s
মাঝ রাত্তিরে বিকট শব্দে জেগে গেছে আরিফ। কোথাও বাজ পড়েছে। জানালার কাচটা টেনে দিতেই এক পশলা জলের ঝাপটা। হু হু করে বাতাস বইছে। চাপা গোঙানির মতো! এমন অদ্ভুত শব্দ শুনলেই আরিফ উদাসী হয়ে যায়, হ্যা কিছুটা ভয়ও পায়! সময়ের সাথে বয়সটা কম বাড়েনি, ত্রিশোর্ধ একজন মানুষ।
তবু ভয় পাওয়ার স্বভাবটা যায়নি। মেসে থাকতে রুমমেট চলে গেলে একা ঘরে ঘুমাতে বেশ ভয় পেত আরিফ, সারারাত এপাশ ওপাশ করতো বৃথাই, ঘুম আর আসে না। লাইট জেলে পিসি অন করে রাত কাবার করে দিত। হয়তো ভোরের দিকে ঘুমিয়ে যেত অবচেতনে।
আজ এতদিন পরেও সেই স্বভাবটা যায়নি, আরিফ এখনও একা ঘরে ভয় পায়।
যেমন যায়নি বৃষ্টি এলেই মানসপটে সালমা’র ভেসে ওঠা! কি দুর্দান্ত একটা সময় ছিল আরিফের, প্রতিদিন নিয়ম করে সালমা নিয়ে সন্ধ্যায় ঘুরতে যাওয়া, কফি, ফুচকা আরও কত কি। আরিফ শুনেছিল ছোটবেলায় সালমা নাকি ‘টাকা’ কে ‘কাটু’ বলতো। তাই সুযোগ পেলেই সালমার গাল ফুলানোর কারণ হতো আরিফ। এই মেয়েটাকে রাগলেও ভালো দেখায়!
মাগরিবের আজান পড়লেই সালমার হোষ্টেলের নিচে দাড়াতো আরিফ। প্রতিদিন তার সালমাকে দেখা চাই ই চাই।
কখনও সালমা তার আবদার মেটাতো, কখনও চেচিয়ে বলতো ‘প্রতিদিন এত দেখা করার কি আছে? চার-পাঁচ দিন পরে পরে আসবে'; আজ সেগুলো আরিফের প্রায়ই মনে হয়। নিয়তি আজ চাইলেও তার মুখটা দেখার অনুমতি দেয় না!
আরিফ আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যেত। ফেরার সময় তাকিয়ে থাকতো, হয়তো সালমা নিচে এসে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। এমনটা খুব কমই হয়েছে। প্রতিটা উপলক্ষে ও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে সালমাকে সাজিয়ে রাখতে।
সালমার জন্য কিছু একটা করা মানেই অনেক বেশি তৃপ্তি পাওয়া, ব্যাপারটা যেন এমন। তবুও কোথা থেকে যেন কি হয়ে গেলো, নিমেষের ঝড়ে সব অচেনা। হারিয়ে গেল সালমা। তবে শুধু শরীরটা নিয়ে, আরিফের মনে আদিগন্ত রয়ে গেছে সালমা। সচেতন কিংবা অবচেতনে।
এইতো সেদিন, শপিং মলে নিজের জন্য একটা শার্ট কিনতে গিয়েছিল আরিফ। খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে, আরিফ মুচকি হাসে। ইচ্ছে করে বাচ্চাটার গাল টিপে দেয়। সালমাকে আরিফ খুব বলতো, ‘আমাদের একটা মেয়ে চাই।
খুব ছটফটে, সুন্দর। আধো আধো বোলে কথা বলবে। পরীর মতো একটা মেয়ে। ‘ তা হতো বৈকি। আরিফ কিংবা সালমা কেউ তো কম ছিল না!
‘আংকেল আমাকে ওইতা দিবেন’ আঙ্গুল উচিয়ে একটা খেলনা দেখাচ্ছে বাচ্চাটা।
‘আরে এই বাচ্চাটাও তো আধো আধো কথা বলে’, বেশ উচ্ছসিত দেখায় আরিফকে। তড়িৎ গতিতে খেলনা এনে দেয় আরিফ, বাচ্চাটাকে খুব কোলে নিতে ইচ্ছে করছে।
‘অথৈ, এদিকে আসো’-----একটা মেয়েকন্ঠ শোনা যায়। বাচ্চাটার মা হয়তো। আরিফ এগিয়ে যায়।
ঠিক আগাতে পারে না, সামনে নীলরঙা শাড়ি পরে যে মেয়েটা দাঁড়িয়েছে সে যেন তীর বসিয়ে দিয়েছে আরিফের কলিজায়! সালমা! অস্ফুটে উচ্চারন করে আরিফ।
সালমা তাকায়, সেই পরিচিত চাহনি, সেই অমল মুখটা। আরিফের বুক ব্যাথা করে। ততক্ষনে সালমার পাশে একটা শাড়ি হাতে নিয়ে দাড়িয়েছেন স্যুট টাই পড়া এক ভদ্রলোক। ‘দেখোতো এটা কেমন?’ সালমাকে উদ্দেশ্যে করেই কথা বলছে লোকটা।
সম্ভবত সালমার স্বামী। আরিফ ঝাপসা দেখে, চকিতেই ঘুরে ফেরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায় শপিং মল থেকে।
সেদিন থেকেই এক অদ্ভুত রোগ হয়েছে আরিফের। বাচ্চা দেখলেই তাকে খেলনা কিনে দিতে চায়, একটাবার কোলে নিতে ইচ্ছে করে। অনেকেই আরিফের মুখ দেখে তার ইচ্ছা পুরনে সহায়ক হয়।
আবার অনেকেই ধান্দাবাজ ভেবে কেটে পড়েছে, গালিও দেয়। আরিফ অবশ্য কিছু মনে করে না। সালমা চলে যাওয়ার পর কোনকিছুই তাকে ওভাবে আঘাত করতে পারেনি। পড়াশুনা শেষ করে সদ্য পাওয়া দামি চাকরিটা যেদিন হঠাৎ চলে গেল সেদিনও না! হাসিমুখে বড়কর্তাকে বলে গেছে ‘আসি স্যার’।
তবে খুব জ্বালা হয়েছে দুঃস্বপ্নটা নিয়ে।
শপিং মলে সালমার বাবুটাকে দেখার পর থেকেই প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে আরিফ। তার বিছানায় ট্যা ট্যা করে কাঁদছে একটা ফুটফুটে মেয়ে। আরিফ তাকে ধরতে পারে না। সান্ত্বনাও না। বাচ্চাটা কেঁদেই চলে।
একসময় ঘুম ভেঙে যায় আরিফের, শূন্য বিছানায় হাতড়ায়। নাহ, কেউ নেই। আধো আধো বোলে কেউ বাবা ডাকছে না! আরিফ বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে!
ঈষৎ গরম জলের স্পর্শে ধ্যান ভাঙে আরিফের। নাহ, বৃষ্টি অনেক আগেই থেমে গেছে, এই জলটা চোখের কার্নিশ থেকে পড়ছে। আরিফ মৃদু হাসে, যেন নিজেকেই তিরষ্কার করে।
রাত বাড়তে থাকে। আরিফ ঘুমায় না। ভয়ে নয়, চাপা কষ্টে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।