আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেরালী চৌদ্দ-মুক্তির মন্দির সোপান তলে-৪



আগুন লাগছে মন পোড়া যায় দেখছে নাতো কেউ। পানি ঢালছে দুই নয়নে নিভল আগুন কৈ! কাঁচা সোনার মত শৈল মাছের পোনা, ভরা যৌবনে, ভাদ্রের গলায়, সোনার হারের মত অলংকার হয়ে, বর্ষার শোভা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শেরালী সুন্দরের বন্দনা করতে করতে শেখেনি। বিনাশেই মুক্তির আনন্দ খোঁজে। এত সুন্দর মাছের পোনা গুলি বড় হয় কালচে সাঁপের রং ধারণ করে কেন! সব জীবনই কী পরিনত বয়সে শৌশবের মাধুর্য্য হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এমন কঠিন কঠোর হয়ে উঠে? হয়ত এ কারণেই শেরালী নির্মম নিষ্ঠুর ভাবে গেথে ফেলছে বর্শীতে একটার পর একটা সোনালী মাছের পোনা।

জট বেধে থাকে বলে, জটলার ভেতর আদার ছাড়া বর্শী ফেলে টান দিলেই গেথে যাচ্ছে একটার পর একটা। কেরামত মাওলা বেঁচে থাকলে শেরালী এ বর্শী হাতে নেয়ার সাহস কখনই সঞ্চয় করতে পারতো না। তবে রতনের সাথে হয়তো ছল-চাতুরী করে জিততেও পারতো। বাবার সাথে কখনো তেমন খাতির তৈরী হয়নি শেরালীর। তাই তার মৃত্যুতে তেমন আফসোসও নেই।

তবে রতনের জন্য মনটা মাঝে মাঝে মোচর দিয়ে উঠে। ঈর্ষা ছিল রতনের শক্ত সমর্থ শরীরের উপর। কিন্তু ভরসাও ছিল। সেবার দবার সাথে চারা খেলা নিয়ে লেগে গেল। দবা সমানে কিল ঘুষি চালিয়ে শেরালীরে প্রায় তক্তা বানিয়ে ফেলছিল।

এমন সময় চিৎকার শুনে রতনের আবির্ভাব। দবার ঘারটা ধরে কুত্তার ছাওয়ের মত শূন্যে তুলে ছেড়ে দিল রতন। দবা মরি কি বাঁচি দৌড়। আমার খুব মজা লাগছিল দেখে। আর মনে মনে বলছিলাম জাননা যাদু আমি কার ভাই? আমার সাথে লাগলে মজা দেখামু।

কিন্তু এখনতো রতন নেই, শেরালী একা। যার যা খুসী আমাকে করতে পারে। টু শব্দটিও করতে পারব না। একটু অসহায় বোধ করছে শেরালী। মায়ের তিন কূলে কেউ নেই।

আমি দাদা-দাদী, নানা-নানী কাউকে দেখিনি। এই ভিটেয় কোন আত্মীয়ের পারা পরেণি কখনো। নানির ঘরে ছুইকা (নব জাতক) । অইলেই টাহুইরায় (ধনুষ্টংকর) ধরত। ছুইকা অইয়া বাঁচত না।

এর জন্য মা যখন বেঁচে রইলেন। পাঁচ দিনের দিনে নাম রাখছিলেন হুরুণী ( ঝুড়ু দারণী)। অবহেলায় যেন টাহুইরায় হুরুনিরে ফালায়া যায়! হুরুনিরে টাহুইরায় ফালায়া গেছে ঠিকই কিন্তু নিয়ে গেছে হুরুনির মাকে। অভিশপ্তের জীবন হুরুণীর অসহনীয় হল। বাপে রামচন্দ্র পুর বাজারে নাও ঘাটে কূলীর কাম করতো।

নাওয়ের মাল রেল গারীতে তোলতো। ছয় পারি বোঝা বাও হাতে উঠাইতো। এমন জোর ছিল গায়ে। পাক ভারত যুদ্বের সময় রামচন্দ্র পুর বাজারেও হিন্দু মুসলীম দাঙ্গার ঠেলা লাগে। সে দাঙ্গা মেটাতে পুলিসের গুলিতে এতিম হয় হুরুণী।

