন শিউলি। গান শোনাতে বললে গান শুরু করলেন।
নগরের গেন্ডারিয়া থেকে বাসে করে শাহবাগে আসেন। তারপর হেঁটে ইস্কাটনে সুইড-বাংলাদেশের অফিসে আসেন তিনি। পড়াশোনা একদমই মনে রাখতে পারেন না।
অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে যাওয়ার একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। তাঁর ওপর ভরসা করছেন তাঁর বাবা-মা। নিজের ভবিষ্যৎ তো আছেই।
গ্রামীণফোনের ‘যাবে বহুদূর’ প্রচারণার একটি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে শিউলি এখন প্রায় সবার কাছে এক সাহসী কন্যা হিসেবে পরিচিত।
নগরের রাস্তার পাশে বড় বড় বিলবোর্ডে শিউলির ছবি।
শিউলির জীবনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগে অনেকে তাঁকে দেখলেই দূর দূর করত, কিন্তু টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখার পর যারা তাঁকে চিনতে পারে, তারা সম্মান দেখায়। আগে বাসে চড়তে দিতে চাইত না। শিউলি বাসে চড়তে পারলেও সিট পেত না।
কিন্তু এখন বাসে উঠলে অনেকে ভাড়াও নিতে চায় না।
শিউলি ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করতে শিখেছেন। বিজ্ঞাপন করার পর যে দুই লাখ টাকা পেয়েছেন, তা তিনি পূবালী ব্যাংকে জমা করে রেখেছেন। একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, সে কথা মনে রেখেছেন শিউলি।
বিয়ে করবেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘বিয়া তো করমুই।
তবে আমার মতো একজনরে বিয়া করমু, যে আমার কষ্ট বুঝতে পারে। ’
নিত্য জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য এগিয়ে চলছেন শিউলি।
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।