দশবার বছর বয়সে, আরেক এতিমের সাথে পাড়ার লোকের ঘটকালিতে জীবনের ঘাট-ছরা বাঁধেন। সবাই বলল " হুরুণী, তর কেউ নাই, মাওলার কেউ নাই। " দুইজনের দুঃখ কষ্ট দুই জনে বুঝবি। মাঝে মাঝে যখন কেরামত নিজের কষ্ট বুঝানোর জন্য মায়ের পিঠে আইল্লা ফাজন ভাঙ্গত তখন লাজে, দুঃখে, কষ্টে অভিমানে মায়ের কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। ফোলা পিঠ নিয়ে বাড়ির পেছনের সেওরা গাছটার তলে বসে বসে বিলাপ করত।

আর বাপ মায়েরে অভিশাপ দিত। টাহুইরায় আমারে কেন ফালায়া গেল! বাবার তাতে কিইবা আসে যায়। আমি আর রতন গিয়ে সাধা সাধি করতাম। মা বলতেন; তগ মরণ নাই? তগ লাইগ্যাই আমি এই অশুরের ঘর ছাইরা যাইতে পারি না। আমরা বুঝে নিতাম, সাধা সাধিতে কাজ হইছে।

ম্লান মূখে রান্না চড়াতেন, না হলে খাব কী। এখন মায়ের আর সেই মার সহ্য করতে হবে না। রতনের সাথে সুযোগ পেলেই নিজের বাপের চেহারাটা মিলিয়ে নিতেন। আমি ঈর্ষা করতাম। এখন আর তা করতে হবে না।

পাড়ার লোকে বলতো রতনের মা তর ফোলায় বলিষ্ঠ হইছে ঠিক তর বাফের মত। মা বলতেন দোয়া কইরেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বা পায়ের কানি আঙ্গুলের ধূলা বা হাতের কানি আঙ্গুলে নিয়ে রতনের কপালে ছুঁয়ে দিতেন। এখন থেকে হয়তো তা আমার কপালে জুটবে। আজ এত দিন পরে, ফাঁসীর দড়ি গলায় পরে, এ সব কথা বলে কোন লাভ নেই।

আমিই বা মায়ের জন্য কী করছি। পোড়া জীবনটার কলংক হয়তো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছি। মায়ের গৌরব শান্ত সুবোধ ছেলে না হয়ে, প্রতিশোধের বিষ বুকে নিয়ে বিষাক্ত করেছি আপনাদের সুন্দর সাজানো সমাজ সংস্কার। প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছি আরো কত মানুষের সংসার আর জীবন। হয়তো বেঁচে থাকলে আমার রক্ত পিপাসা নষ্ট করতো আরো কত সুখের নীড়! তার চেয়ে এখন শৈশবেই ফিরে যাই, সেই ভাল।

আমার সাফল্যে আজ মায়ের এতটুকু আনন্দ নেই। অবহেলায় সোনালি মাছের পোনা গুলে দেখে নিয়ে, আবার দৃষ্টি প্রসারিত করলেন অজানা গন্তব্যের দিকে। পিড়িতে বসে শূন্য দু"চোখ শূন্যেই মিলিয়ে দেন অনাদরে। আকাশের কিনারায় আজ শকূনের আনাগোনা অনেক। নীল বেদনার সমুদ্র ঢেকে দিতে কাশ ফুলের মত ধবল মেঘ ব্যার্থ চেষ্টা করছে।

দিনটি মায়ের মতই নির্লিপ্ত, বড় শান্ত। শরৎ -এর দিনগুলি এমনই। বিরহীনির বসন্তের মত। প্রিয়র অভিসারে গোপন প্রনয়ে বিলাসীনী বালিকার মনের মত অবাধ্য ব্যাকুলতার কুশুম প্রস্ফুটিত করে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.